দার্জিলিঙের কমলালেবু নইলে কলকাতার শীত জমে ওঠে না। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই ব্যবসা জমছে না দার্জিলিঙের লেবু চাষির। নাগপুর বা পঞ্জাবে কমলালেবুর হিমঘর থাকলেও, দার্জিলিঙে নেই। সংরক্ষণের ব্যবস্থার অভাবে অতি সামান্য টাকায় চাষিদের লেবু বেচে দিতে হচ্ছে ফড়েদের কাছে। তাই এবার কমলালেবুর হিমঘর তৈরির দাবি জানিয়ে রাজ্য সরকারকে আর্জি জানাল গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ)।
জিটিএ-এর সামসিং এলাকার সদস্য স্যামুয়েল গুরুঙ্গ রাজ্য সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়ে হিমঘর দাবি করেছেন। তিনি বলেন, “হিমঘর থাকলে মরসুম পার হয়ে যাওয়ার পরও ভাল দামে কমলালেবু বিক্রি করা সম্ভব। হিমঘর তৈরির জন্যে গরুবাথান ব্লকের কুমাই এলাকাটিকে আমরা চিহ্নিত করেছি।” রাজ্যের উদ্যান পালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী সুব্রত সাহাও বলেন, “কমলালেবু সংরক্ষণের বিষয়ে বিস্তারিত রির্পোট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। পিপিপি মডেলে কাজ করার পরিকল্পনা হচ্ছে। ন্যাশনাল হর্টিকালচার মিশনের টাকায় হিমঘর তৈরি হবে।”
প্রতি বছর গাছ থেকে পেড়ে ফেলার পরেই কমলালেবু বিক্রি করতে বাধ্য হন চাষিরা। দর কম পাওয়া গেলেও বিক্রি করতে হয়। কারণ, দু’চার দিন ঘরে রাখলেই কমলালেবু পচে যায়। কত দিন কমলালেবু হিমঘরে রাখা সম্ভব, কী পদ্ধতিই বা অবলম্বন করতে হয়, সে বিষয়ে এ ব্যাপারে বিশদ রিপোর্ট তৈরি করা হচ্ছে জিটিএ-র তরফ থেকে। |
দার্জিলিঙের বাদামতলা বাগানে কমলালেবু সংগ্রহ। ছবি: রবিন রাই। |
বিশেষজ্ঞদের মতে ০-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা এবং ৮৫-৯০ শতাংশ এর কাছাকাছি আপেক্ষিক আর্দ্রতা বজায় রাখলে তিন-চার মাস পর্যন্ত কমলালেবু সংরক্ষণ করা সম্ভব।
এই উদ্যোগে আশার আলো দেখছেন চাষিরাও। গরুবাথানের টাঁড় এলাকার কমলালেবু চাষি আশারাম ভুজেল বলেন, “তিন-চার মাস কমলালেবু সংরক্ষণ করা আমাদের কাছে স্বপ্নের মত। ফেব্রুয়ারি-মার্চে কমলালেবুর মরসুম শেষ হয়ে যায়। হিমঘরে কমলালেবু রেখে ফের জুন-জুলাই মাসে কমলালেবু বাজারে ছাড়া গেলে তার বাজারদর দ্বিগুণ হবে।” জিটিএ-র উদ্যান পালন দফতরের সচিব ডন বসকো বলেন, “বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। উপায় বার হবেই।”
বর্তমানে ফড়েদের উৎপাতে কমলালেবু বাজারে চাষিরা যথাযথ দাম পান না বলে অভিযোগ। চাষিরা জানান, নভেম্বর মাসে পাহাড়ের ভাল কমলার দাম সমতলের বাজারে ৫০-৬০ টাকা ডজন দরে বিক্রি হয়। সেখানে চাষিরা ২০ টাকা ডজনের বেশি দাম পান না। আবার ফড়ে বা দালালদের মাধ্যমে কমলালেবু বিক্রি না করে উপায়ও থাকে না। কারণ, প্রত্যেক চাষির পক্ষে পাইকারি বাজারে গিয়ে বিক্রি করা সম্ভব হয় না। ফড়েরা বাগান থেকে এসে কমলালেবু নিয়ে যান।
লেবুর সংরক্ষণ-বিপননের সঙ্গে সঙ্গে, উৎপাদনের দিকটি নিয়েও চিন্তিত উদ্যান পালন দফতর। দফতর সূত্রের খবর, পাহাড়ে কমলালেবু চাষের পরিমাণ কমছে। আকারেও ছোট হচ্ছে। পাহাড়ে কমলালেবুর অন্যতম পাইকারি বিক্রেতা নরবাহাদুর সার্কি জানান, গত বছর বাদামতাম এলাকার হিমালিগাঁও এলাকার ১০টি বাগানের কমলালেবু ৭ লক্ষ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছিল। এ বার ফলন কম হওয়ার টাকার অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৩ লক্ষ টাকার মত। তিনি বলেন, “আগের বার চার ট্রাক কমলালেবু মিলেছিল। এ বার খুব বেশি হয়ে দু’ট্রাক কমলালেবু মিলবে।” একটি ট্রাকে ২০-৩০ হাজার কমলালেবু ধরে, জানান তিনি।
নরবাহাদুর পাহাড়ের তাকদা, দাবাইপানি, ঘাটে, সিঙ্গরিতাম, মানেদারা, হরসিং, জিং, বানেকবার্নের মতো বিভিন্ন এলাকার বাগান থেকে কমলালেবুর কিনে শিলিগুড়ি পাইকারি নিয়ে আসেন। পরে তা গোটা উত্তরবঙ্গ, এমনকী বাংলাদেশেও যায়। নরবাহাদুরবাবু বলেন, “গত বছর ৩৬ লক্ষ টাকার কমলালেবু কিনেছিলাম। এ বার তা ১৮ লক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদন কম হওয়ায় আমাদের ব্যবসাও মার খাচ্ছে।”
এর পরে রয়েছে পোকার আক্রমণ। বছর পাঁচেক ধরে এই রোগ শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ চাষিদের। বাদামতাম এলাকার কমলালেবু চাষি বিমল রাই রলেন, “বাগানে ছোট পোকার আক্রমণের জেরে এ বছর উৎপাদন ৪০ শতাংশ কম হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফল নষ্ট হয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। অনেক কমলালেবুতে দাগ হয়ে যাচ্ছে। ওষুধ দিয়েও পোকার আক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না।” তিনি জানান, ২০ বছর পর এবার প্রথম বাধ্য হয়ে এবার কমলালেবুর পাশাপাশি এলাচের চাষও করছেন তিনি।
তাই হিমঘর তৈরির পাশাপাশি কমলালেবু নিয়ে গবেষণাতেও জোর দিচ্ছে সরকার। মন্ত্রী সুব্রতবাবু বলেন, “কয়েক বছর আগেও বড় কমলালেবু পাওয়া যেত। কিন্তু এখন আকার ছোট হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে, তা দফতরের গবেষকদের দেখতে নির্দেশ দিয়েছি। রিপোর্ট পাওয়ার পরে উন্নত প্রজাতির কমলালেবু চাষে জোর দেওয়া হবে।” |