প্রথম সব কিছু
আনন্দplus
শ্যুটিং তো বটেই। শ্যুটিং না-হলে এমন অবাস্তব দৃশ্য তৈরি হয় নাকি?
সল্ট লেক নেতাজি স্ট্যাচুর ঠিক আগে। ডান দিকে সামান্য হাঁটলে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কোচিং ক্যাম্প। আর একটু এগোলে করুণাময়ীর মোড়। এই জাংশনটা তিন মাথার মোড়। যেখানে তিনটে গাড়ি আর একটা ট্যাক্সি গোটা জাংশন ব্লক করে দাঁড়িয়ে। ট্যাক্সির পাশে খুব পরিচিত এক মহিলা। যিনি ট্যাক্সিতে ওঠার চেষ্টা করছেন আর গাড়িগুলো থেকে তাঁকে অনুরোধ করা হচ্ছে, “প্লিজ, প্লিজ গাড়িতে উঠুন।”
তিনি— নীল টপ আর খয়েরি স্কার্ট-য়ের মুনমুন সেন তত বেশি করে বিরক্ত মুখে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলছেন, “যেতে বলছি, শুনতে পাচ্ছ না! চলো বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড, চলো।” আর ততই গাড়িগুলো থেকে ট্যাক্সিচালককে বারণ করা হচ্ছে, “একদম স্টার্ট দেবে না।”
মুনমুন এ বার তীব্র শাসানি দিলেন ড্রাইভারকে, “চলো শিগগির!” ট্যাক্সি বেরিয়ে গেল। পড়ে থাকল তিনটে গাড়ি। আর নিষ্ফল আবেদন সমেত তার আরোহীরা।
এ বার বলা যাক— শ্যুটিং নয়। বাস্তব। যার উৎপত্তি আনন্দplus -য়ের পুজো শ্যুট-য়ে। ঘটনাটা এই মাত্র শেষ হল, হাঁটা দূরত্বের এফ ডি সর্বজনীনে। যেখানে এই প্রথম একসঙ্গে পুজোশ্যুট করলেন দেব আর জিৎ। গত ক’মাস ‘পাগলু’ বনাম ‘বস’ ঘিরে বক্স অফিস কাটাকাটি, ফ্যানদের ওয়েব যুদ্ধ সব। এঁদের সম্পর্ক ঘিরে অধুনা এমন ধুন্ধুমার যে, এক ফ্রেমে আনাটাই মহা সমস্যা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে কোনও পেশাদারি শর্তহীন ফোটোশ্যুট তো অলৌকিক!
উত্তমের ড্রয়িং রুমে দেব। প্রথম সংখ্যা
অথচ ক’মাসে জমতে থাকা টেনশনটাই অদৃশ্য হয়ে গেল পরিচালক হিসেবে মুনমুন সেন-য়ের আবির্ভাবে। “মুনদি ডিরেক্টর, কী বলছ কী,” দুই সুপারস্টারই এমন চমৎকৃত যে শ্যুট ঘিরে নিম্নচাপ যেটা অব্যর্থ তৈরি হচ্ছিল, কলকাতার ওপর দিয়ে যেমন সাইক্লোন-টাইক্লোন চট্টগ্রাম উপকূলে উড়ে যায়, তেমনই উড়ে গেল।
