|
|
|
|
তৃণমূল একা ১৩, বোর্ড গড়েও স্বস্তি নেই |
নিজস্ব সংবাদদাতা • মেদিনীপুর |
লড়াইটা কঠিন ছিল। অনেক কষ্টে শেষরক্ষা হল। মেদিনীপুর পুরসভার ২৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩টি-র দখল নিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে মান বাঁচাল তৃণমূল।
অন্য দিকে, বামেরা একবারে ধরাশায়ী। তবে এগিয়েছে কংগ্রেস। গত বারের ৪টি আসন ধরে রাখার পাশাপাশি তৃণমূলের দুই হেভিওয়েট প্রার্থীকে বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে আসন বাড়িয়ে নিয়েছে তারা। এ দিকে, একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেলেও তৃণমূল নেতৃত্ব স্বস্তিতে নেই। বিধায়ক তথা দলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চেয়ারম্যান মৃগেন মাইতি বলেন, “আমরা আশা করেছিলাম ন্যূনতম ১৬টি আসন পাব। কী ভাবে আসন কমল তা খতিয়ে দেখব। তবে পুর-বোর্ড ত্রিশঙ্কু হওয়ার ট্র্যাডিশন ভেঙে ফেলাও কিন্তু কম নয়।” |
|
পুরসভা তৃণমূলের। আনন্দে পথে নেমেছেন কর্মী-সমর্থকেরা। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ। |
বামফ্রন্টের এই অবস্থা কেন? সিপিএমের মেদিনীপুর শহর জোনাল কমিটির সম্পাদক কীর্তি দে বক্সীর (নিজেও হেরেছেন) সংক্ষিপ্ত জবাব, “অপ্রত্যাশিত। তৃণমূলের হাওয়া চলছে।” আর কংগ্রেসের জেলা সহ-সভাপতি এ বারও জয়ী কাউন্সিলর শম্ভু চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এ বারের ভোটেই প্রমাণ হয়ে গেল মানুষ তৃণমূলকে চায় না। তাহলে সন্ত্রাস ও বিপুল অর্থ ব্যয়ের মধ্যেও বিরোধীরা ১২টি আসন পেত না।” কংগ্রেসের সাফল্য প্রসঙ্গে দলের প্রদেশ নেতা তথা বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার বক্তব্য, “৪টি থেকে বেড়ে আমাদের আসন ৬টি হয়েছে। ফলাফল প্রমাণ করছে, মানুষের ভালবাসাই জিতেছে।”
সোমবার মেদিনীপুর কলেজে গণনা শুরু হয়েছিল সকাল ৮টা থেকেই। শহর জুড়ে টানটান উত্তেজনা। কলেজের বাইরে রাস্তার দু’দিকে সব রাজনৈতিক দলের কর্মীরা শিবির করে বসে। পুরসভার ওয়ার্ড ২৫টি। ইভিএমে ভোট হওয়ায় গণনায় বেশি সময় লাগেনি। সকাল ১১টা নাগাদই সব ওয়ার্ডের ফল ঘোষণা হয়ে যায়। তখনও ২৩, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের ফল বেরোয়নি। তৃণমূলের ঝুলিতে ১২টি আসন। আর কংগ্রেস-সিপিএম-বিকাশ পরিষদ-নির্দল মিলিয়ে ১১। হঠাৎ এক কংগ্রেস নেতা বললেন, “তৃণমূল যেন আর ১টা পেয়ে যায়।’’ তৃণমূলের হয়ে কংগ্রেস নেতার এমন প্রার্থনা কেন? জবাব মিলল তাঁর কাছেই, “তৃণমূল একক গরিষ্ঠতা না পেলে রাত থেকেই কাউন্সিলর ভাঙানো শুরু হয়ে যাবে। তখন দল বাঁচানোই কঠিন হবে।” শেষমেশ ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী জিতলেন। সব মিলিয়ে তৃণমূল পেল ১৩, কংগ্রেস ৬, বামফ্রন্ট ও বিকাশ পরিষদ মিলিয়ে ৫ আর নির্দল ১টি আসন। |
