তিন দশকের ‘লাল দুর্গ’ গুঁড়িয়ে ঝাড়গ্রামে ঘাসফুল
১টা বছর একাধিপত্যের পর আছড়ে পতন। তবুও ঝাড়গ্রামে বামেদের বিপর্যয়ে বিস্মিত নয় কেউ।
কারণ, পতনের শুরুটা হয়েছিল আরও অনেক আগে, ২০০৮ সালেপুরবোর্ড গড়ার পর-পরই। মাওবাদী-জনগণের কমিটির প্রবল সন্ত্রাসে বারবার অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছিল শহর, ব্যাঘাত ঘটছিল উন্নয়নের কাজে। শহরের প্রবীণ সিপিএম নেতা গৌর পৈচ্ছার মৃত্যুর পরে দলীয় ভাবে বামফ্রন্ট কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। আর ২০১১ সালে রাজ্যের পালাবদলের পর থমকে গিয়েছিল পুরসভার কাজকর্মও। ২০১৩ সালে পুরভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার অনেক আগে থেকেই তাই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল ঝাড়গ্রাম এ বার হাতছাড়া হতে চলেছে বামেদের। এমনকী বামশূন্য পুরবোর্ড গড়ার দাবিও করছিলেন তৃণমূল নেতারা।
জয়ের উল্লাস
ভোটের ফল ঘোষণার পর ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজের সামনে ।
শেষমেশ, একেবারে বামশূন্য করা যায়নি ঝাড়গ্রামকে। সোমবার সকাল ১১টার মধ্যে ১৭টি ওয়ার্ডের ফল ঘোষণার পর দেখা যায় ১৬টিতে জয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ ভাবে পুরবোর্ডের দখল নিয়েছে তৃণমূল। রাজ কলেজের গণনাকেন্দ্রের বাইরে বাজি-পটকা ফাটিয়ে যখন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা উল্লাস করছেন, তখন বিজয়ী পক্ষের সেনাপতি তৃণমূলের জেলা সাধারণ সম্পাদক দুর্গেশ মল্লদেবের কানে-কানে নিচুগলায় এক পুলিশ অফিসার বলেন, “পরাজিত প্রার্থীরা গণনাকেন্দ্রের বাইরে বেরনোর সময় আপনাদের কর্মীরা যেন কিছু না করে, একটু দেখবেন।” দুর্গেশবাবু এক ঝলক মুহ্যমান বাম শিবিরের দিকে তাকিয়ে পুলিশ অফিসারকে আশ্বস্ত করলেন, “কেউ কিছু করবে না।”
কলেজ প্রাঙ্গণে তখন সপার্ষদ থমথমে মেঘকালো মুখে বসে রয়েছেন ‘পরাজিত সেনাপতি’। তিনি ঝাড়গ্রাম পুরসভার বিদায়ী পুরপ্রধান সিপিএমের শহর জোনাল সম্পাদক প্রদীপ সরকার। ঝাড়গ্রাম থানার আইসি জ্ঞানদেওপ্রসাদ সাহু প্রদীপবাবুকে আশ্বস্ত করেন, বাম প্রার্থী ও কাউন্টিং এজেন্টদের উপযুক্ত নিরাপত্তা দিয়ে গন্তব্যে ফেরানো হবে। আধ ঘণ্টা পরে সাড়ে এগারোটা নাগাদ সশস্ত্র পুলিশের প্রহরায় একটি ‘সবুজ’ বাসে ওঠেন প্রদীপবাবু-সহ বাম প্রার্থী ও কাউন্টিং এজেন্টরা। একলব্য স্কুলের রাস্তা দিয়ে ঘুরপথে প্রদীপবাবুদের সিপিএমের শহর জোনাল কার্যালয়ে সামনে পৌঁছে দেওয়া হয়। এ দিন সকালে শহর বামফ্রন্টের উদ্যোগে ওই বাসটি ভাড়া করেই গণনাকেন্দ্রে এসেছিলেন প্রদীপবাবুরা। ঘটনাচক্রে অরণ্যশহরে বাম বিদায়ের লগ্নটি প্রতীকী হয়ে রইল আমজনতার কাছে।
পুরভোটে ঝাড়গ্রাম
তথ্য বলছে, গত বিধানসভা ভোটেই অরণ্যশহরে সিপিএম তথা বামেদের ভোটব্যাঙ্কে ধস নেমেছিল। এক ধাক্কায় সিপিএমের ভোটের হার কমে দাঁড়িয়েছিল ৩৯ শতাংশে। আর এ দিন ফলপ্রকাশের পর প্রাথমিক ভাবে বামেদের আশঙ্কা, ভোটের হার আরও দশ শতাংশ কমে গিয়েছে। শহর বামফ্রন্টের আহ্বায়ক শিবনাথ গুহ বলছেন, “মানুষের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কর্মীদের দেওয়া প্রাক নির্বাচনী তথ্যে অনেক ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। সর্বোপরি পুরবাসীর গরিষ্ঠ অংশ বামপন্থীদের পুরসভায় আর দেখতে চাননি। এই ফল তারই প্রতিফলন।”
বিদায়ী পুরপ্রধান প্রদীপ সরকারের সঙ্গে করমর্দন করছেন ভাবী পুরপ্রধান দুর্গেশ মল্লদেব।
