লক্ষ লক্ষ টাকায় কেমোথেরাপি। আনুষঙ্গিক খরচের বহরও প্রায় তেমনই। তাই ক্যানসার হয়েছে জানামাত্র রোগী তো বটেই, তাঁর পরিবারের লোকের মাথাতেও আকাশ ভেঙে পড়ে। দুর্মূল্য ওষুধের কথা ভেবে। ক্যানসারের চিকিৎসায় মূল ওষুধগুলির প্রায় কোনওটিই এ দেশের নয়। তাই তার দাম খুব বেশি। বিদেশি ফর্মুলার কিছু কিছু ওষুধ এখন দেশের কয়েকটি সংস্থা তৈরি করে ঠিকই। কিন্তু তার দামও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের নাগালে থাকে না।
এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় মাত্র একটিই পথ দেখছেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের বক্তব্য, দেশীয় সংস্থাগুলি যদি বেশি করে ক্যানসারের ওষুধ তৈরিতে এগিয়ে আসে, একমাত্র তা হলেই দামের ক্ষেত্রে খানিকটা স্বস্তি মিলবে। এটা যে অসম্ভব নয়, তার উদাহরণ হিসেবে ফুসফুসের ক্যানসার চিকিৎসায় একটি দেশীয় সংস্থার তৈরি কম খরচের নতুন ওষুধের কথা বলছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্তারা।
সংস্থাটি আমদাবাদের। ফুসফুসের ক্যানসারের চিকিৎসায় তারা নতুন একটি ইঞ্জেকশনটি বাজারে আনছে। সেটি দিতে হবে কেমোথেরাপির সঙ্গে। ৪০ হাজার টাকায় মিলবে ১০টি ইঞ্জেকশন। অর্থাৎ মাত্র চার হাজার টাকায় একটি। এটা বাজারচলতি বিদেশি ইঞ্জেকশনের দামের ১০ ভাগের এক ভাগ। প্রস্তুতকারক সংস্থার কর্তাদের দাবি, এই ইঞ্জেকশন নিলে কেমোথেরাপির কাজ তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই ভাল হবে এবং রোগীর আয়ু অন্তত তিন মাস বাড়বে। ওই সংস্থার চেয়ারম্যান রাজীব মোদী বলেন, “এটি মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশ কিছুটা বাড়িয়ে দিতে পারে। যক্ষ্মার একটি জীবাণু থেকে তৈরি এই ওষুধের গবেষণায় আমরা বহু বছর ব্যয় করেছি। গবেষণা খাতে খরচ হয়েছে কয়েকশো কোটি টাকা।” দেশের বাজার ধরার পরে আমেরিকা, ইউরোপ এবং জাপানেও তাঁরা ওষুধটি বিক্রির পরিকল্পনা করছেন বলে জানান রাজীব।
শুধু প্রস্তুতকারক সংস্থার দাবি নয়। দেশীয় ওষুধ সংস্থাগুলি গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ালে তার ফল কতটা সুদূরপ্রসারী হতে পারে, ফুসফুসের ক্যানসার চিকিৎসায় কম খরচের ওই নতুন ওষুধই তার প্রমাণ বলে মনে করছে চিকিৎসক মহলও। দিল্লিতে তিন দিন ধরে ক্যানসার চিকিৎসক সম্মেলন চলছে। ক্যানসারের ওষুধের ক্রমবর্ধমান দামের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে সেখানেও। চিকিৎসকেরা মানছেন, ওষুধের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকায় ক্যানসারের চিকিৎসা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দেশীয় সংস্থাগুলি ওষুধ গবেষণায় মন দিলে সেটাই দেশবাসীর কাছে বড় আশীর্বাদ হয়ে উঠবে বলে তাঁদের অভিমত। তাঁদের বক্তব্য, ক্যানসারের মতো মারণ রোগের চিকিৎসায় দেশীয় ওষুধ সংস্থাগুলির উচিত গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো। আমদাবাদের সংস্থাটি সেই কাজ করে পথ দেখাচ্ছে বলে মনে করছে চিকিৎসক মহল।
অর্থাৎ চাইলে দেশীয় সংস্থাও ক্যানসারের চিকিৎসায় সুলভ ওষুধ জোগাতে পারে। তা সত্ত্বেও ওই ওষুধ ব্যতিক্রম হয়েই থেকে যাচ্ছে কেন?
ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “ওষুধ আবিষ্কারের জন্য নিরন্তর গবেষণা চালাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়। তাই দেশীয় সংস্থাগুলি তাতে খুব বেশি উৎসাহী হয় না। তাদের সেই অনীহারই খেসারত দেন আমাদের গরিব রোগীরা। দেশীয় সংস্থা যত দিন না ওষুধ তৈরি করছে, তত দিন ওষুধের দাম কমার সম্ভাবনা নেই।”
এ দেশের যে-ক’টি প্রতিষ্ঠানে আমদাবাদের ওই সংস্থার ওষুধটির ট্রায়াল বা প্রয়োগ-পরীক্ষা চালানো হয়েছিল, কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতাল তার অন্যতম। সেখানকার ক্যানসার বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান অনুপ মজুমদার বলেন, “দেশীয় সংস্থা এগিয়ে এলে ওষুধের দাম তো কমেই। সেই সঙ্গে বিদেশের বাজারে এ দেশের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে সেটা ভাবলেও যথেষ্ট তৃপ্তি হয়।”
দেশীয় সংস্থাগুলি যথেষ্ট সংখ্যায় গবেষণায় এগিয়ে আসছে না কেন?
ওষুধ সংস্থাগুলির একটা বড় অংশ এ ব্যাপারে সরকারি অসহযোগিতাকে দায়ী করেছে। মুম্বইয়ের একটি সংস্থার কর্তার কথায়, “শুধু গবেষণায় টাকা ঢাললেই তো হবে না। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও তো চালাতে হবে। সেই ট্রায়ালের উপরে এখন নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা। প্রতি পদে ধাক্কা খেতে হয়। তাই অনেকেই এ ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছেন না।” বেঙ্গালুরুর একটি সংস্থার কর্তার বক্তব্য, গবেষণায় বেশি টাকা ঢালতে হলে ওষুধের দাম খুব কম রাখা যায় না। তবু দেশে তৈরি ওষুধের দাম বিদেশি ওষুধের তুলনায় যথেষ্টই কম থাকে। কিন্তু দাম আরও কমাতে সরকারি তরফে নানা ভাবে চাপ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, “একটা কথা বুঝতে হবে, আমরা কিন্তু কেউ দাতব্য করতে বাজারে আসিনি।” দিল্লির একটি সংস্থার কর্তা বলেন, “আমাদের মতো বেশ কয়েকটি সংস্থা ক্যানসারের ওষুধ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে কয়েক ধাপ এগিয়েও থমকে রয়েছে সরকারি সহযোগিতার অভাবে।”
তবে ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়া জি এন সিংহ এই সব অভিযোগ মানতে চাননি। তিনি বলেন, “ওষুধের দাম কমার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ঠিকই। তবে একই সঙ্গে ওষুধের মানের বিষয়টিও খেয়াল রাখা জরুরি।
অনেক ক্ষেত্রেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নামে যথেচ্ছাচার চলে। সেটা কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা যায় না। তাই ছাড়পত্র দেওয়ার আগে সতর্ক থাকতে হয় আমাদেরও।” |