রাত ৯টা ১০: কলকাতা স্টেশনে সবে ঢুকেছে হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস। প্রায় শুনশান স্টেশন চত্বরে তখন রয়েছে শুধু ট্যাক্সি। এক যাত্রী তাঁর অসুস্থ আত্মীয়কে নিয়ে যেতে চাইছিলেন বেলেঘাটা। কিন্তু ট্যাক্সিচালকেরা জানালেন, মিটারে যাবেন না। ৩০০ টাকা দিতে হবে। ততক্ষণে প্রি-পেড ট্যাক্সি বুথে যাত্রীদের লম্বা লাইন পড়ে গিয়েছে। কয়েকটি বাস সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও কোনওটিই যাবে না। বাধ্য হয়ে অসুস্থ আত্মীয়কে নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে দিয়েই শ্যামবাজার মোড়ের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন ওই যাত্রী।
রাত ৯টা ৪০: কলকাতা স্টেশনে ঢুকল লালগোলা প্যাসেঞ্জার। ধীরে ধীরে যাত্রীদের সমস্যা আরও বেশি তীব্র হয়ে উঠছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে এসেছে ট্যাক্সি। অথচ প্রি-পেড বুথে লাইন কমেনি। এ বার মুশকিল আসান হিসাবে হাজির কয়েকটি অটো। তবে অটোচালকেরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, রিজার্ভ ছাড়া যাবেন না। উল্টোডাঙা পর্যন্ত যেতে লাগবে ১০০ টাকা। অগত্যা লটবহর নিয়ে বহু যাত্রী হাঁটা লাগালেন শ্যামবাজারের দিকে।
কলকাতা স্টেশনের যাত্রী-দুর্ভোগের হালটা অনেকটা এমনই। মাস তিনেক আগে কলকাতা ট্রাফিক পুলিশ পরিচালিত প্রি-পেড ট্যাক্সি বুথ চালু হওয়ার পরে স্টেশন চত্বরে ট্যাক্সিচালকদের ‘জুলুম’ কিছুটা কমলেও দুর্ভোগ সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে বলে যাত্রীদের অভিযোগ। |
ট্যাক্সি বুথের সামনে এটাই চেনা ছবি। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য। |
কেন এই অবস্থা? শহরের অন্য গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন, যেমন হাওড়া বা শিয়ালদহের মতো এখানে হকার সমস্যা নেই। নেই আবর্জনা জমে থাকার সমস্যাও। কিন্তু ঝকঝকে এই স্টেশনের প্রধান সমস্যা পরিবহণ। যাত্রীদের মতে, শুধু একটি প্রি-পেড ট্যাক্সি বুথ খুলে এই সমস্যা মেটানো সম্ভব নয়। সমস্যা সমাধানে দরকার পর্যাপ্ত বাস ও অটো চালু করা। নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ, কলকাতা স্টেশনে বাস ও অটো কার্যত মেলে না। বাস ধরতে গেলে ভরসা সেই আর জি কর বাসস্ট্যান্ড বা শ্যামবাজার। ট্যাক্সিতে যাওয়ার সামর্থ্য না থাকলে মালপত্র নিয়ে যাত্রীদের যেতে হচ্ছে কমপক্ষে আর জি কর পর্যন্ত। রাতে ওই রাস্তা মহিলাদের পক্ষে কতটা নিরাপদ, উঠছে সে প্রশ্নও।
লালগোলা প্যাসেঞ্জারে মাঝেমধ্যেই ব্যবসার কাজে লালগোলা যান হাতিবাগানের ব্যবসায়ী অলোক বসু। তিনি বলেন, “আমার কলকাতা স্টেশনে নামাই সুবিধাজনক। কিন্তু এখান থেকে বাস বা অটো কিছুই না পাওয়ায় আমি বাধ্য হয়ে বিধাননগর রোড স্টেশনে নামি। সেখান থেকে অটো ধরে বাড়ি ফিরি।”
নিত্যযাত্রীদের আরও অভিযোগ, কলকাতা স্টেশন থেকে যে গুটিকতক বাস চলছে, সেগুলি সবই উল্টোডাঙা হয়ে ই এম বাইপাস ধরে যাচ্ছে গড়িয়া বা নিউ টাউন। সারা দিনে চলে সাকুল্যে চার থেকে পাঁচটি রুটের বাস। স্বভাবতই তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, এখান থেকে সব রুটের বাস না গেলেও নিদেনপক্ষে হাওড়া বা শিয়ালদহ যাওয়ার বাস কেন মিলবে না? কেন থাকবে না ধর্মতলা যাওয়ার বাস? এত দিন পরেও কেন শুধু ট্যাক্সির উপরে ভরসা করতে হবে? নিত্যযাত্রীরা জানিয়েছেন, কলকাতা স্টেশনে সব থেকে বেশি ট্রেন ঢোকে বা ছাড়ে ভোরে ও রাতে। ঠিক ওই দুই সময়েই বাস বা অটো অমিল। তাঁদের মতে, বেশি রাতে বা ভোরে অন্তত শ্যামবাজার পর্যন্ত বাস পাওয়া গেলেও তাঁদের সুবিধা হতো।
পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের অবশ্য দাবি, প্রি-পেড ট্যাক্সি বুথ তৈরি হওয়ায় সমস্যা অনেকটাই মিটেছে। তিনি বলেন, “আগে ট্যাক্সির বেশি ভাড়ার অভিযোগ নিয়ে প্রচুর অভিযোগ আসত। এখন অনেক কম। তবে বাসের সমস্যা আছে, এ কথা ঠিক। বাস শীঘ্রই বাড়ানো হবে।” তিনি আরও বলেন, “হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশনের উপর থেকে চাপ কমাতে কলকাতা স্টেশন ও সাঁতরাগাছি স্টেশনের পরিকাঠামো উন্নত করা হচ্ছে। এই নিয়ে রাজ্য সরকারেরও বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে।” |