কবীর সুমন বাংলা ভাষায় খেয়াল পরিবেশন করার পক্ষে সওয়াল করেছেন। (সাক্ষাত্কার ৯ -১১ ) তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি শুনেছি, অল ইন্ডিয়া রেডিও বাংলা ভাষার খেয়ালকে স্বীকার করেননি বলে আচার্য তারাপদ চক্রবর্তী একটি বড় রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। ...আমি তো রাগের একটা রূপ প্রতিষ্ঠা করছি, বিস্তার করছি, রাস্তা খুঁজছি। তাতে ভাষাতে কী আসে যায় ! ভাষা যদি না -ই থাকে শুধু সরগম তাতে ঠেকাচ্ছে কে?’
সংগীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তী ছাড়াও বাংলা ভাষায় খেয়াল পরিবেশন করার জন্য অল ইন্ডিয়া রেডিও -র সঙ্গে আরও এক জন সংগীতগুণীর চরম সংঘাত হয়েছিল। বিষ্ণুপুর ঘরানার সেই সংগীতজ্ঞ গুণীর নাম সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। আচার্য গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভ্রাতুষ্পুত্র। |
সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণদিবসে তাঁর পুত্র অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়,
তাঁর পুত্র ও পৌত্র। ২০০২। ছবি: অশোক মজুমদার। |
ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের (তখনও আকাশবাণী নাম হয়নি ) প্রথম বেতার অনুষ্ঠানটি করেন আচার্য সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর থেকে নিয়মিত শিল্পী হিসেবে ধ্রুপদ ধামার খেয়াল -সহ সেতারবাদন পরিবেশন করতে থাকেন। ১৯৬২ সালের মার্চ মাসে বিকেলের অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষায় মূলতান রাগে খেয়াল পরিবেশন নিয়ে আকাশবাণী বা অল ইন্ডিয়া রেডিও -র কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর চরম সংঘাত বাধে। সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘সুরের পথে একটি জীবনে’ লিখেছেন, “বেশ কিছু দিন ধরেই আমি মনে করছিলাম শাস্ত্রীয় সংগীতের শ্রেণিগত গান নিজেদের মাতৃভাষায় গাওয়ার একান্ত প্রয়োজন আছে। এর দ্বারা সাধারণ শ্রোতাদের ভাষার ভাব বুঝতে পেরে এই সব গানে তাদের মনকে আকৃষ্ট করবে এবং ক্রমশ শোনার আগ্রহ ও অনুরাগ বাড়বে। “তার পর বাংলা খেয়াল গাওয়ার ব্যাপারে আমার সঙ্গে বেতার কর্তৃপক্ষের যে কাণ্ড ঘটে গেল, কর্তব্য ও আদশের্র উপর সংঘর্ষ বেধেছে খবর জানতে পেরে ‘আনন্দবাজার’ ও ‘যুগান্তর’ পত্রিকার প্রতিনিধিরা এসে আমার কাছ থেকে চিঠিপত্রের আদানপ্রদান ও কাগজপত্র সমস্ত নিয়ে গিয়ে তাঁদের পত্রিকায় আমার পক্ষ অবলম্বন করে প্রচণ্ড ভাবে লেখালেখি আরম্ভ করলেন বেতার কর্তৃপক্ষের অযৌক্তিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে।
“আনন্দবাজার পত্রিকার ‘তির্যকে’ আমার চেহারাটাকে ধরে বাঁ হাতটার আগাগোড়া ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রেখে এবং মাথার উপর মারের চোটে বলের মতো ফুলিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে পথিকের প্রশ্নের উত্তরে লেখা ছিল ‘বাংলা খেয়াল গাইব বলেছিলাম তাই ...।’ পশ্চাতের দোতলা বারান্দায় একটি কোট -প্যান্ট পরা সভ্যমূর্তি এঁকে তার হাতে মস্ত এক লাঠি উঁচিয়ে ধরা অবস্থায় ছিল এবং সেই দোতলা বাড়ির মাথায় লিখে দেওয়া হয়েছিল‘আকাশবাণী’।”