মুনমুন অসম্ভব পারফেকশনিস্ট। ঠিক একটা নির্দিষ্ট ভাবে শ্যুট করতে চান। চাইছেন এঁরা এমন পোশাকআশাক পরুক রাজবাড়ির পুজোয় লোকে যেমন পরে। হেয়ার স্টাইল পছন্দমতো করার জন্য জুন টমকিন্স থেকে মেমসাহেব স্টাইলিস্ট আনিয়েছেন। যাঁরা এক সময় নিয়মিত তাঁর মায়ের চুল বাঁধতেন। সমস্যা হল, তাঁর চিন্তাভাবনার সঙ্গে আধুনিক প্রজন্ম যে চুলচেরা একমত হবে তার কোনও মানে নেই। এঁরাও তো নিজেদের ক্যাপটিভ অডিয়েন্সের কাছে এক-একজন ফ্যাশন আইকন। দেব, জিৎ, রাইমা...। দ্রুত আপসেট হয়ে পড়লেন মুনমুন। “এদের আর কী বলব, নিজের মেয়েই তো আমার কথা শুনছে না।” দ্বিতীয় শ্যুটটা যখন চলছে মুনমুন অভিমানে এক কোণে বসা। বললেন, “আমাকে কী দরকার?” দেব-জিৎ টানতে টানতে নিয়ে গেলেন তাঁকে, “ডিরেক্টর, বলো কী করতে হবে? তুমিই বস।”
শেষ দৃশ্যে ফের আপসেট হয়ে পড়ে মুনমুনের ট্যাক্সি অন্তর্ধান। রাইমাকে দ্রুত ফোনে ধরা গেল। যিনি হাসছেন, “মাম্মির মুড সুইং। কোনও ব্যাপার না।” রাত্তিরে আবার যখন ধরা হল, রাইমা টেক্সট করলেন: ‘এখন দিদিমার সঙ্গে’। বেশ মনে হল আজকের শ্যুটিং নিয়েই কথা হচ্ছে।
দিদিমা! ওহ ঈশ্বর! রাইমা কি ফোন সায়লেন্ট করে স্পিকারে দিয়ে দিতে পারেন না? ছোট জবাব এল: নিশ্চয়ই পারি। বাট দেন মাম্মি উইল কিল মি।
... গত এক বছরে এ রকম কত কত নেপথ্য মুহূর্ত। পাতায় এবং পাতার বাইরে—যুগপৎ। যেমন নেপথ্য, তেমনই প্রকাশ্য। আশা ভোঁসলের ইন্টারভিউ করতে গেল ইন্দ্রনীল রায়। ফ্রেন্ডস এফ এম এনেছে আশা-কে। ইন্টারভিউ তো এবিপি থেকেই সেট হয়ে গেল। পিছনে দৌড়বার ঝকমারি নেই।
কিন্তু আসল পরীক্ষা তো সবে শুরু। মাত্র কয়েক মাস আগে মেয়ে বর্ষা আত্মহত্যা করেছেন। ইন্টারভিউতে মেয়েকে নিয়ে জিজ্ঞেস না-করা গেলে আর সেটা ইন্টারভিউ কী করে হয়? আর আশা-র ঘনিষ্ঠ শিবির ঠিক এই প্রসঙ্গটাই তুলতে দিতে রাজি নয়। সে দিনই রাতে অন্য কাগজের শীর্ষস্থানীয় কেউ অভিযোগ করলেন, আনন্দplus নির্দিষ্ট সময়ের অনেক বেশি সময় কাটিয়েছে আশার সঙ্গে। এতটা টাইম ওদের অ্যালট করা হয়নি। সাক্ষাৎকার এবং ছবি হাতে আসার পর বোঝা গেল কেন একস্ট্রা টাইমটা লাগল। বোঝা গেল ইন্দ্রনীলের কোনও দোষ ছিল না।
বাড়তি সময়টা ব্যয় হয়েছিল, আশা ভোঁসলের হাউহাউ কান্নায়!
সাক্ষাৎকারের মাঝামাঝি একটা সময় তৈরি হয়, যখন ইন্টারভিউয়ারের চোখেও জল। সে আশা-র স্পর্শকাতর জায়গায় হাল্কা টোকা মারতে গেছিল। তাতেই যে বাঁধ ভেঙে অমন রাশভারী মহিলা ‘আশা’ থেকে ‘সন্তানহারা মা’তে রূপান্তরিত হবেন, কে জানত! এমন একটা সময় তৈরি হয়, যখন ফোটোগ্রাফার কৌশিক সরকার ক্যামেরা বন্ধ করে লজ্জিত ভাবে বসে পড়ে। ইন্টারভিউটা এক্সক্লুসিভ ছিল না, কিন্তু গুণগত বিচারে বোধহয় আশা ভোঁসলের সর্বকালের সবচেয়ে মানবিক ইন্টারভিউ!
