|
|
|
|
|
|
|
আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর |
শারদ্বত মান্না |
রাত্রের কলেজ স্ট্রিট এমনিতেই শুনশান। নির্ধারিত সময়ের আধ ঘণ্টা পরে যখন পৌঁছনো গেল, তিনি দাঁড়িয়ে। ধুতি-চাদর এবং বিখ্যাত চটি হঠাৎ বেমানান লাগে। থমথমে গাম্ভীর্য বিরক্তির না সহজাত, ত্রিফলা আলোয় ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
প্রতিবেদক: আচ্ছা এই যে গল্পগুলো, আপনি ল্যাম্পপোস্টে টিকি বেঁধে পড়তেন, মায়ের টানে দামোদর পেরিয়েছিলেন— এইগুলো শুনে আপনার হাসি পায় না গর্ব হয়?
বিদ্যাসাগর: এগুলোকে তথ্যগত ভাবে না দেখে, সত্যগত ভাবে দেখতে হবে। ল্যাম্পপোস্টে বাঁধার মতো লম্বা টিকি আমার ছিল কি না, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল, আমার পড়াশোনার প্রতি এতটা অসম্ভব নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় ছিল, তার প্রতি শ্রদ্ধায় লোকে গল্পটা যুগ যুগ ধরে বলেছে ও বলছে। দামোদর সত্যি পেরিয়েছিলাম কি না, সেটা গৌণ। অবশ্যই পেরোইনি। কিন্তু লোকে বিশ্বাস করতে ভালবাসত, বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তি এমনই, সে মায়ের জন্য এটাও করতে পারে। এই মিথগুলোর সন-তারিখ হিসেব না করে তাই এগুলোর স্পিরিটটাকে বুঝতে হবে।
প্রতি: বেশ, এ বার মিথ নয়, একটা হার্ড ফ্যাক্ট বলি। আপনার মূর্তির মুন্ডু কেটে ফেলা হয়েছিল। কেমন লেগেছিল?
বিদ্যাসাগর: খুব খারাপ লাগেনি। আমাকে তার মানে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার প্রতীক ধরা হয়েছিল। কম কী? আইকন যে হবে, তাকে প্রবল স্তুতি ও তীব্র আক্রমণ— দুটোর জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। এই তো এক জন বাঘা পণ্ডিত আমার বর্ণপরিচয়ের গোপাল-রাখালের গল্পগুলোর মধ্যে পেল্লায় সব অভিসন্ধি খুঁজে বের করেছেন। আসলে তখন গড়ার নেশায়, কাজের রোখে কাজ করে গিয়েছিলাম। অতটা নিজের কাজের মানে তো বুঝিনি। আজ যদি কেউ সেই কাজের মর্ম কেটেছিঁড়ে দেখান যে ব্যাপারটা ভাল ছিল না, অল্প কষ্ট হয়তো হয়, কিন্তু অনেক বেশি শ্লাঘা হয় এই ভেবে যে কাজগুলো এখনও লোকের কাছে আলোচনার যোগ্য ও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ থেকে গেছে। |
|
বিদ্যাসাগর, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত ভয়ে, শ্রদ্ধায় ও রোমাঞ্চে কেঁপে যাওয়ায়, ছবিটা নড়ে গেছে। |
প্রতি: এখনও আগের মতোই পোশাকআশাক বয়ে চলেছেন—আধুনিক হতে ইচ্ছে করেনি?
বিদ্যাসাগর: দ্যাখ ভাই, যে যুগে ধর্ম বাদ দিয়ে নীতিশিক্ষা কল্পনায় আসে না, সে যুগে ধর্ম-প্রভাব বর্জিত ‘বর্ণপরিচয়’ লিখেছি, তাতে নীতিশিক্ষাও দিয়েছি। কোটি লোকের নিন্দেমন্দ সয়ে মেয়েদের ইস্কুলে পাঠানোর বন্দোবস্ত করেছি। বিধবাবিবাহ কেবল আইন করে চালু করিনি, নিজের ছেলেরও বিধবার সঙ্গেই বিয়ে দিয়েছি। বহুবিবাহ বন্ধের জন্যও উঠেপড়ে লেগেছিলাম। সংস্কৃতে মন্দ ছাত্র ছিলাম না, তবুও মন্ত্রে বিশ্বাস ছিল না বলে সন্ধ্যামন্ত্রই ভুলে গিয়েছিলাম, বড় হওয়ার পর আহ্নিকও করিনি। প্রতিপদ-অষ্টমীতে সংস্কৃত পাঠ নিষেধ বলে সংস্কৃত কলেজ বন্ধ থাকত, আমি সেখানে রোববার ছুটি চালু করেছি। গোঁড়াদের সঙ্গে তর্ক করে শূদ্রদের সংস্কৃত পড়ার অধিকার দিয়েছি। রাজপুরুষদের সঙ্গে সর্ব ক্ষণ ওঠাবসা করেও নিজস্বতাটুকু ছাড়িনি। এত কাজ সামলাতে সামলাতে আর তোর মতো আধুনিক হয়ে ওঠা হয়নি। আপশোসও নেই।
প্রতি: ইয়ে, অমন করে বলবেন না। বড্ড লাগে। আপনি তো দয়ারও সাগর।
বিদ্যাসাগর: সেই জন্যেই তো আধ ঘণ্টা দেরি করে এলেও গাঁট্টা খাসনি। তবে, আমাকে এই দয়ার সাগর ভেবে সুখ পাওয়ার সুবিধেটা অসামান্য ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমার স্মরণসভার বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের লোকেরা এক দিক দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন না করে থাকতে পারেননি বটে, কিন্তু বিদ্যাসাগর তাঁর চরিত্রের যে মহত্ত্বগুণে দেশাচারের দুর্গ নির্ভয়ে আক্রমণ করতে পেরেছিলেন, সেটাকে কেবলমাত্র তাঁর দয়াদাক্ষিণ্যের খ্যাতি দ্বারা তাঁরা ঢেকে রাখতে চান। অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের যেটি সকলের চেয়ে বড় পরিচয়, সেইটিই তাঁর দেশবাসীরা তিরস্করণীর দ্বারা লুকিয়ে রাখবার চেষ্টা করেছেন।’ ব্রাভো! আমি যে দুর্দান্ত কালাপাহাড়ি ভাঙচুরটা করলাম, সেটাকে কান্নার সানাই দিয়ে ঢেকে দেওয়ার এই ন্যাকামো ও ধাস্টামো আর কে এমন ধরে দেবে!
