রবীন্দ্রনাথের ‘যা হারিয়ে যায় তা আগলে ব’সে রইব কত আর’ গানটি থেকে থেকে মনে পড়ে। অনেক দিন বাঁচা হয়ে গেল। বয়সে যাঁরা আমার চেয়ে বড়, তাঁরা মুচকি হাসছেন। একটা বয়সের পর বয়স বাড়ানোর একটা অভিমান গজিয়ে ওঠে। আমার প্রিয় লেখক ইতালো কালভিনো তাঁর ‘ইন্ভিজিব্ল সিটিজ’ বইয়ে লিখেছিলেন: একটা বয়স আসে, যখন মানুষ হঠাৎ টের পায়, যে দুনিয়াটা তার খুব চেনা ছিল তার বেশির ভাগ মানুষ মৃত।
স্নেহ করে কাছে টেনে নেওয়ার মানুষ, সে রকম মনখারাপ হলে বা কোনও পরামর্শ দরকার হলে, কাছে গিয়ে দু’দণ্ড বসে, দুটি কথা বলে, দুটি কথা শুনে একটু শান্তি পাওয়ার মতো মানুষ আর থাকেই না।
শিল্প-সাহিত্য-সংগীতের মধ্যেও সেই জায়গাটি থাকে। বের্টোল্ট ব্রেশ্ট তাঁর ছোট একটি কবিতায় লিখেছিলেন— আদর্শ অবসর হল পুরনো কাউচে গা ডুবিয়ে বসে, পুরনো একটা বই আর এক বার হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে চেনা ব্র্যান্ডের সিগারে টান দেওয়া।— সবই চেনা। পুরনো। সেই অবসরে কোনও গান বা বাজনার রেকর্ড আর এক বার একা একা শোনা?
আমার বাবাকে দেখতাম, চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর সন্ধেবেলা এক পাত্র কমদামি হুইস্কি, অভ্যস্ত ব্র্যান্ডের সিগার আর দেশলাই নিয়ে রেকর্ড প্লেয়ারে একের পর এক গ্রামোফোন রেকর্ড শুনতে— একা, চোখ বুজে। পাশের ঘরে আমার চলৎশক্তিহীন মা-ও শুনতেন।
বাবার গানবাজনা শোনা মানে আমীর খান, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথের একের পর এক। তারই মধ্যে হঠাৎ পান্নালাল ভট্টাচার্যর গাওয়া ‘কোথা ভবদারা দুর্গতিহরা, কতদিনে তোর করুণা হবে।’ দরবারি কানাড়া-ঘেঁষা স্থায়ী। ‘করুণা’ কথাটির ওপর ‘রমা পধণা পজ্ঞা’ এই কাজটি অনুচ্চ ভাবে সেরে শুদ্ধ মধ্যমে যাওয়া। একটি মাত্রা। তার পরেই ‘কোথা’র ‘কো’-তে শুদ্ধ রে। আমার বাবা-মা অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন। আমার জীবনেও ঈশ্বরের কোনও ভূমিকা কোনও দিনই নেই। কিন্তু পান্নালাল ভট্টাচার্যের গাওয়া এই গানটির ওই জায়গাটি শুনলে গলার কাছে কী যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠতে চায়। কান্না আসে। দ্বিজেন্দ্রলালের ‘তোমারেই ভালোবেসেছি’... ছ’বছর বয়স থেকে শুনছি। কত বার যে চেষ্টা করেছি গানটি তোলার। স্থায়ীর শেষ পর্যন্তও গেয়ে উঠতে পারিনি কখনও— পুরো গান তো বহু দূরের কথা। কান্না আসবেই আসবে। কত চেষ্টা করেছি কান্না ঠেকাতে। কত শাসনই না করেছি নিজেকে এবং গানটিকেও। ব্যর্থ হয়েছি। আমার এক ভাবুক নবীন বন্ধু বলেন— এই গান একটা সভ্যতা।
|
কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায় যে-ভাবে এ গান গেয়েছিলেন, পরে ‘আরোহী’ ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও, তার পর আর কারুর উচিত হয়নি, উচিত হবে না গানটি রেকর্ড করা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গানটিকে একটু সরল করে নিয়েছিলেন, কিন্তু ভাবের ঘরে, গায়কিতে ছিল রাজকীয় গরিমা— যা কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের গায়কিতে ছিল। সেই গায়কি শুনে আমার অন্তত মনে হয়েছে তিনি এক জন প্রফেট। দ্বিজেন্দ্রলালের গানটি অবতীর্ণ হচ্ছেন কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের মুখ দিয়ে। আমি অঞ্জলি পেতে দোয়া চাইছি। কোনও কোনও শিল্পী গানকে ধর্মের জায়গায় (‘রেলিজিয়ন’, সংগঠিত ধর্ম অর্থে নয়) নিয়ে যেতে পারেন। ‘তোমারেই ভালোবেসেছি’ শুনতে শুনতে কোনও মানুষের কান্না হল স্বীকৃতি: আমি মেনে নিলাম তোমার ধর্ম। রবীন্দ্রনাথ যে গানের বেদনায় হারিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন, ওই কান্না তার একটি দিক। বেহাগ রাগের কয়েকটি স্বরের পথ ধরে যে-ভাবে তিনি নামিয়ে আনলেন ‘গানের বেদনায় যাই যে হারায়ে’ এবং ‘য়ে’-অংশটি যে-ভাবে শুদ্ধ ধৈবত থেকে তিনটি মাত্রায় নিয়ে গেলেন তারসপ্তকের ষড়জে: এটাই তো অবতীর্ণ হয়ে ‘সুরে’, গন্তব্যে পৌঁছনো। তার পর ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে’ কথাগুলি যদি আর না-ও গাওয়া হয়, আমার অন্তত কোনও খেদ নেই। এই প্রফেট আমায় গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন। অমোঘ ষড়জ। অমোঘ, অনিবার্য।