মান্না দে-র কাহিনিও তাই। শিল্পীর মৃত্যুর পর আনন্দplus ‘কী চেয়েছি আর কী যে পেলাম’ সংখ্যা নিয়ে যা মাতামাতি হয়েছিল, তা বার্ষিকীর আর কোন ইসু ঘিরে ঘটেছে, অনেক মাথা চুলকেটুলকে বের করতে হবে। মান্নার দুর্দশার অবস্থাটা অবশ্য গত ডিসেম্বরে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েই পাওয়া গিয়েছিল। ওঁর বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ই মনে হয়েছিল এ কাকে দেখে উঠলাম? দেখি রাজাটা তো পড়েই আছে, মুকুটই শুধু নেই। কয়েক দিন বাদে ফোনেও তীব্র ব্যথিত লাগল তাঁকে। “এরা তো আমায় একটু পার্কেও বসিয়ে দিতে পারে। যাতে আমি মানুষ দেখতে পাই।” তখনও জানি না স্ত্রী-র স্মরণে এত যে অ্যালবাম তৈরির পরিকল্পনা করছেন মান্না, তাঁর হারমোনিয়ামটাই তো পিছনের ঘরের তাকের ওপর অন্য কোথাও সরিয়ে রাখা! অক্টোবর শেষে মিউজিক অ্যারেঞ্জার শান্তনু বসু-র যে লেখা ঘিরে রাজ্যের সঙ্গীত মহল এবং পাঠক সমাজে এমন তীব্র আলোড়ন তৈরি হল, তার শেকড় কিন্তু শিল্পী মৃত্যুর কয়েক মাস আগে জুন-য়ে। শিল্পীর হাসপাতাল যাত্রার সময় থেকে। কলকাতায় মান্নার আত্মীয় এবং ঘনিষ্ঠরা তখন থেকেই বলে আসছেন, মানুষটা যন্ত্রণা পেতে পেতে শেষ হয়ে গেল। মান্নার ভ্রাতুষ্পুত্র গায়ক সুদেব দে আনন্দplus ‘মান্না দে সংখ্যা’ বার হওয়ার পর বললেন, “কাকাকে কত বলেছিলাম, প্লিজ, কলকাতায় আমার কাছে এসে থাকো। এতটা যন্ত্রণা তোমার সইবে না। আমার সামর্থ্যে অন্তত ডালভাত তো তোমায় খাওয়াতে পারব। উনি কিছুতেই শোনেননি। কাকা উল্টে আমাকেই বকলেন। তখন উনি দিদিকেই ডিফেন্ড করছিলেন।” কে ঠিক ছিল, কে ভুল ছিল, সে সব আজ অর্থহীন প্রশ্ন। কিন্তু বৃদ্ধ বয়স কেমন কাটাব, এই দুর্ভাবনার সঙ্গে একটা সাব কোয়েশ্চেনও যেন আজ বাঙালি সামাজিক জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে গিয়েছে—সন্তান থেকেও ‘মান্না দে’ হয়ে যেতে হবে না তো!
মর্মস্পর্শী আরও একটা রিপোর্টিং জন্ম নেয় বছরের প্রথম দিন। নিউ ইয়র্কে ক্যান্সারাক্রান্ত মনীষা কৈরালাকে যখন আমাদের তরফে দেখতে গেলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। ম্যানহাটনের বিশ্ববিখ্যাত স্লোন কেটারিং ক্যান্সার সেন্টারে সেই সফরের আবেগপ্রবণ অভিজ্ঞতা নিজের হাতে লিখে ফ্যাক্স করেছিলেন ঋতুপর্ণা। শেষ প্যারায় ছিল: ‘আমরা মুখোমুখি অথচ আবার নীরবতা। আবার স্তব্ধতা। এই দৃশ্যে কেউ ‘বাই’ বলল না। এই দৃশ্যের কোনও স্টিল ফোটোও উঠল না। এই দৃশ্য এখনও অসমাপ্ত। এই দৃশ্যের অবসান ঘটবে যে দিন সেই কৌশানির হিমাচল পাহাড়ের গায়ে মেঘে আটকে থাকা মিষ্টি হাসির ছটা মুখে মনীষা দেশে ফিরবে। মেঘের দেশের মেয়ে ফিরবে মেঘ সরিয়ে।’ সেই সংখ্যাতেই জোগাড় করা হয়েছিল যুবরাজ সিংহের বিশেষ সাক্ষাৎকার: ‘মনীষা মনে রেখো ঈশ্বর স্রেফ পরীক্ষা নিচ্ছেন।’
তখন কে জানত, ক’মাসের মধ্যে আনন্দplus -ই প্রথম খবর করবে যুবরাজ আর মনীষা— ক্যানসারজয়ী দুই আইকন কলকাতায় আসছেন ঋতুপর্ণার আমন্ত্রণে!
