|
|
|
|
|
|
|
একটাভয়কষ্ট[লজ্জা]ঘেন্না |
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
|
সেই সময়টার মধ্যে একটা জাদু ছিল। সত্যি। আমাকে আর কলকাতাকে— দুজনকেই অনেক সুন্দর দেখতে ছিল। মনে এমন একটা ভাব ছিল যেন চাঁদ-সূর্য আমার জন্যই উঠছে এবং হেদিয়ে যাচ্ছে। আমি খানিকটা ওদের কৃতার্থ করছি। কেউ কেউ সময়টাকে যৌবন বলে। তার ঔদ্ধত্যও আলাদা, তার তীব্রতাও আলাদা, তার কোমলতাও আলাদা। এ রকমই একটা হাজার-ওয়াট দিনে, দুপুরশেষে আমি বেরিয়েছি। পড়তে যাব। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চার পাশ ধন্য করতে করতে বাসস্ট্যান্ড। সেখানে একটা মোটামুটি ফাঁকা ঢাকুরিয়া মিনিতে পদার্পণ। বাস ঢিমে। বসার জায়গা পাইনি। রড ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। সঙ্গে দাঁড়িয়ে এক বিশাল বপুর মহিলা আর তার তেএঁটে বাচ্চা। ঘ্যানর ঘ্যানর করে কী সব বায়না করছে। আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আমার মনের ভেতর ঠিক সেই সময়টায় কে— ডি নিরো না বিভূতিভূষণ না আমির খান, ভুলে গিয়েছি।
মিনিবাস নিজের মতো চলছে। আর কেন আমার মনের মতো চলছে না, সেটা ভেবে আমার বেশ রাগই হচ্ছে। অতঃপর অন্যমনস্কতার কাজে আমি বিশেষ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। একটা সাংঘাতিক ব্রেক কষায় হকচকিয়ে ছারের বাস্তবে ফিরলাম। কাঁধে বেশ লেগেছে। চোখ পাকিয়ে কন্ডাক্টরকে বললাম, এটা কী রকম বাস চালানো? তাতে সে বেশ কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘সেই! দেখুন না দিদি, লোকজন এমন ভাবে রাস্তা দিয়ে চলে না...’, বাক্য শেষ না করে ড্রাইভারকে বলল দেখেশুনে চালাতে। বাসের লোকজনও একটু গুঁইগাঁই শুরু করল এটা কী হচ্ছে গোছের। তখন কিন্তু এখনকার মতো কেউ কিছু বললেই মার খেত না বা খুন হয়ে যেত না। বচসা হত, কিন্তু তত হার্মফুল ছিল না। কেউ কেউ এমনকী টিপ্পনীও কাটতে পারত।
বাসটা ফের কিছু দূর গিয়ে আবার ব্রেক কষল। বাসের অন্যান্য লোকজন এ বারও ছোটখাটো একটা প্রতিবাদ জানাল। কিন্তু ঠাহর হল, ড্রাইভারটি ঘ্যাঁচড় পাবলিক। কথা সে শুনবে না। তাকে ব্রেক কষায় পেয়েছে। ঢিকঢিক করে এগোতে এগোতে এ বার মোক্ষম ব্রেক। আর তার পর যা হল!!! আমার হাত ছেড়ে গেল রড থেকে। আমি টাল খেয়ে, ব্যালেন্স হারিয়ে, বিনা বাধায় গড়গড় করে পিছিয়ে গিয়ে বেজার মুখের মাঝবয়সি এক জনের কোলে... ধপাস। হ্যাঁ। ধপাস করে বসে পড়লাম। তিনি হতচকিত, স্তম্ভিত, হতবাক। আমি চমকিত, সারপ্রাইজিত এবং বোঝার পর প্রায় ক্রন্দিত। বাস-সুদ্ধ লোক আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। কেউ কেউ ফিকফিক। আমি থতমত খেয়ে, কোনও মতে উঠে দাঁড়িয়ে যারপরনাই সরি বলতে যাব, ফের ব্রেএএএএএএকককক। এক ঈশ্বর ছাড়া এ রকম কমেডি কেউ লিখতে পারেন আমি বিশ্বাস করি না। অর্থাৎ কিনা, আমি ফের ধপাস। এবং সেই ভদ্রলোকেরই কোলে! কী যে করি, কী করব। এটা কী হচ্ছে? অবাক হব না কাঁদব না ষড়যন্ত্রের ছকে ইন্ধন দেব কিছুই বুঝতে পারলাম না। এতটা দুর্ভাগ্য কারও হতে পারে? এ বার বেশ জোরে কিছু হোহোহোহো। আমার মুখ লাল, কান গরম, হাতের ফাইল ভূপতিত। এবং সেই ভদ্রলোক ফের এতটাই অবাক যে কিছু বলতে অবধি পারছেন না। বিশ্বাস তো করতেই পারছেন না। আমি বদমাইশি করছি, না সত্যিই এ রকম রিপিট টেলিকাস্ট হচ্ছে, সেটা তাঁর বোধের বাইরে। আমারও। ফের নিজেকে গুছিয়ে উঠে খুব শুকনো গলায় বললাম, সরি। আর তার উত্তর যেটা এল, তাতে আমার কী বলা উচিত ভেবে পেলাম না। উনি বললেন, ‘আআআর, সরি!’ এটা উনি কেন বলেছিলেন সে ধাঁধা আমি আজও সল্ভ করতে পারিনি। সেই মুহূর্তে বাসের জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল। বুঝতেই পারছিলাম একশো জোড়া চোখ আমার দিকে অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে। মম অস্তিত্ব লইয়া কোন চুলোয় যাব ভেবে পেলাম না। দুটো স্টপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খুব মন দিয়ে নিজের জুতো নিরীক্ষণের পর, দরজার দিকে এগোলাম। কন্ডাক্টর বলল, নামবেন? বললাম, আআআর নামব! |
|
|
|
|
|