|
শহরের রাজাবাজারে জয়োল্লাস। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল। |
জেলার সদর শহরে এ বারের পুরভোট একক কোনও মাপকাঠিতে ভোট হয়নি। যেমন, ১১ নম্বর ওয়ার্ড। কংগ্রেস প্রার্থী ভোট পেয়েছেন মাত্র ৫২টি! বিজেপিও এখানে ৬৫টি ভোট পেয়েছে। বাম সমর্থিত বিকাশ পরিষদের প্রার্থী প্রাক্তন পুরপ্রধান নাজিম আহমেদ পেয়েছেন ১৩৪৩ ভোটে। তৃণমূল পেয়েছে ৯৩৭টি ভোট। আবার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএম প্রার্থী শম্ভু দিন্দা ভোট পেয়েছেন মাত্র ৬৯টি! যেখানে নির্দল প্রার্থী অরূপলাল পাত্রও ২৮টি ভোট পেয়েছেন। এখানে কংগ্রেস প্রার্থী শম্ভু চট্টোপাধ্যায় জয়ী হয়েছেন ১৩৯৯ ভোট পেয়ে। তৃণমূল প্রার্থী হিমাদ্রি খান ১২২৯ ভোট পেয়ে পরাজিত হয়েছেন। অর্থাৎ দল ছাপিয়ে অনেক ওয়ার্ডেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে প্রার্থীরা।
এ বার শহরের ১ লক্ষ ১৯ হাজার ৮৬৩ জন ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৯৬,৭৮৭ জন। তৃণমূল পেয়েছে ৩৮,৮৪৭টি ভোট (৪০.১৩%), বামফ্রন্ট-বিকাশ পরিষদ জোট পেয়েছে ২৩৩৪১টি ভোট (২৪.১১%)। আর কংগ্রেস পেয়েছে ১৮,৯৬২টি ভোট (১৯.৫৯%), বিজেপি ও নির্দল মিলে পেয়েছে ১৫,৬৩৭টি ভোট (১৬.১৫%)। কংগ্রেস বামেদের থেকে প্রায় ৫% কম ভোট পেয়েও একটি আসন বেশি পেয়েছে। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাক্তন তৃণমূল কাউন্সিলর মৃণাল চৌধুরীকে ১৮৩৫ ভোটে হারিয়েছেন কংগ্রেসের কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায়! আর ২০ নম্বর ওয়ার্ডে টানা কয়েকবারের কাউন্সিলর স্বপন চৌধুরীকে ৮১৩ ভোটে হারিয়ে দিয়েছেন কংগ্রেসের হিমাংশু মাইতি!
অনেকে আবার সামান্য ব্যবধানে হার মানতে পারছেন না। যেমন ২১ নম্বর ওয়ার্ডে দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর মণিলাল দাসের কাছে মাত্র ২৮ ভোটে হেরেছেন তৃণমূল প্রার্থী আশিস চক্রবর্তী। দাঁত ফোটাতে পারেননি বিক্ষুব্ধ প্রার্থীরাও। বিক্ষুব্ধ কাঁটা থাকা সত্ত্বেও জিতেছেন তৃণমূলের দলীয় প্রার্থীই। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন বিক্ষুব্ধরা। ২ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী নির্মাল্য চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন দলেরই ওয়ার্ড সভাপতি অসীম ধর। নির্মাল্য চক্রবর্তী ২০৩৭ ভোট পেয়েছেন। আবার অসীমবাবু দ্বিতীয় স্থান দখল করে ১৪৮১ ভোট পেয়ে। ৭ নম্বর ওয়ার্ডে শ্যাম ভকতের বিরুদ্ধে গণেশ ভকত প্রার্থী হয়েছিলেন। সেখানে শ্যামলবাবুর ১১৫১ ভোট পেলেও ৭১৮ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন গণেশবাবু। আর ৮ নম্বর ওয়ার্ডে শিপ্রা মণ্ডলের বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিলেন তৃণমূল নেতা শিবু পানিগ্রাহীর স্ত্রী সীমা পাণিগ্রাহী। এখানেও ১৮০৬ ভোট পেয়ে শিপ্রাদেবী প্রথম স্থানে থাকলেও ১৩০২ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান দখলে রেখেছেন সীমাদেবী। লড়াই করে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও বিক্ষুব্ধ হয়ে জয়ের শিখরে পৌঁছনো সহজ নয় তা বুঝে গিয়েছেন সকলেই। |