সহজে দমবার পাত্র ছিলেন না প্রখর আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষটি। কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন বাংলা ভাষায় খেয়াল পরিবেশনের অধিকার আদায়ের জন্য। মাতৃভাষায় খেয়াল পরিবেশনের দাবিতে রেডিও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সেই মামলার রায় সংগীতাচার্যের পক্ষে যায়নি। এটি বড় কথা নয়। বিচার্য হল তাঁর চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা। ভারতের সংগীত ইতিহাসে এই ঘটনাটি সম্ভবত এখনও অদ্বিতীয়।
খেয়াল গানে ভাষা প্রসঙ্গে আরও একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। গ্বালিয়রের ঘরানার অনেক বন্দিশ পঞ্জাবি ভাষায় রচিত, যা এখনও ওই ঘরানার গুণীরা গেয়ে থাকেন। সদারঙ্গ বা নিয়ামত খানেরও পঞ্জাবি ভাষায় রচিত বন্দিশ আছে। টপ্পার জনক শোরি মিঞার ভাষাও তো পঞ্জাবি।
জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। অরবিন্দনগর, বাঁকুড়া
|
একটি প্রতিবেদনের (‘পথ দুর্ঘটনা ঘিরে দুই থানার মধ্যে বচসা...’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪-১০) এক জায়গায় লেখা হয়েছে, ‘...ওই থানার কর্মীরা দুই চালকের বিবাদ মিটিয়ে (তাদের) চলে যেতে বলেন। ...গাড়ি আটক করা হবে নাকি ছেড়ে দেওয়া হবে, এই নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। রাস্তায় তখন বেবাক দাঁড়িয়ে দুই গাড়িচালক।’
‘বেবাক’ শব্দটির প্রয়োগ নিয়েই এই পত্রের অবতারণা। যেহেতু ‘বেবাক’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ এখানে কোনও ভাবেই খাটে না। এ ক্ষেত্রে শব্দটি সম্ভবত ‘নির্বাক’ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ ওই অর্থই এই জায়গায় প্রাসঙ্গিক। কিন্তু ‘বেবাক’ শব্দটি ফারসি ও আরবির মিশ্রণ। এর প্রকৃত অর্থ সম্পূর্ণত, পুরোপুরি, একদম, বিলকুল। যেমন গরুতে ভাতটা ‘বেবাক’ খেয়ে ফেলেছে; কথাটা ‘বেবাক’ ভুলে গেছি; ছুরির ফলাটা ‘বেবাক’ মৃতদেহের পিঠে বসে গেছে ইত্যাদি। ‘নির্বাক’ শব্দের ‘বাক’ (সংস্কৃত) অর্থ কথা, কিন্তু ‘বেবাক’ শব্দের ‘বাক’ (আরবি) অর্থ বাকি।
শব্দের ভ্রান্ত প্রয়োগ অধুনা ভূরি ভূরি চোখে পড়ে। এর ফলে ভুলটাই স্বীকৃতি পেতে থাকে। আর একটি ভ্রান্ত প্রয়োগের নিদর্শন: ‘ব্যাপক’। এই ভ্রান্তির প্রয়োগ আরও ‘ব্যাপক’ অর্থাত্ বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র ‘ব্যেপে’ (বা জুড়ে) থাকে বলেই তা ‘ব্যাপক’। সেই ‘ক্ষেত্র’, স্থান কাল বা বিষয়ও হতে পারে। ‘খিদিরপুরে ব্যাপক বোমাবাজি হচ্ছে’, অর্থাত্ খিদিরপুরে (বিস্তীর্ণ এলাকা ‘জুড়ে’) বোমাবাজি হচ্ছে। কিন্তু অনেকেই ধরে নেন, ‘খিদিরপুরে ‘প্রচণ্ড’ বোমাবাজি হচ্ছে’। দূরদর্শনে সংবাদপাঠকরাও প্রায়ই ‘প্রচণ্ড’ অর্থেই ‘ব্যাপক’ ব্যবহার করেন।
আর একটি দৃষ্টান্ত: ‘বেপথু’। এর অর্থ শিহরন। কিন্তু দশচক্রে শব্দটির অর্থ দাঁড়িয়েছে ‘পথভ্রষ্ট’। অথচ এমনটি না হওয়া কিন্তু নিতান্তই সহজ। শুধু অভিধানটির একটু পাতা ওলটালেই সমস্যা ফরসা হয়। তবে, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিড়াল’-এর অনুসরণে বলা যায়, ...কিন্তু বাঙ্গলা শব্দের জন্য অভিধান পড়িয়া দেখা ‘ছিঃ! কে করিবে?’ আর, বাংলা ভাষার অভিধান বাড়িতে রাখেই বা ক’জন? কারণ, আমরা যে বাংলা বলি, লিখি, পড়ি বাংলা জানতে আমাদের কি কিছু বাকি আছে?
রণেশচন্দ্র রায়চৌধুরী। কলকাতা-৪০ |