আরেক স্টারকে নিজের লেখা নিজে সামলাতে দেখা গেল— জিৎ। বাংলা হরফে অবশ্যই লিখতে জানেন না জিৎ। কিন্তু এত বছর বাংলায় কাটিয়ে কোথাও যেন তাঁর সিন্ধ্রি মনন ওয়াক ওভার দিয়েছে ভাবার ধরনে বাঙালিয়ানাকে। নইলে কোয়েলের বিয়ে, মেয়ে চলে যাওয়ার সময়ে বাবা রঞ্জিত মল্লিক-য়ের রক্তাক্ত মন এত ভাল ফুটিয়ে তুললেন কী করে? অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে ওঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা করাটাও জিৎ এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছিলেন, যেন রিপোর্টার হিসেবেই ‘জলসা’তে গেছিলেন। বঙ্গদেশের সুপারস্টার হয়ে নয়।
সুদূর বস্টনে বসে স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার ঘিরেও চাঞ্চল্য তৈরি হল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে যাওয়ার ঠিক তিন মাস হয়েছে। স্বাতী ফোনে বলেছিলেন, “এই যে আশেপাশের মহিলাদের ওকে ঘিরে মুগ্ধতার কথা সবাই বলছে। আজ মনে হয়, নিশ্চয়ই আরও কেউ রয়েছে, আরও কেউ কেউ হয়তো ভগ্নহৃদয়ে বসে রয়েছে। আরও কেউ কেউ হয়তো আমারই মতো দুঃসহ একাকিত্বের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সুনীলকে আমি তো আর পুরোপুরি নিজের বলে দাবি করতে পারি না।” সকালেই জনাকয়েক অভিনেত্রীর ফোন। এত বড় কথাটা স্বাতী সত্যি ‘অন রেকর্ড’ বলেছেন? খুব ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলেন? মুহূর্তের দুর্বলতা? নাকি ‘অফ দ্য রেকর্ড’ শ্রেণিভুক্ত ছিল? আমরা ছেপে দিয়েছি!
অনেকের যেমন অবিশ্বাস্য লেগেছিল নিউ ইয়ার্স ইভ পার্টিতে সৃজিত-স্বস্তিকার ছবি। সৃজিতের পায়ের ওপর নৃত্যরত স্বস্তিকা এমন আলোড়ন তোলেন যে সকাল থেকে গোটা আনন্দplus বিভাগ ফোনে দ্বিখণ্ডিত। অনেকের কাছে রুচিহীন। কারও কারও কাছে অসম্ভব অ্যারেস্টিং। টালিগঞ্জে নব্বই দশক দাপানো এক পরিচালক ফোনে ছোট করে বললেন, “এখন তো দেখছি বড় পরিচালক হতে গেলে শক্তিশালী পা থাকাটা খুব জরুরি।”
আরও অনেক এক্সক্লুসিভ ছবি আর প্রথম ফোটোশ্যুট হল এক বছরে। সে দক্ষিণ আফ্রিকার জঙ্গলে সিংহের মুখোমুখি দাঁড়ানো দেব-ই হন, পিরামিডের সামনে দাঁড়ানো প্রসেনজিৎ বা প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা অ্যাক্সিস মলের অ্যাগোরা-র কেবিনে একান্তে! পাতার ডিজাইনার সমিত চন্দ এক-এক সময় সমস্যায় পড়ে গিয়েছে কোন ছবিটা বাদ দেবে? কোনটা রাখবে? পার্ক স্ট্রিট কবরখানায় যেমন অঞ্জন দত্তকে টেনে নিয়ে গেল সুব্রত মণ্ডল। আবার রূপার অভিনব ছবি তুলল, যেখানে তিনি পরিচারিকার ভূমিকায় বালতি নিয়ে ঘর মুছছেন।