প্রতি: তা হতে পারে, কিন্তু আপনার মনের কোমলতাটাও তো অবিশ্বাস্য। নারীদের জন্যে সারা জীবন লড়লেন। কিন্তু এখন চারিদিকে ধর্ষণ, নিগ্রহ এবং তার পর শভিনিস্টদের বেয়াড়া মন্তব্য। নিজেকে বিফল মনে হয় না?
বিদ্যাসাগর: চেষ্টাগুলো যে মোটামুটি বিফলেই যাচ্ছে, সেটা বোঝার জন্য আমাকে এত দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। জীবনের শেষ দিকেই বুঝতে পেরেছিলাম, আমার মতো তেজীয়ান লোকের কাজগুলো ধারণ করার খ্যামতা এই কুঁড়ের বাদশা ও মেনিমুখো জাতের নেই। এরা যাদের পুজো করে খোল-কত্তাল বাজিয়ে ফাটিয়ে দেবে, তাদের কথা একটা বর্ণও পালন করবে না। তাই ধুত্তোর বলে কর্মাটাঁড় চলে গিয়েছিলাম। তবে, নারী নির্যাতন এখন একই রকম নেই, বদলেছে। তখন পুরুষতন্ত্র মেয়েদের পায়ের নীচে রাখত, বিনিময়ে তাদের খাওয়া-পরার ভার পুরুষরাই নিত। এটা দাসব্যবসার মতোই জঘন্য অন্যায়। কিন্তু সেই অন্যায়ের একটা স্পষ্টতা ছিল। এখন ব্যাপারটা গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে— সবাই সমান— তার পর মেয়ে ধর্ষিতা হলে তার রাত্তিরবেলা ছেলেদের সঙ্গে মিশে মদ খাওয়ার অভ্যাস নিয়ে মন্ত্রীমশাই কটাক্ষ করছেন টিভি চ্যানেলে। এই শয়তানিটা কখনও কখনও বেশি নোংরা মনে হয়।
প্রতি: আর শিক্ষার ব্যাপারটা কেমন বুঝছেন? ছাত্ররা তো এখন রেগুলার শিক্ষকদের ঘিরে ধরে খিস্তি করে, গায়েও হাত তোলে।
বিদ্যাসাগর: হ্যাঁ, ছাত্ররা দেখছি তাদের অধিকারগুলো সম্পর্কে দারুণ সচেতন হয়ে পড়েছে। ক্যাম্পাসে ড্রাগ খাওয়ার স্বাধীনতা, ফেল করেও পরের ক্লাসে উঠে যাওয়ার স্বাধীনতা, পরীক্ষায় টোকাটুকির স্বাধীনতা, র্যাগিং করেও পার পেয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা— এইগুলো নিয়ে এদের ধারণা বেশ তকতকে পরিষ্কার। পড়ার বইয়ের সেকেন্ড চ্যাপটার নিয়ে প্রশ্ন করলে অবশ্য দেখা যাবে সেই বিষয়ে ধারণাটা অতটা স্বচ্ছ হয়ে ওঠেনি। তোতলাচ্ছে। এই জিনিসগুলো নিয়ে মুহুর্মুহু আন্দোলনে ব্যস্ত থাকতে গিয়ে বেচারারা হয়তো পড়ার টাইমটা বের করতে পারেনি।
প্রতি: আপনি অথরিটি হলে কী করতেন?
বিদ্যাসাগর: সম্ভবত কলেজ বন্ধ করে দিতাম। তবে আমার সময় লোকে বিদ্যাকে সম্মান করত। সুবিধে ছিল। এখন তো আর তা নেই, রাজনীতির লোকেরা আমায় ঘাড়ে ধরে বের করে দিত আর বলত এই গোঁয়ার্তুমি প্রতিক্রিয়াশীল। ছাত্ররাও ভয়ানক পেটাত। বেশ কিছু পণ্ডিত ছাত্রদের মারধরকে গ্লোরিফাই করে বক্তৃতা দিতেন। যে কোনও কর্তৃপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করাই তাঁদের কাছে বিপ্লবের মাসতুতো ভাই।
প্রতি: যাঃ, তা হলে সবই জলে গেল বলছেন?
বিদ্যাসাগর: তা কেন? আমার চালু করা কমা-দাঁড়ি এখনও চলছে। আমার নামে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকী সেতু! বর্ণপরিচয়ের নামে একটা শপিং মল-ও হচ্ছে না? এর চেয়ে বড় শ্রদ্ধাজ্ঞাপন তোদের কাছ থেকে আশা করলে তো আমার নাম মুখ্যুসাগর হত! |
|
|
|
|
|