ভাড়া করা ছোট ভ্যান কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ি নয়। পাচারকারীরা বেছে নিচ্ছে যাত্রিবাহী বাস। কারণ পাচারের পণ্য ধরা পড়লেও পাচারকারীর ধরা পড়ার সম্ভবনা অনেক কমে যায়। যাত্রীদের ভিড়ে মিশে থাকা যায় অনায়াসে।
চেনা ছক থেকে এ ভাবেই বেরিয়ে আসছে পাচারকারীরা। সম্প্রতি মুর্শিদাবাদ সীমান্তে বেশ কয়েকজন পাচারকারী ও পাচার চক্রের পাণ্ডা ধরা পড়েছে পুলিশের জালে। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে ২০ হাজার বোতল ফেনসিডিল ও ৫০ কিলোগ্রাম গাঁজা। এই ঘটনার পরেই পাচারকারীরা তাদের কৌশল বদলাচ্ছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানতে পেরেছে প্রশাসন।
প্রশাসন সূত্রে খবর, মুর্শিদাবাদ সীমান্তের ডোমকল মহকুমায় এমন কড়াকড়ি শুরু হতেই পাচারকারীরা সাময়িকভাবে পড়শি জেলা নদিয়ার সীমান্তকে পাচারের জন্য বেছে নিতে পারে। কারণ শীতকালের কুয়াশার আড়ালটা তারা কোনওভাবেই নষ্ট করবে না। পাশাপাশি ভাড়ার ছোট ভ্যান বা ব্যক্তিগত গাড়ির বদলে যাত্রীবাহী বাসকেই বেছে নিচ্ছে তারা। কারণ সেখানে পাচারের দ্রব্য আটক হলেও পাচারকারীর ধরা পড়ার সম্ভবনা খুবই কম থাকে। পাচারের ক্ষেত্রে বড় বস্তা বা কাগজের বাক্সের বদলে ব্যবহার করা হচ্ছে ছোট ব্যাগ। আর এই খবর পাওয়ার পরেই নড়েচড়ে বসেছে বিএসএফ ও প্রশাসনের কর্তারা। নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ, পড়শি এই দুই সীমান্তবর্তী জেলায় পাচারের ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে ইদানীং পুলিশ ও বিএসএফকে বেশি করে ভাবাচ্ছে পাচারের পরিবর্তিত কৌশল।
ডোমকলের এসডিপিও অরিজিৎ সিংহ বলেন, “গত দু’মাসে ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা বাজেয়াপ্ত করার পাশাপাশি বেশ কয়েকজন পাচারকারী ও পাচার চক্রের পাণ্ডাকে ধরা হয়েছে। আমাদের কাছে খবর, এই পরিস্থিতিতে পাচারকারীরা সাময়িকভাবে মুর্শিদাবাদ বাদ দিয়ে নদিয়ার সীমান্ত বেছে নিতে পারে। সেই মতো নদিয়া পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।”
তেহট্টের এসডিপিও সুনীল সিকদার বলেন, “তেহট্ট, করিমপুর সীমান্তে কাঁটাতার থাকায় গত কয়েক বছর ধরে পাচার অনেকটাই কমে গিয়েছে। তবে ছোট কোনও কিছু তারকাঁটার উপর দিয়ে ছুঁড়ে বা বিশেষ কোনও পদ্ধতিতে ওপারে পাচার করে দেওয়া হয় বলে শুনেছি। ডোমকল সংলগ্ন এলাকার থানাগুলির সঙ্গে কথা বলে পাচারকারীদের নতুন পথ যাতে বন্ধ করা যায় সে বিষয়েও আলোচনা করা হচ্ছে। সীমান্তের থানাগুলিকে সতর্ক করার পাশাপাশি প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে বিএসএফের সঙ্গেও।”
এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন বাসের মালিক ও বাসকর্মীরাও। করিমপুর বাস মালিক সংগঠনের সম্পাদক চিন্ময় বিশ্বাস বলেন, “বাসে কত লোকজনই তো ওঠে। সঙ্গে মালপত্রও থাকে। ফলে আমাদের পক্ষেও বোঝা মুশকিল কে যাত্রী আর কে পাচারকারী। তবুও বাসের কর্মীদের সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে।”
জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, নদিয়া সীমান্তের বেশিরভাগ এলাকাতেই রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া। ফলে এই সীমান্ত দিয়ে ছোট কোনও জিনিস পাচার হলেও গবাদি পশু পাচার করা কঠিন। কিন্তু মুর্শিদাবাদের সিংহভাগ এলাকাতে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে পদ্মা। ফলে ছোট জিনিসের পাশাপাশি কাঁটাতারবিহীন এই সীমান্তে একসময় গরু পাচার ছিল প্রায় রোজদিনের ঘটনা। কিন্তু এখন সেই চেনা ছক থেকে বেরিয়ে আসছে পাচারকারীরা। আর আগে থেকে সেই ছকটা জানতে পারাই এখন পুলিশ ও বিএসএফের কাছে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
বিএসএফের ৯১ ব্যাটালিয়নের এক কর্তা বলছেন, “ঋতু পরিবর্তন ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সীমান্তে বদলে যায় পাচারের ধরণও। তুলনামূলকভাবে শীতে পাচারকারীরা বেশি সক্রিয় হয়। কারণ কুয়াশার সঙ্গে মোকাবিলা করার মতো অত্যাধুনিক যন্ত্র এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে নেই। আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগায় চোরাপাচারকারীরা।” বিএসএফের ওই কর্তার সংযোজন, “তবে নদিয়া মুর্শিদাবাদ যে সীমান্তই হোক না কেন সীমান্তে এই সময় সতর্কতা ও নজরদারি দুই-ই বাড়ানো হয়। বাড়ানো হয় জওয়ানের সংখ্যাও।”
শীত এবং কুয়াশা দুটোকেই তাই সমঝে চলতে হয়। এই সময় পাচারকারীরা যাতে সক্রিয় হতে না পারে সে জন্য সতর্ক থাকে পুলিশ ও বিএসএফ। আবার ঘন কুয়াশার আড়ালকে কাজে লাগিয়ে তক্কে তক্কে থাকে পাচারকারীরাও। তার জন্য কখনও বদলে যায় পাচারের পথ, কখনও পন্থা। |