ময়রা স্ট্রিটে দেব— স্টোরিটা দিয়ে শুরু হয়েছিল আনন্দplus । প্রথমে কথা ছিল লক্ষ্মীপুজোর দিন ময়রা স্ট্রিটে যাবেন দেব। এককালে ওই দিনটায় যে গমগম করত ময়রা স্ট্রিটের বঙ্গবিখ্যাত বাড়ি। কালের নিষ্ঠুরতা তাকে কী পরিমাণ ধ্বংসস্তূপে এনে দাঁড় করিয়েছে তার একটা লিটমাস টেস্টও হয়ে যাবে একই সঙ্গে। সফরের দিনটা বদলাতে বদলাতে এসে দাঁড়াল মহাষষ্ঠীতে। ঠিক হল তার পর নাহয় লক্ষ্মীপুজোয় দ্বিতীয় সফর হবে। সুপ্রিয়া দেবী রাজি। আর খুব ইনভল্ভড-ও। দেবকে নিয়ে ঢুকতেই বললেন, “এই যে দ্বিতীয় উত্তমকুমার, এসো!” আবির্ভাবেই এমন সংলাপ! সবাই তখন একটা রুদ্ধশ্বাস যুগলবন্দির প্রতীক্ষায়। প্রথম ইস্যু বলে কথা। চাপ তো থাকেই। সুপ্রিয়া এমন মন ঢেলে অভ্যর্থনা করলেন যেন উত্তমই বলে পাঠিয়েছেন দেবকে ঠিক করে দেখো। লুচি-ডাল খাইয়ে এতটুকু তৃপ্তি পাচ্ছেন না তিনি। “এটা কি কোনও খাওয়ানো হল! আর একদিন আসতেই হবে, যে দিন তোমায় নিজে রান্না করে খাওয়াব।” দেবকে সন্তানস্নেহে বসিয়ে নানা টিপস দিলেন। বললেন, “তোমার দাদার সব ভাল ছিল। শুধু একটা জিনিস ছাড়া। ওঁর পিছন পিছন চামচারা ঘুরত। দেব, আর যাই করো, সঙ্গে চামচা রেখো না। অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।” দেব-সুপ্রিয়া সাক্ষাতের গভীরতম মুহূর্ত তৈরি হয়ে গেল। কিন্তু ফোটোগ্রাফিক মোমেন্ট তখনও অনুপস্থিত। মামুলি ছবি চলছে।
সেটাও হাজির হয়ে গেল দ্রুত। যখন একটু বাধো বাধো করে দেব জিজ্ঞেস করে ফেললেন, “মানে দাদার তো অনেক বান্ধবী ছিল।” সুপ্রিয়া ঘাড় নাড়েন। দেব আরও কৌতূহলী, “এরা ইয়ে মানে কতটা?” সুপ্রিয়া অপলকে বললেন, “সে কি আর কোনও বাছবিচার করেছে নাকি? আমি এদের খাইয়ে খাইয়ে মোটা করে দিতাম। যাঃ, খেয়ে খেয়ে আনঅ্যাট্রাকটিভ হয়ে যা ওঁর সামনে।” দেব তখন দু’হাত তুলে হাসিতে গড়িয়ে পড়ছেন। কে জানত ইতিহাস যে তখনই রেকর্ড করল আনন্দplus -এর আবির্ভাব প্রচ্ছদ!
একই ভাবে সৌরভের জন্মদিনে তাঁর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কোয়েল মল্লিককে। সৌরভকে আভাসই দেওয়া হয়নি। যাতে অতর্কিত চমকের প্রাপ্য স্বতঃস্ফূর্ততা ইন্টারভিউকে প্রাণিত করে। কোয়েল যে এক কথায় অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জে রাজি হয়ে গেছিলেন সেটাও মহা আশ্চর্য। পরিচিতরা বলে থাকেন, কোয়েল কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে প্রচুর সময় নেন, অথচ এখানে তাঁর এক সেকেন্ডও খরচা হল না। কোয়েলের মার্সেডিজ দ্রুত পৌঁছে গেল বীরেন রায় রোডের বিখ্যাত বাড়ির বাইরে। সঙ্গে বিরিয়ানি আর বার্থ ডে কেকের আবির্ভাবে সৌরভ যত না আশ্চর্য হলেন, তার চেয়ে বেশি বিস্ফারিত হলেন ইন্টারভিউয়ার কোয়েলের আগমনে। তাঁকে আভাস দেওয়া ছিল এটা ক্রিকেট