মাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে দায় সেরেছিল একমাত্র সন্তান। মায়ের আর কোনও খবরই রাখত না সে। টানা চিকিৎসার পরে ডাক্তাররা যখন ওই প্রৌঢ়াকে সুস্থ বলে ছাড়পত্র দিলেন, তখনও ছেলে সাফ জানিয়ে দিল, মাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। হাসপাতালের চার দেওয়ালের মধ্যেই পচছিলেন ওই সুস্থ মহিলা। শেষে বাড়ি নিয়ে যেতে উদ্যোগী হলেন তাঁর দাদা। কিন্তু হাসপাতাল তাতে নারাজ। কর্তৃপক্ষের যুক্তি, যিনি হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন, বাড়ি নিয়ে যেতে হবে তাঁকেই। অন্য কারও সঙ্গে ছাড়া যাবে না।
বহরমপুর মানসিক হাসপাতালের এই ঘটনা নিয়ে আপাতত তোলপাড় স্বাস্থ্যভবন। একদিকে যখন মানসিক হাসপাতালে রোগীর উপচে পড়া ভিড়, তখন বিভিন্ন হাসপাতালে কর্তৃপক্ষের এমন মনোভাব নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছে স্বাস্থ্য দফতর। স্বাস্থ্যকর্তাদের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত ওই মহিলা হাসপাতাল থেকে বেরনোর সুযোগ পেলেও অন্য একাধিক হাসপাতালেই আটকে রয়েছেন বহু মানুষ।
স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিযোগ, মানসিক স্বাস্থ্য আইনকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিভিন্ন মানসিক হাসপাতালে রোগীদের ছুটি দেওয়া নিয়ে দিনের পর দিন টালবাহানা চলছে। বহরমপুর ব্যতিক্রম নয়, কলকাতার পাভলভ, লুম্বিনী পার্ক হাসপাতালেও এমন ঘটছে আকছার। বিশেষত মহিলাদের ছাড়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের ‘বাড়তি’ সতর্কতা বহু ক্ষেত্রেই তাঁদের সুস্থ জীবনে ফেরার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আইনে রয়েছে, রোগী সুস্থ হলে নিজেই হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে পারবেন। কিন্তু নিজে যাওয়া তো দূরের কথা, মানসিক হাসপাতালগুলিতে পরিবারের লোকেরা নিতে এলেও রোগীকে ছুটি দেওয়া হচ্ছে না। অভিযোগ, কখনও বলা হচ্ছে, যিনি ভর্তি করেছিলেন তাঁকেই আসতে হবে, আবার কখনও বা যিনি নিতে আসছেন তাঁর সঙ্গে রোগীর আত্মীয়তার প্রমাণপত্র নিয়ে দিনের পর দিন হয়রান করা হচ্ছে।
তেমনই ঘটেছে লুম্বিনী পার্কে ভর্তি এক তরুণীর ক্ষেত্রে। নন্দীগ্রামের বাসিন্দা ওই তরুণী মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন। সেই সময়ে পুলিশ রাস্তা থেকে তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। রোগিণী সুস্থ হওয়ার পরে তাঁর বাবা এসেছিলেন তাঁকে নিতে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, নন্দীগ্রাম থানা তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সম্মতি না দিলে তাঁরা ছাড়বেন না। মেয়ের বাবা থানায় গিয়ে অনুরোধ করলে সেখানকার অফিসাররা সাফ জানিয়ে দেন, এটা তাঁদের কাজ নয়। ফলে সেই তরুণীও সুস্থ হওয়ার পরে মানসিক হাসপাতালেই বন্দি ছিলেন। শেষ পর্যন্ত এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় তিনি মুক্তি পান।
কেন এ ভাবে রোগীদের আটকে রাখা? বহরমপুর মানসিক হাসপাতালের সুপার পবিত্র সরকার বলেন, “প্রশাসনিক পদে থেকে এটুকু সাবধান তো হতেই হবে। বিশেষত মহিলাদের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হতে হয়। মানসিক রোগিণীরা তো রাস্তাঘাটেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। তেমন কিছু ঘটলে আমাদের দিকেই আঙুল তোলা হবে।” কিন্তু আইনে তো রয়েছে, সুস্থ হওয়ার পরে রোগী নিজেও সই করে হাসপাতাল ছাড়তে পারেন। এ ভাবে আটকে রেখে তা হলে কি মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে না? এর কোনও জবাব পবিত্রবাবু দিতে পারেননি। লুম্বিনী পার্কেও কর্তৃপক্ষ তরুণী রোগীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের বক্তব্য, ‘ভুল’ হাতে পড়ে মেয়েটি নিষিদ্ধপল্লীতে পাচার হয়ে গেলে তাঁদের উপরেই দায়িত্ব বর্তাত।
এই মনোভাবকে ‘প্রহসন’ আখ্যা দিয়েছেন মনোরোগীদের নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মীরা। সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় বলেছেন, “যেখানে মানসিক রোগীরা শীতের ঠান্ডায়, পেট খারাপে মারা যাচ্ছেন, তাঁদের পরনের ন্যূনতম পোশাকটুকুও বহু ক্ষেত্রে দেওয়া হচ্ছে না, তখন নিরাপত্তা নিয়ে এমন দুশ্চিন্তার দাবি সব অর্থেই হাস্যকর। সরকারি নীতির প্রয়োগে হাসপাতাল কর্তারা যে দায়বদ্ধ নন, এই সব ঘটনা থেকে তা স্পষ্ট হয়।”
কী বলছেন স্বাস্থ্যকর্তারা? মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের অতিরিক্ত অধিকর্তা দেবাশিস বসু এ বিষয়ে বিশদে কিছু জানাতে চাননি। তবে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলিকে সতর্ক করা হয়েছে। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “মানসিক হাসপাতালের ‘বেড অকুপেন্সি রেট’ খুব খারাপ। রোগী সুস্থ হওয়ার পরেও বাড়ির লোকেরা ফেরত নিতে চান না। যাঁদের বাড়ি থেকে ফেরানোর জন্য যোগাযোগ করা হচ্ছে, তাঁদের ক্ষেত্রেও যদি হাসপাতাল এমন মনোভাব দেখায়, তা হলে পরিষেবা বজায় রাখাই দুষ্কর হয়ে উঠবে।” |