স্ট্রোক হয়ে ডান দিক অসাড় হয়ে গিয়েছিল ছাতনার সাধু মিস্ত্রির। পেশায় কৃষক সাধুবাবু ভর্তি হয়েছিলেন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসায় প্রাণে বাঁচলেও হাসপাতাল তাঁর শরীরের অসাড় হয়ে যাওয়া ডান দিকটি সক্রিয় করে দিতে পারেনি। কারণ প্রয়োজনীয় সংখ্যক ফিজিওথেরাপিস্ট নেই তাদের।
খেজুর রস সংগ্রহ করতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছিল হুগলির মাধব সাধুখাঁর। ভর্তি হয়েছিলেন এসএসকেএম হাসপাতালে। সেখানেও ফিজিওথেরাপিস্টের অভাবে তাঁর মেরুদণ্ডের হাড় ঠিক করা যায়নি। বাধ্য হয়ে পার্ক সার্কাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করাতে হয় মাধববাবুকে। সেখানকার বিল মেটাতে ইতিমধ্যেই দু’টো গরু বিক্রি করে দিতে হয়েছে মাধববাবুর পরিবারকে।
চিকিৎসকেরা বলছেন স্ট্রোক থেকে স্পন্ডিলোসিস, দুর্ঘটনায় হাত-পা-কোমর ভাঙা অথবা কুষ্ঠ-আক্রান্তের শরীরের অসাড় অঙ্গ সচল করতে ফিজিওথেরাপিস্ট ছাড়া চলবেই না। অথচ স্বাস্থ্য দফতরে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে গত বছর পনেরো কোনও নিয়োগই হয়নি! ফিজিওথেরাপিস্টদের সর্বভারতীয় সংগঠনের আহ্বায়ক অরূপকান্তি সাহার অভিযোগ, গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে স্ট্রোক, স্পন্ডিলোসিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে। আবার, জনসংখ্যা ও যানবাহন বেড়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনাও বেড়েছে। এই সব কিছুর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন যে ফিজিওথেরাপিস্টের, সরকারি হাসপাতালে তার সংখ্যা দিন দিন কমছে। এর ফলে যাঁরা স্বচ্ছল, তাঁরা বেসরকারি হাসপাতালে বেশি অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসা করাচ্ছেন। অনেকে বাড়িতে ফিজিওথেরাপিস্ট ডেকে নিচ্ছেন। কিন্তু সরকারি হাসপাতালই যাঁদের ভরসা, আর্থিক ভাবে অস্বচ্ছল রাজ্যের অধিকাংশ মানুষই উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে প্রায় পঙ্গু হয়ে জীবন কাটাচ্ছেন।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, সরকারি হাসপাতালগুলিতে ফিজিওথেরাপিস্টের প্রায় ২০০০ পদ রয়েছে। এখন কাজ করছেন সাকুল্যে ২৫০-৩০০ জন। ১৯৯৮ সালে অস্থায়ী ভাবে ১৫০ জন ফিজিওথেরাপিস্ট নেওয়া হয়েছিল। তার পর আর কোনও নিয়োগ হয়নি। যদিও স্বাস্থ্যকর্তারা মনে করেন, যে হারে ফিজিওথেরাপিস্টের প্রয়োজন বাড়ছে, তাতে হাসপাতালগুলিতে অনুমোদিত পদের সংখ্যা দুই থেকে বাড়িয়ে অন্তত পাঁচ হাজার করা উচিত ছিল।