প্রতিনিধির সঙ্গে বিশেষ জন্মদিন সাক্ষাৎকার। কোয়েলের কথা উচ্চারিত হয়নি। কিছু ক্ষণ বাদে দেখা গেল, অবাক হওয়ার পালা আমাদের। কী প্রশ্ন করা হবে সেটা কোয়েল আমাদের কাছে জানতে চাননি সেটা একটা ব্যাপার। কিন্তু তাঁর হাতে তো কোনও কাগজও নেই! অথচ ‘অফ সাইডে প্রথমে ঈশ্বর, তার পর আপনি’— এ সব বলছেন কোয়েল। কোনও দিন তো শুনিওনি ক্রিকেটে ওঁর বিশেষ ইন্টারেস্টের কথা। তা হলে? তা হলে-র ব্যাখ্যা পাওয়া গেল ক’দিন বাদে স্বামী রানের কাছে। “অনেক রাত অবধি জেগে দু’দিন ধরে ও গুগলে গাঙ্গুলি ডাউনলোড করছিল।”
বাঙালির আরেক কিংবদন্তির জন্মদিন অবশ্য জুলাইয়ে সৌরভের জন্মদিনে পৌঁছবার অনেক আগেই চলে এসেছিল। এপ্রিল মাস এবং সুচিত্রা সেন। পাতার বিশাল চ্যালেঞ্জ। তা দীর্ঘদিনের নীরবতা ভেঙে মা-কে নিয়ে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিলেন মুনমুন সেন। মুম্বইয়ে রাইমা সমেত গুলজারের বাড়ি গিয়ে আরও বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল ইন্দ্রনীলের। তাঁর ‘আঁধি’র প্রিয় নায়িকা সম্পর্কে বলতে বলতে চোখে জল এসে গেল গুলজারের। কাছের ফ্যাব ইন্ডিয়ায় হেঁটে গিয়ে বিশেষ উপহারও রাইমাকে ধরিয়ে দিলেন তাঁর ভালবাসার মানুষটার জন্য। এ সব তো প্রকাশিত হলই। কয়েক সংখ্যা বাদে আবার বার হল ম্যাডামের ঘনিষ্ঠ প্রয়াত আলোকচিত্রী ধীরেন দেবের তোলা কিছু সুপার-এক্সক্লুসিভ এবং এ যাবৎ অপ্রকাশিত ছবি, যা বঙ্গসমাজ চোখেই দেখেনি। সুচিত্রা সেন সমুদ্রে স্নানরতা! সুচিত্রা সেন সুইমিং কস্টিউমে। পিঠ খোলা। সৃজিত মুখোপাধ্যায় যার অসামান্য ক্যাপশন করেছিলেন— ‘গ্ল্যামারের পীঠস্থান’।
সবই তো হল। কিন্তু সেই বিখ্যাত বাড়িতে বসা লোকচক্ষু থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসিত মহানায়িকা কী ভাবে নিলেন? উত্তেজিত? অসম্মানিত? আনন্দিত? কিছুই আসে যায় না? কিছুই স্পর্শ করে না? কী অবস্থান তাঁর?
মুনমুন একটা লম্বা ‘পজ’ দিয়ে বললেন, “মা দেখেছেন। কেউ বোধহয় কাগজটা দিয়ে গিয়েছিল। শি ওয়াজ হ্যাপি।”
বলিউড? তার রাজা এবং যুবরাজ, দু’জনেই চলে এলেন আনন্দplus -য়ের অনুবীক্ষণে! শাহরুখ তাঁর কলকাতা সফরে গাড়িতে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিলেন বলিউডে ছোটানো গত পনেরো বছরে তাঁর এক্সপ্রেস ট্রেন নিয়ে। গাড়ির যাত্রাপথ রাজারহাট সিটি সেন্টার-টু থেকে বালিগঞ্জ পার্ক। কিন্তু এসআরকে মানসিক সফর করলেন দিল্লির
মধ্যবিত্ত রাজিন্দর নগর থেকে অভিজাত ‘মন্নত’। আর যুবরাজ রণবীর কপূর? স্বয়ং উপস্থিত আমাদের দফতরে। প্রত্যাশিত হিস্টিরিয়ার মধ্যে তাঁর সামনে প্রশ্নপত্র হাতে সৃজিত মুখোপাধ্যায়। আরও একটা মুহূর্তের মতো মুহূর্ত নিমেষে তৈরি!
