সেচের নলকূপে পাম্প বসানোর আগে সরকারি অনুমতি নেওয়ার পাট আগেই চুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ বার তার সঙ্গে জুড়েছে অগভীর সেচ-নলকূপের বৈদ্যুতিন পাম্পে ভর্তুকিদানের সিদ্ধান্ত।
রাজ্য সরকারের দাবি, এই দুই পদক্ষেপের দরুণ কৃষকেরা যথেষ্ট উপকৃত হচ্ছেন। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে কৃষি-পণ্যের উৎপাদন বাড়ছে, নাগরিকের খাদ্য-নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হলে যা অতীব জরুরি। কিন্তু অশনি সঙ্কেত দেখছেন জল-বিজ্ঞানীদের একাংশ। তাঁদের মতে, সরকারের এ হেন সিদ্ধান্তের ফলে যথেচ্ছ নলকূপ বসিয়ে ভূগর্ভের জল তোলার রাস্তা খুলে যাচ্ছে। ততে মাটির তলার জলস্তরে ভারসাম্য যেমন বিপন্ন হবে, তেমন আর্সেনিক ও ফ্লুওরাইড দূষণের মাত্রাও বাড়বে বলে ওঁদের আশঙ্কা। রাজ্যের কৃষি-কর্তারা অবশ্য আশঙ্কায় আমল দিচ্ছেন না। তাঁরা জানিয়েছেন, বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েই সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সেচের জলের সংস্থানে অগভীর নলকূপ বসাতে ইচ্ছুক চাষিদের আর্থিক সহায়তা দিতে চাইছে রাজ্য। তাই কৃষি দফতর স্থির করেছে, নলকূপে লাগানোর জন্য পাঁচ অশ্বশক্তি পর্যন্ত ক্ষমতার বিদ্যুৎচালিত পাম্পসেট কিনলে কৃষকেরা সেটপিছু ১০ হাজার টাকা ভর্তুকি পাবেন। টাকাটা সরাসরি পৌঁছে যাবে তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। দফতরের তথ্য, চলতি বছরের গোড়ায় নয়া ব্যবস্থা চালু হওয়া ইস্তক ৬০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, ভর্তুকির টাকায় এই প্রায় এক বছরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের চাষ-জমিতে অন্তত ৬০ হাজার অগভীর নলকূপ বসে গিয়েছে। |
ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহারে রাশ টেনে আর্সেনিক ও ফ্লুওরাইড দূষণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে ২০০৫-এ পশ্চিমবঙ্গ ভূগর্ভস্থ জল (নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণয়ন করেছিল তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার। তাতে বলা হয়েছিল, নলকূপের মাধ্যমে চাষের জল তোলার জন্য পাম্পসেট বসাতে গেলে বিদ্যুৎ দফতরের কাছে আবেদন করতে
হবে। বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা আবেদন খতিয়ে দেখে আলাদা মিটার-সহ পাম্পে বিদ্যুতের লাইন দেবে। কিন্তু রাজ্যের বর্তমান সরকার গত বছর আইনটি শিথিল করে বিদ্যুৎ দফতরের অনুমতির প্রসঙ্গটি পুরোপুরি রদ করে দিয়েছে। তার উপরে এখন পাম্প কিনতে ভর্তুকির উৎসাহ আসায় ভূগর্ভের সঙ্কট গভীরতর হবে বলে মনে করছেন জল-বিজ্ঞানীদের অনেকে।
কী বলছেন তাঁরা?
ওঁদের দাবি: জল নিয়ন্ত্রণ আইনের কড়াকড়িতে কিছুটা কাজ হয়েছিল। ২০১২-র এপ্রিলে বিদ্যুৎ-অনুমতির বাঁধন খুলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত রাজ্যে সেচ-নলকূপের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো কমে গিয়েছিল। কিন্তু মূল ধারাটিই এ ভাবে ‘সংশোধিত’ হয়ে যাওয়ায় আইন রাখার আর কোনও মানে রইল কি না, বিশেষজ্ঞদের অনেকে সে প্রশ্ন তুলেছেন। কেন্দ্রীয় ভূ-জল নিগমের প্রাক্তন অধিকর্তা তথা রাজ্যের ফ্লুওরাইড টাস্ক ফোর্সের সদস্য শ্যামাপ্রসাদ সিংহরায়ের কথায়, “বছর আটেক আগের ওই আইন তৈরির প্রক্রিয়ায় আমি যুক্ত ছিলাম। বিভিন্ন জেলায় ভূগর্ভস্থ জলস্তরের হাল দেখে আমরা মনে করেছিলাম, এমন একটা আইন কার্যকর করা অত্যন্ত জরুরি। অথচ এখন তার আসল অস্ত্রটাই ভোঁতা হয়ে গিয়েছে।” |
অবাধ জলদান |
• পাম্পপিছু ভর্তুকি ১০ হাজার টাকা* |
• দেওয়া হয়েছে ৬০ কোটি টাকা† |
• নলকূপ বসেছে ৬০ হাজার† |