একই অনিবার্যতা পান্নালালের গাওয়া ‘কোথা ভবদারা’ গানটিতে। ‘কতদিনে তোর করুণা হবে’— ‘করুণা হবে’-র সুরের সংক্ষিপ্ত, নম্র তান অনিবার্য ভাবে পৌঁছে দিচ্ছে আমাদের শুদ্ধ রেখাবে, যেখানে ‘কোথা’ শুরু। রবীন্দ্রনাথের ওই গানে তারের ষড়জের যে ভূমিকা, একই ভূমিকা নিচ্ছে এই শ্যামাসংগীতে শুদ্ধ রেখাব। মন্দ্রসপ্তকের কোমল ধৈবত, কোমল নিখাদ হয়ে মধ্যসপ্তকের শুদ্ধ রেখাবে যে অবস্থান— এ হল দরবারি কানাড়া রাগের লক্ষণ, ধর্ম। আচার্য আমীর খান দরবারি কানাড়া গাইলে মন্দ্রসপ্তকের সুরগুলিকে নানান ভাবে স্পর্শ করে মধ্যসপ্তকের শুদ্ধ রেখাবে এসে এই স্বরটিকেই করে তুলতে চাইতেন ধ্যানের জায়গা। এই স্বর ছেড়ে সহজে এগোতে চাইতেন না। বার বার ফিরে যেতেন মন্দ্র সপ্তকে।
পান্নালালের গাওয়া ওই শ্যামাসংগীতের সুর ও মেজাজ কতটা রাগসংগীতের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করে চলেছে, তা দেখানোর জন্য এই প্রসঙ্গ তুলিনি। বাংলাদেশের কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্ লিখেছিলেন ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি, আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।’ আমিও বলছি কিংবদন্তির কথা, পরম্পরার কথা, একটা সভ্যতার কথা, যা হারিয়ে যায় তার কথা— এবং তাকে আগলে রেখে বেঁচে থাকার কথা।
বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকার একটা বড় দিক হল শুশ্রূষা। রোগে-ক্লান্তিতে-হতাশায় যে মানুষ শুশ্রূষা পায় না, তার মতো অভাগা আর কে? সমাজজীবনে ও ব্যক্তিজীবনে শুশ্রূষা জোগানো সংগীতের একটা বড় কাজ। মানুষ যখন একা একা গানবাজনা শোনে, সে উজ্জীবন যতটা চায়, হয়তো শুশ্রূষা তার চেয়ে বেশি। ঢাকের বাজনা পুজোর মণ্ডপে যত ভালই লাগুক, সারা দিনের পর ক্লান্ত শরীর একটু এলিয়ে দিয়ে কেউ ঢাকের বাদ্য শুনতে চাইবে বলে মনে হয় না। ঘরের আলো নিভিয়ে, একা কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে বা সেলফোনের স্পিকারের আওয়াজ একটু কমিয়ে আজ যাঁরা গান শোনেন, সচেতন ভাবে না হলেও অবচেতনে তাঁদের আত্মা চায় সুরের শুশ্রূষা। পান্নালালের গলার আওয়াজেই ছিল শুশ্রূষা: ‘ছিল নির্মলেন্দু চৌধুরি তাঁর গলার আওয়াজ মুক্ত দেদার নদীর মতো/ ছিল পান্নালালের শান্ত মিঠে গলায় বুকের বাস্তুভিটে শান্তি পেত।’
শান্ত মিঠে। ন্যাকান্যাকা, ইন্টিমিন্টি-এসো-হামি-দিই নয়। পুরুষালি কণ্ঠে বুকের বাস্তুভিটের শুশ্রূষা আকাশবাণীর অনুষ্ঠানে শোনা যেত, শোনা যেত পান্নালালের গান— শ্যামাসংগীত, আধুনিক দুই-ই। সাবলীল, সাধা-গলায়, আত্মবিশ্বাসপূর্ণ স্বরপ্রক্ষেপে, আলংকারিক গায়কির যাবতীয় প্রদর্শনী এড়িয়ে পরিমিত কারুকাজ লাগিয়ে এক ঈর্ষণীয় সুঠাম মাধুর্য রক্ষা করে পান্নালাল আকাশবাণীর প্রতিটি অনুষ্ঠানে যে ভাবে গাইতেন, একই ভাবে গাইতেন গ্রামোফোন রেকর্ডিংয়ে। পান্নালাল বলতেই যাঁরা শুধু শ্যামাসংগীত ভাবেন, তাঁরা অনুগ্রহ করে তাঁর গাওয়া আধুনিক গান শুনে দেখবেন: ‘রুপালি চাঁদ জাদু জানে’, ‘ও আমার কাজল পাখি’, ‘তোমার মতন আমিও তো কত সয়েছি।’
শ্যামাসংগীতের আর এক বিরাট শিল্পী (আধুনিক গানেও যাঁর কিংবদন্তিসুলভ দক্ষতা) ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর গাওয়া ‘মুক্ত কর মা মুক্তকেশী’র মতো পান্নালালের গাওয়া শ্যামাসংগীতগুলি আমাদের সংগীতজীবন থেকে হারিয়েই গিয়েছে। হয়তো হারিয়ে যাওয়ারই ছিল। তাও স্মৃতি আগলে আছি— আগলে আছি সুর আর শুশ্রূষা। |