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যে গাইড লাইন অনুযায়ী আনন্দplus পরিচালিত এবং প্রসারিত, সেটা কলকাতায় সপ্তাহে তিন দিন। শহরতলির বাইরে সপ্তাহে একদিন। এবং স্রেফ এটুকু অবশ্যই নয়। শুরু করা হয়েছিল ইয়ুথ ইন্টারেস্টধর্মী বিষয় এবং তার যৌবনধর্মী উৎসবকে মাস্তুল করে। তার পর চলতে চলতে সে নির্দিষ্ট প্যাটার্নগামী হয়েছে। প্রযুক্তি আর ফিটনেস এই দুটো মুক্তাঞ্চলে আধুনিক তরুণের আগমন না-হলেই নয়। প্রথম বার্ষিকীর মধ্যেই তাই ডেস্কে অদিতি ভাদুড়ির সঙ্গে সহযোগিতায় অন্তত এক ডজন ফিটনেস কলাম লিখে ফেলেছেন চিন্ময় রায়। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ কল্যাণ কর তো ছিলেনই। গুগল গ্লাস বা ব্ল্যাকবেরি বনাম স্যামসুং লড়াইয়ে আলো ফেলার জন্য। আমাদের বিভাগীয় গিজমো ফ্রিক অরিজিৎ চক্রবর্তীও নিয়মিত হোয়াটসঅ্যাপ বনাম বিবিএম বা ফেসবুকে অনলাইন সিকিওরিটি জাতীয় আধুনিক প্রযুক্তির চিন্তন নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। আই ফোন-য়ের কোনও অ্যাপ্লিকেশন সমস্যা করছে। ইনস্ট্যাগ্রামে আপলোড করতে গিয়ে আটকে যাওয়া। সরল ও জটিল, সব ধরনের আধুনিক প্রযুক্তিগত সমস্যাতে আলো ফেলেই আনন্দplus প্রথম বার্ষিকীতে পৌঁছল। এ সবের মধ্যেই আনন্দplus ফেসবুক পেজ চালু হয়ে দ্রুত দু’লাখেরও বেশি লাইকসে পৌঁছে গেল।
বৈশিষ্ট্যে শুরু থেকেই পাতাকে লিলুয়ার ওপারে প্রথমে জাতীয়, পরে আন্তর্জাতিক গণ্ডিতে নিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছে তার স্টোরি বাছার ধরন। প্রয়োজনীয়তা হলেই আন্তর্জাতিক গণ্ডিতে পৌঁছেছে। আর চরিত্র? মৃত অথবা মঙ্গলগ্রহে থাকে এই দুই গোষ্ঠীভুক্তদের একমাত্র ছাড় দেওয়া হয়েছে! প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত ফোন ঘুরিয়ে ধরেছে দুই গোলার্ধের নানান প্রান্তে থাকা আমাদের পাতার কৌতূহলের বিষয়কে। লস অ্যাঞ্জেলিসের বাড়ি থেকে অনুষ্কাশঙ্কর। ফ্লোরিডাতে বসে থাকা সলমন-বান্ধবী, বর্তমানে যৌন নির্যাতিতা মহিলাদের হয়ে কাজ করা সোমি আলি। বা ভিদা সমাদজায়ে— যিনি আজও তালিবানদের থেকে খুনের হুমকি পান। কাবুলে প্রাণ দেওয়া কাবুলিওয়ালার বাঙালি বৌয়ের মতোই যিনি যে-কোনও দিন হতে পারেন উগ্রপন্থীদের বেয়োনেটের শিকার। যাঁর স্বামী ইতিমধ্যেই একে ফর্টি সেভেনের শিকার, সেই বিনিতা কামতেও অনবদ্য ফোন সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন প্রিয়াঙ্কাকে। ২৬/১১-র অন্যতম শহিদ তাঁর অসমসাহসী আইপিএস স্বামী। বিনিতার সাক্ষাৎকারও কিনা স্বামীর মতোই বীরোচিত— অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করতে যাওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে।
অন্য মিডিয়ার অংশ হয়েও আনন্দplus -য়ের জন্মলগ্ন থেকে যিনি নিয়মিত মতামত দিচ্ছিলেন, অমুকটা ভাল লাগছে, অমুকটা ভাল লাগছে না, তিনি আচমকা চলে গেলেন গত ৩০ মে। ‘ঋতুকথা’ সংখ্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পাশাপাশি সমৃদ্ধ হল কিছু দূরের মনখারাপ করে দেওয়া আরও একটি সংখ্যা। যখন বিদ্যা বালন সখেদে বললেন সংযুক্তা বসুকে—ইস, ‘অনেক আদর’ বলে আর কেউ আমায় কখনও এসএমএস করবে না।
