‘শিল্পী’ গল্পে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছিলেন, সুতোর দাম বাড়ায় ব্যবসার চরম ক্ষতি হচ্ছে তাঁতশিল্পীদের। অনেকেই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। ছাড়তে পারেননি শুধু এক জন। কিন্তু তারও তো সুতো নেই। তাই সুতো ছাড়াই তাঁত চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মধ্যরাতে শোনা যাচ্ছে তাঁতের শব্দ।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুরের সিতাগাছি গ্রামের ছবিটাও অনেকটা সেরকমই। সুতোর দাম বাড়ায় কার্যত পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তাঁতিরা। তবে মানিকবাবুর গল্পের মতো এই গ্রামে তেমন কোনও শিল্পী নেই। মথুরাপুরের এই এলাকায় তাঁতের আওয়াজ থমকে গিয়েছে বেশ কিছু দিন। এখন শুধুই করাত আর ভ্যান রিকশার হর্ন। কেউ জীবিকার টানে তাঁত ছেড়ে রাজমিস্ত্রীর সামান্য জোগাড়ে, কেউ বা দিনমজুরে পরিণত হয়েছেন। তিনপুরুষ ধরে এই তাঁতশিল্পীদের বক্তব্য, তাঁদের জন্য কোনও সরকারি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। কাপড় বা গামছার রং পাকা করতেও জানেন না তাঁরা। সেটা শিখতে হলে যেতে হবে নদিয়ায়। কিন্তু নিজেদের খরচে নদিয়া গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সামর্থ্য নেই তাঁদের। |
দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুরের পশ্চিম গ্রাম পঞ্চায়েতের সিতাগাছি গ্রামে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ থাকেন। আগে গ্রামে সারা দিন ধরে শোনা যেত মাকু (তাঁতের কাপড় বোনার যন্ত্র) টানার শব্দ। সে সময়ে সুতোর দামও ছিল কম। ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি দরে সুতো মিলত তখন। কিন্তু গত ১৫ বছরে সুতোর দাম বেড়ে গিয়েছে অনেকটাই। ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে সুতো কিনতে বাধ্য হচ্ছেন ওঁরা। আর প্রধান কাঁচামালের এতটা দামবৃদ্ধিই তাঁত ব্যবসায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই তাঁতশিল্পীদের কাছে। লাভ কো দূরের কথা, কাপড় বুনে সুতোর দামটুকুও উঠছে না বহুক্ষেত্রে।
স্থানীয় তাতঁশিল্পী সুধাংশু গায়েন, পরেশ গায়েনরা জানান, গ্রামে তাঁতিদের কোনও সমবায় নেই। ফলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা যে দামে গামছা, কাপড়, মশারি ইত্যাদি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন, তাতে ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁদের। পাশাপাশি, পাকা রং করা গামছা, কাপড় বাজার ধরে ফেলায় তাঁদের তাঁতজাত জিনিস মার খাচ্ছে। সুধাংশুবাবু বলেন, “কাপড়ে কী ভাবে পাকা রং করতে হয়, সেটাই তো জানি না। এ ব্যাপারে সরকারি তরফেও কোনও প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা নেই। ফলে ক্ষতি করে তাঁত বোনার চেয়ে অনেকেই এখন অন্য পেশায় চলে গিয়েছেন এবং যাচ্ছেন।” তাঁদের কথায়, “গ্রামে তাঁতশিল্পীদের ঘরে গিয়ে দেখুন, তাঁতগুলো তুলে রেখে দিয়েছে সবাই। কাজকর্মের মাঝে সময় সুযোগ পেলে একটু আধটু বোনে কেউ কেউ। অথচ এটা আমাদের বাপ-ঠাকুর্দার আমলের ব্যবসা ছিল।”
ওই তাঁতশিল্পীদের আরও বক্তব্য, কোনও সমবায় না থাকায় সরকারি সাহায্যও পাচ্ছেন না তাঁরা। থাকলে সরকারি আর্থিক সাহায্যে কম দামে সুতো কিনতে পারতেন ওঁরা। গ্রামের বাসিন্দা তথা মথুরাপুর ১ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির বন ও ভূমি কর্মাধ্যক্ষ বাদল গায়েন বলেন, “পেশা আঁকড়ে বেঁচে থাকতে গিয়ে ঋণের ভারে জর্জরিত। তাই অনেকেই ভ্যান রিকশা কিনে জীবিকা নির্বাহ করছেন।”
মথুরাপুর-১ এর বিডিও সৌমেন মাইতি বলেন, “ওঁরা ওঁদের সমস্যার ব্যাপারে এখনও কিছু আমাদের জানাননি। বিষয়টি আমাদের জানালে ওঁরা যাতে সরকরি সাহায্য পান সেই চেষ্টা করব।” |