ফিজিওথেরাপিস্টের শূন্য পদে নিয়োগ না হলেও সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে এই বিষয়ে ডিগ্রি ও ডিপ্লোমা পাঠ্যক্রম কিন্তু চালু রয়েছে! প্রতি বছর সেখান থেকে কয়েকশো ছেলেমেয়ে পাশ করে বেরোচ্ছেন। অরূপকান্তি সাহার কথায়, “রাজ্যের ছ’টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ফিজিওথেরাপির ডিপ্লোমা এবং এসএসকেএম-এ ডিগ্রি পাঠ্যক্রম মিলিয়ে প্রতি বছর পাশ করে বেরোচ্ছেন দেড়শো জন ফিজিওথেরাপিস্ট। এ ছাড়াও ৭টি বেসরকারি কলেজে ডিগ্রি পাঠ্যক্রম এবং অসংখ্য সংস্থার সার্টিফিকেট পাঠ্যক্রম চালু রয়েছে। সেখান থেকেও বহু ছেলেমেয়ে পাশ করে বেরোচ্ছেন।” অরূপবাবু বলেন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফিজিওথেরাপিস্টের অভাব না থাকলেও তাঁদের জন্য সরকারি নিয়োগের দরজা বন্ধ।
রাজ্যের স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “নিয়োগে এত তাড়ার কী আছে? আগের আমলে তো অনেক কিছুই হয়নি। এই আমলেই যা হওয়ার হচ্ছে। ফিজিওথেরাপিস্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছি আমরা।” স্বাস্থ্যঅধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “মূলত কুষ্ঠরোগীদের পরিষেবার জন্য সরকার খুব তাড়াতাড়ি ১১ জন ফিজিওথেরাপিস্ট নিয়োগ করবে।” কিন্তু সহস্রাধিক শূন্যপদ পূরণ কত দিনে, কী ভাবে হবেতা নিয়ে রা কাটছেন না স্বাস্থ্যকর্তারা।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, রাজ্যের মধ্যে এক মাত্র নদিয়া ও বাঁকুড়ার সরকারি হাসপাতালে কুষ্ঠরোগীদের ফিজিওথেরাপির জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী রয়েছেন। আর কোনও সরকারি হাসপাতালে এক জনও নেই। কুষ্ঠবিভাগে কর্মীর অভাব নিয়ে রাজ্যের সমালোচনা করে সপ্তাহ দু’য়েক আগে একটি চিঠি দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী গুলাম নবি আজাদ। সেই চিঠিতে কুষ্ঠরোগীদের ফিজিওথেরাপিস্টের অভাবের প্রসঙ্গটিও উল্লেখ করেছেন তিনি।
প্রবীণ ফিজিওথেরাপিস্ট অলক রায়চৌধুরি জানান, যে কোনও হাসপাতালে ফিজিওথেরাপির জন্য দিনে ১০০ জন রোগী এলে তার মধ্যে অন্তত ছ’জনের স্পন্ডিলোসিস ও ব্যাকপেন-এর সমস্যা থাকে। এঁদের কমপক্ষে ২১ দিন থেরাপি নিতে হয়। স্ট্রোক বা কুষ্ঠ রোগে থেরাপির সংখ্যা আরও বেশি। স্বাস্থ্যকর্তারা বলছেন, সরকারি হাসপাতালগুলিতে ‘পুনর্বাসন পরিষেবা’ ব্যাপারটাই উঠে যেতে বসেছে। বাম আমলে এই সমস্যার সমাধান হয়নি। সরকার বদলের পরেও অবস্থা সেই একই।
ফিজিক্যাল মেডিসিনের প্রবীণ চিকিৎসক মৌলিমাধব ঘটক অবশ্য সরকারি হাসপাতালে ফিজিওথেরাপিস্ট না থাকার অন্য একটি কারণের উল্লেখ করেছেন। তাঁর কথায়, “ফিজিওথেরাপিস্টদের একটা বড় অংশ ডাক্তারের মর্যাদা দাবি করছেন। এটা নিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে তাঁদের সংঘাত রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে ফিজিওথেরাপিস্টের নিয়োগ না হওয়ার এটাও একটা বড় কারণ।” এসএসকেএম-এর ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের প্রধান রথীন হালদার বলেন, “আমাদের সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল হওয়া সত্ত্বেও এত কম ফিজিওথেরাপিস্ট রয়েছেন যে রোগীদের পুনর্বাসনের কাজ চালানো প্রায় অসম্ভব। বহু রোগীকে ‘অকুপেশনাল থেরাপি’ বা হাত-পা সচল রাখার জন্য আলাদা থেরাপি দেওয়া দরকার। তার লোকও নেই।” |