আরও একটা সাড়া-জাগানো ইন্টারভিউ দেখা দিল কাছাকাছি সময়ে। যখন গ্রেগরি স্টিভন চ্যাপেল কলকাতায় বহু বছর পরের প্রত্যাবর্তনে বিশেষ ইন্টারভিউতে পরিষ্কার বললেন, “সৌরভের ব্যাপারে অনুতপ্ত নই। আমার নিজের ভাই হলেও একই কাজ করতাম।” বিনোদনের সঙ্গে ক্রীড়াজগতের প্রবাদপুরুষদের নিয়মিত উপস্থিতি কী বৈচিত্র বয়ে আনল পাঠকের পক্ষে? কখনও গুরু গ্রেগ। কখনও লিয়েন্ডার। কখনও ইস্টবেঙ্গল কোচ মর্গ্যান। হয়তো।
তবে এত সব ধেয়ে আসা এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার, ফার্স্ট লুক, না দেখা ছবি আর টাটকা খবরের স্রোতে একটা নিউজ যে মিলল না। আমরা লিখেছিলাম, সচিন অবসর নেবেন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের পর। দেশে নিরাপদ ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলে উঠে নয়। লেখার পিছনে কারণও ছিল। যখন তাঁর এজেন্ট মৃদু করে বলার চেষ্টা করেছিলেন ঘরোয়া আলোচনায় যে, সাউথ আফ্রিকায় খামখা পরীক্ষা দিতে যাওয়ার দরকার কী? সম্মানটা একটা ফ্যাক্টর। তখন সচিন— দশের মধ্যে সাড়ে ন’বারের মৃদুভাষী সচিন নাকি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলে ফেলেন, সম্মানটা আমার। তোমার নয়। এ-ও বলেন, “এত খাটছি কি ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলার জন্য নাকি? ডেল স্টেইন না খেললে মজাটা কীসের?”
তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলেও সবাই জানত মন্ত্রটা কী? চলো দক্ষিণ আফ্রিকা। তাঁর জীবনীকারকে দিয়েই শুধু সেই কবে থেকে কেপটাউনে হোটেল বুক করাননি সচিন। সাউথ আফ্রিকান বোর্ডের কাছে একশো টিকিটও চেয়ে রেখেছিলেন। সে দিন শুনলাম তাঁর বন্ধুবান্ধব সমেত পঁচিশ জন ট্রাভেল এজেন্সিকে দিয়ে টিকিট-হোটেল সবই বুক করিয়ে রেখেছিলেন। স্রেফ অবসরটা প্রত্যক্ষ করার জন্য। এখন তাঁরা ফুল রিফান্ড কী করে পাওয়া যাবে, সেই দুর্ভাবনায়।
অজিত তেন্ডুলকরের ব্যাচমেট এবং সচিনের নিত্যসঙ্গী এক বন্ধু বললেন, “ও তো সাউথ আফ্রিকার জন্য ভেজা টেনিস বলে পুরোদমে প্র্যাকটিসও শুরু করে দিয়েছিল। হঠাৎ কী যে হল!”
হঠাৎ কী হল— পরিষ্কার করে কেউ বলতে চান না। কানাঘুষোর সঙ্কেত হল, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলতে গিয়ে সচিন নিজেই সঙ্কেত পেয়ে যান, পেস বোলিংয়ের বিরুদ্ধে তাঁর রিফ্লেক্স কমে এসেছে। কুড়ি ওভারের ম্যাচ যতই হোক। যতই হোক নিজের দেশে।
বিশ্রী ভাবে বারকয়েক আউট হওয়াই তাঁকে নিঃসন্দেহ করে দেয়, সবুজ পিচে ডেল স্টেইন আর তাঁর প্রিয় পথ্য হতে পারে না। বুঝে যান আফ্রিকার ক্রিকেট জঙ্গলে যে অন্তিম রোম্যান্সের সন্ধান তিনি করছিলেন, সেই সময়ের ঘড়ি পার হয়ে গিয়েছে।
আজ মনে হচ্ছে, যা হয়েছে মঙ্গলের জন্যই। সিদ্ধান্তটা না নিলে ওয়াংখেড়ের রাজসিক বিদায় আর অবিস্মরণীয় বক্তৃতাটা জন্ম নেয় না!
সময় অনেক কিছু অত্যাশ্চর্য রূপরেখা বদলে দেয়। আনন্দplus -য়ের দ্বিতীয় বর্ষ-ও কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সময়ই বলবে। তবে সচিনদের পেশার নিয়ম মেনে তার দ্বিতীয় বার্ষিকীর প্রতিটি সংখ্যাও যে নতুন বল!
এক একটা প্রথম বল!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.