বাম কর্মীদের একাংশ অবশ্য মনে করছেন, টানা ৩১ বছর ক্ষমতায় থেকেও অরণ্যশহরে প্রত্যাশিত উন্নয়ন করতে বামেরা ব্যর্থতৃণমূলের এই প্রচারের মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি। শহরের বাস্তব অবস্থা দেখে মানুষ বামেদের আর বিশ্বাস করতে চায়নি। নতুন রাজ্য সরকার গত আড়াই বছর ধরে ‘বরাদ্দে বঞ্চনা করছে’বামেদের এই অভিযোগও ধোপে টেকেনি। গত বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের বিপুল জয়ের পরে (কেবলমাত্র বিনপুর বিধানসভাটি সিপিএম জয়ী হয়), পঞ্চায়েত ভোটেও জঙ্গলমহলের সর্বত্রই বামেরা কার্যত ধুয়ে যায়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জেলা পরিষদ, অধিকাংশ পঞ্চায়েত সমিতি ও পুরসভাগুলি তৃণমূলের দখলে এখন। কেবলমাত্র এতদিন জঙ্গলমহলের কেন্দ্রভূমি ঝাড়গ্রাম পুরসভাটি বামেদের দখলে ছিল। কয়েক দিন আগে পুর নির্বাচনী প্রচারে এসে বৃত্ত সম্পূর্ণ করার ডাক দিয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ তথা রাজ্য যুব তৃণমূলের সভাপতি শুভেন্দু অধিকারী। শুক্রবার সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। এ দিনই পূর্ব মেদিনীপুরের নিমতৌড়িতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মিনিকিট বিলি করতে এসে শুভেন্দু বলেন, “ঝাড়গ্রামকে আগে মাওবাদী প্রভাবিত এলাকা বলা হত। মাওবাদীরা ভোট বয়কটের ডাক দিতেন। সেই ঝাড়গ্রামের ৮১ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন, এটা গণতন্ত্রের জয়। মাওবাদীদের কাছেও এটা একটা বার্তা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় আসার পর মানুষ যে ভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন তা উল্লেখযোগ্য। আমাদের দলের পাশাপাশি বিরোধী প্রার্থীরাও জয়ী হয়েছেন। এটা প্রমাণিত হল যে, জঙ্গলমহলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”
ইন্দ্রপতন উত্থান
জনগণ আমাদের প্রত্যাখ্যান করেছে।
রায় মাথা পেতে নিলাম। তবে আগামী
দিনেও মানুষের পাশেই থাকব। নতুন
পুরবোর্ডের প্রতি শুভেচ্ছা রইল।
প্রদীপ সরকার (সিপিএমের বিদায়ী পুরপ্রধান)
এই জয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবং জনগণের।
পুরবাসী আমাদের গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন।
পুরবাসীকে ‘পরিচ্ছন্ন ঝাড়গ্রাম শহর’
উপহার দেওয়াটাই প্রধান কর্তব্য।
ঘনশ্যাম সিংহ, তৃণমূল প্রার্থী
সারা বছর এলাকার মানুষের পাশে
থেকেছি। এ ভাবে হেরে যাব ভাবিনি।
তাই খুবই খারাপ লাগছে। তবে
গণতন্ত্রে জনাদেশই তো শেষকথা।
পিরিল মুর্মু (বিদায়ী সিপিএম কাউন্সিলর)
এই জয় এলাকাবাসীর জয়। আমার ৮ নম্বর
ওয়ার্ডে দীর্ঘ কয়েক বছর কোনও উন্নয়ন
কাজ হয়নি। আগামী পাঁচ বছর তাই
কেবলই উন্নয়ন, উন্নয়ন আর উন্নয়ন।
সিদ্ধার্থ দুবে, তৃণমূল প্রার্থী
গড়-রক্ষা
সারা বছর মানুষের বিপদে আপদে তাদের
পাশে থাকি। মানুষ আমাকে সেই জন্যই
ভালবাসেন। এর প্রতিফলন নির্বাচনে
পড়ে। এই জয় আমাদের নেত্রীর জয়।
প্রশান্ত রায় (তৃণমূলের ঝাড়গ্রাম শহর সভাপতি)
৭৩ বছর বয়সে লড়াইটা কঠিন। দলের
কর্মীরা জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন।
আমি ওয়ার্ডের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে নেত্রীর
বার্তা পৌঁছে দিয়েছি। জয়ের রসায়ন এটাই।
আনন্দমোহন পণ্ডা (বিদায়ী বিরোধী দলনেতা)

ছবি: দেবরাজ ঘোষ

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.