* অগভীর সেচ-নলকূপে ৫ অশ্বশক্তি পর্যন্ত ক্ষমতার বৈদ্যুতিন পাম্পসেট।
† চলতি বছরের গোড়া থেকে। |
|
ফলে রাজ্যের পাতাল জলভাণ্ডার ফের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে বলে শ্যামাপ্রসাদবাবুর আশঙ্কা। অন্য দিকে সরকারি অবস্থানের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে রাজ্যের কৃষি-সচিব সুব্রত বিশ্বাসের দাবি: নলকূপের পাম্পে অনুমতির নিয়ম প্রত্যাহার আর পাঁচ হর্সপাওয়ার পর্যন্ত ক্ষমতার পাম্পে দশ হাজার টাকা করে ভর্তুকির ব্যবস্থায় রাজ্যে সেচের সুবিধা বেড়েছে। যে কারণে এ বার সেচনির্ভর বোরো চাষের এলাকা সম্প্রসারিত হয়েছে। “পূর্ববর্তী বছরে যেখানে পশ্চিমবঙ্গে সাড়ে বারো লক্ষ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছিল, সেখানে এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছে ১৪ লক্ষ হেক্টর।” বলেছেন সচিব।
অর্থাৎ কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন হয়তো কিছুটা বাড়বে। তা সত্ত্বেও পরিবেশ-ক্ষেত্রে আসন্ন বিপদের দিকটা লঘু করে দেখতে পারছেন না রাজ্যের আর্সেনিক টাস্ক ফোর্সের প্রথম চেয়ারম্যান শ্যামাপ্রসাদবাবু। তিনি বলছেন, “সরকারি উৎসাহে মাটির নীচ থেকে বিরামহীন জল তোলা হলে আর্সেনিক ও ফ্লুওরাইড দূষণ মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। ভূগর্ভের ভারসাম্যও নষ্ট হওয়ার প্রভূত আশঙ্কা। মাথায় ঢুকছে না, কেন এই বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত।”
বস্তুত পরিবেশের বিপদ সে ভাবে যাচাই না-করে মূলত ফলনবৃদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার এই পথে হেঁটেছে বলে অভিযোগ উঠছে বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞ মহলে। পশ্চিমবঙ্গের আর্সেনিক টাস্ক ফোর্স ও ফ্লুওরাইড টাস্ক ফোর্সের সদস্যদের একাংশের দাবি, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকার তাঁদের সঙ্গে কোনও আলোচনা করেনি। “এক দিকে সরকার আর্সেনিক ও ফ্লুওরাইড দূষণ নিয়ন্ত্রণে টাস্ক
ফোর্স গড়ছে। অন্য দিকে তাদের অগোচরে নিজেরাই ভূগর্ভস্থ জল তোলার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে
নিচ্ছে! খুবই দুর্ভাগ্যজনক। তা হলে টাস্ক ফোর্স রাখার অর্থ কী?” আক্ষেপ করেছেন এক জল-বিজ্ঞানী।
সরকারের কী বক্তব্য?
ভূগর্ভস্থ জলস্তরে সরকারি সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা খারিজ করে দিয়েছেন কৃষি-সচিব। তাঁর যুক্তি, রাজ্যের জল অনুসন্ধান আধিকারিক (সুইড)-এর কাছ থেকে যথাযথ
তথ্য নিয়েই সব কিছু করা হয়েছে। সুইডের তথ্যানুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের ভূগর্ভে জলস্তরের অবস্থা সন্তোষজনক। উপরন্তু চলতি বছরের ব্যাপক বৃষ্টিপাতে পরিস্থিতির প্রভূত উন্নতি হয়েছে। “সারা রাজ্যে পুকুর, দিঘি টইটম্বুর।
তা ছাড়া খাদ্য-সুরক্ষা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের তাগিদও তো রয়েছে!” মন্তব্য সুব্রতবাবুর।
কিন্তু বেশি বৃষ্টি হলেই মাটির নীচের জলভাণ্ডার ফুলে-ফেঁপে উঠবে, এ হেন তত্ত্ব পুরোপুরি মানতে নারাজ বিজ্ঞানীরা। কেন?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গবেষকদের বক্তব্য: রাজ্যের সর্বত্র বৃষ্টির জল সমান ভাবে ভূগর্ভে গিয়ে মেশে না। অনেক জায়গায় তা পুরোপুরি নষ্ট হয়, খালবিল-নদীনালা বেয়ে চলে যায় সমুদ্রে। বৃষ্টির জল
ধরে পাতালে চালান করার বন্দোবস্ত সে ভাবে গড়ে ওঠেনি। উপরন্তু জলস্তর কোথায় কখন কেমন থাকে, কার্যত
সে সম্পর্কেও কোনও বৈজ্ঞানিক
তথ্য এ রাজ্যে মজুত নেই, জল উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নিতে হলে যা থাকা একান্ত প্রয়োজন।
অতএব, ভূগর্ভে বিপর্যয়ের আশঙ্কা একটা থেকেই যাচ্ছে। |