|
বামফ্রন্টের ক্ষেত্রে আবার উল্টো ঘটনা ঘটেছে। ৮ নম্বর ওয়ার্ডেই ফরওয়ার্ড ব্লক মৌসুমী মাইতিকে প্রার্থী করলেও ফরওয়ার্ড ব্লকেরই এক সময়ের দুঁদে নেতা অলোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায় বিক্ষুব্ধ হয়ে নির্দল হিসাবে দাঁড়ান। তিনি অবশ্য বাম প্রার্থীর থেকে ১১৬টি ভোট বেশি পেয়েছেন। মৌসুমীদেবী পেয়েছেন ৫২৮টি ভোট, সেখানে ভাস্বতীদেবীর প্রাপ্ত ভোট ৬৪৪।
গতবার ২৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১০টি ওয়ার্ড ছিল তৃণমূলের দখলে। কংগ্রেসের ৪টি, বাম-বিকাশ পরিষদ ৯ ও নির্দল একটি। এ বার তৃণমূল তিনটি আসন বাড়িয়ে ১৩য় পৌঁছেছে। সিপিএমের ৬টি (১, ৫, ১২, ১৮, ২৪, ও ২৫) ওয়ার্ড দখল করেছে তারা। উল্টোদিকে ৩টি ওয়ার্ড (৫, ১০, ১৭) খুইয়েছে তৃণমূল!
এখন এ সব অঙ্কে মাথা ঘামানোর সময় নেই তৃণমূল নেতাদের। এ বার লড়াই শুরু চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদ নিয়ে। |
ইন্দ্রপতন |
উত্থান |
পুলিশ-প্রশাসন তৃণমূলের হয়ে কাজ করেছে।
তাই হারতে হল। ভোটের আগে মানুষকে
মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রভাবিত না
করলে এমন ফল হত না।
এরশাদ আলি (কংগ্রেসের বিদায়ী উপ-পুরপ্রধান) |
মানুষের পাশে ছিলাম। মানুষ আমার উপর
আস্থা রেখেছেন। মানুষের মধ্যে কংগ্রেসকে
ঘিরে সুপ্ত আকাঙ্খা তৈরি হয়েছে।
ভোটের ফলে তারই ইঙ্গিত।
কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায়, কংগ্রেস প্রার্থী |
এই ফল আমার কাছে সত্যি অপ্রত্যাশিত।
মানুষের মন বুঝতে পারিনি। বুথ ভিত্তিক
পর্যালোচনা হবে। তখন ব্যাখ্যা মিলবে।
আমরা সব দিকই খতিয়ে দেখব।
কীর্তি দে বক্সী (সিপিএমের শহর জোনাল সম্পাদক) |
লড়াইটা সত্যিই কঠিন ছিল। সিপিএম
দীর্ঘ দিন ধরে এলাকায় কোনও উন্নয়ন
করেনি। মানুষ মুখ্যমন্ত্রী মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়ের
উন্নয়ন ও শান্তির বার্তায় আস্থা রেখেছেন।
জিতেন্দ্রনাথ দাস, তৃণমূল প্রার্থী |
গড়-রক্ষা |
মানুষ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর
আস্থা রেখেছেন। বিদায়ী বোর্ড যে ভাবে
উন্নয়ন করেছে, তাতে আস্থা রেখেছেন।
আমরা আরও কাজ করব।
প্রণব বসু (তৃণমূলের বিদায়ী পুরপ্রধান) |
এই জয় এলাকাবাসীকে উৎসর্গ করলাম।
অর্থ আর পেশিশক্তির বিরুদ্ধে মানুষ
ভোট দিয়েছেন। উন্নয়নমুখী পরিষেবায়
আস্থা রেখেছেন। আমি কৃতজ্ঞ।
নাজিম আহমেদ (বিকাশ পরিষদের প্রাক্তন পুরপ্রধান) |
|
পুরনো খবর: একা তৃণমূলের বোর্ড গড়া কঠিন |
|
|
|
|
|