নিগৃহীতা মেয়েরা এগিয়ে আসছেন। সমাজ, রাষ্ট্র অনেক পিছিয়ে। আগামী কাল
শুরু হচ্ছে নারীর উপর হিংসা প্রতিরোধী পক্ষ। জেগে ওঠার সময়।
শাশ্বতী ঘোষ |
আমরা এগোচ্ছিই। হয়তো ধীরে, হয়তো সর্বত্র নয়, হয়তো বা নীরবে। ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বরের আসন্ন নারীপক্ষে এই আমাদের অনুভব। হিংসার ঘটনা যে কমছে তা নয়, আবার ফিরে আসছে ১৬ ডিসেম্বরে দিল্লিতে নির্ভয়ার উপর অত্যাচারের দিনটি, তবু ভয়ের কুয়াশা আর আমাদের ঢেকে ফেলতে পারছে না। তাই মুম্বইয়ের চিত্রসাংবাদিক বলেন আবার নিজের কাজের জায়গায়, একই ধরনের কাজের দায়িত্বে ফেরার কথা, নাবালিকা পরিচারিকার মা পাকা বাড়ির বাসিন্দা গৃহকর্তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করতে এগিয়ে আসেন। যৌননিগ্রহ ঘটলে মেয়েদের বিরুদ্ধে যা যা বলা হয়, তা নিয়ে ‘সব তো আমাদের দোষ’ নামের বিদ্রুপাত্মক ভিডিয়ো ইউটিউবে দেওয়ার তিন দিনের মধ্যে ১৫ লক্ষ মানুষ তা দেখেন, মন্তব্য জানান ছ’হাজার দর্শক। ‘ছি ছি এ কী লজ্জা’ বলে চুপ থাকার দিন কি তবে শেষ হল?
১৬ ডিসেম্বর ২০১২ দিল্লির বাসে গণধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক দিকে সরকার আর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, অন্য দিকে সমাজের ঔদাসীন্য হাজার হাজার নারী ও পুরুষ, বিশেষত তরুণ প্রজন্মকে রাস্তায় টেনে এনেছিল, শান্তিপূর্ণ অবস্থান ভাঙতে গেলে পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাওয়া, পরিবারকে সাহায্য করতে চাওয়া, পেশাদার হতে চাওয়া মেয়েরা যেমন সে দিন নিগৃহীতা মেয়েটির মধ্যে নিজেদের ছবি দেখে একাত্ম বোধ করেন, তেমনই নিগৃহীত বন্ধুটির বান্ধবীকে বাঁচাতে চাওয়া এবং ব্যর্থ হওয়া বহু তরুণকে নিজেদের পৌরুষ আর তার সমাজচলতি সংজ্ঞা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। |
তাই হয়তো আবেগ এত জোরদার, প্রতিবাদ এত সর্বব্যাপী হয়েছিল। ফলে অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম ২০১৩ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে ১০০০ কোটি টাকার নির্ভয়া তহবিলের কথা বলেছেন, রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন গেছে, জনমত তৈরি করা হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বরকে নির্ভয়া দিবস হিসেবে পালন করার। স্বাভাবিক ভাবেই এ বারে ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর, নারীনির্যাতনবিরোধী পক্ষকালে বার বার আসবে ১৬ ডিসেম্বরের ঘটনা, তার প্রেক্ষিতে সংশোধিত নতুন নারীনির্যাতন বিরোধী ফৌজদারি আইনের রূপায়ণ, তার জন্য পরিকাঠামো তৈরি বা প্রসার, সে জন্য বাজেট বরাদ্দ এই সব প্রশ্ন। নীতি রূপায়ণ সীমাবদ্ধ বলেই যে মেয়েরা এগিয়েও আসছেন, সুবিচার তাঁদের অধরাই থেকে যাচ্ছে। সমাজের মেয়েদের দেখার চোখ কবে বদলাবে, সে প্রসঙ্গও আসবে। তাই এই পক্ষকালের প্রচারের সঙ্গেই অনেক জায়গায় এক হয়ে যাবে ১৬ ডিসেম্বর, নারীনিগ্রহের বিরুদ্ধে আমাদের সরকার আর সমাজ কতটা দায়বদ্ধ, যে মেয়েরা এগিয়ে আসছেন, তাঁদের কতটা সহায়তা দিচ্ছে, আদৌ দিচ্ছে কি না, তার হিসেবনিকেশ করবেন অনেকেই।
সরকার আর প্রশাসনের দায়বদ্ধতার প্রশ্নে অবশ্যই প্রথম কাঠগড়ায় উঠবে পুলিশ। ১৬ ডিসেম্বরের ঘটনার পর এক পত্রিকার দুই সাংবাদিক নিজেদের পরিচয় গোপন করে দিল্লির তিরিশ জনের বেশি উচ্চপদের পুলিশকর্তার সঙ্গে কথা বলে দেখেন, বেশির ভাগ বিশ্বাস করেন অধিকাংশ ধর্ষণের অভিযোগ মিথ্যে, টাকাপয়সার ঝামেলা বা ‘খারাপ চরিত্র’র মেয়েদের আনা। দিল্লি পুলিশ, উত্তর ভারত বা গোবলয় এ সব বলে ব্যাপারটাকে হালকা করা যাবে না। খোদ পশ্চিমবঙ্গে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ আনার পর সেটিকে সম্মতিতে সহবাস বলে ‘উপভোগ করেছেন’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন জেলার পুলিশকর্তা। পুলিশের দায়িত্ব, অভিযোগ নথিভুক্ত করা, এজাহার নেওয়া আইন সব কিছু নির্দিষ্ট করে দিলেও, এখনও অভিযোগ না নেওয়া, চাপ এলে তবে অভিযোগ নেওয়া, মিটিয়ে নিতে বলা, সবই অব্যাহত। মেয়েরা এগিয়ে আসছেন। কিন্তু পুলিশ অভিযোগ না নেওয়ায় বা পরিবারকে ভয় দেখানোয় হতাশ মেয়েরা এমনকী অভিভাবকরা আত্মহত্যাও করেছেন পাটিয়ালা (ডিসেম্বর ২০১২), শোনেপত (মে ২০১৩), ঝাড়খণ্ড (সেপ্টেম্বর ২০১৩), আসানসোল (সেপ্টেম্বর ২০১৩) মৃত্যুর মিছিল চলছে।
মেয়েরা এগিয়ে এলেও প্রশাসনিক ব্যর্থতার ফলে কী হতে পারে, তার চরম উদাহরণ পাটিয়ালার ছাত্রীটি। ১৬ ডিসেম্বরের ঘটনায় দেশ তোলপাড় হওয়ার আগে ১৩ নভেম্বর দিওয়ালির রাতে দু’জন পুরুষ এই সপ্তদশী ছাত্রীকে অপহরণ করে বিস্তীর্ণ খেতের মাঝে একটি সেচপাম্পের ঘরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। সহযোগী ছিল একটি মেয়ে। নিগৃহীতার পরিবার পঞ্চায়েত প্রধানকে নিয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযোগ জানাতে যায় ১৯ নভেম্বর। ২১ নভেম্বর ‘সুবিচার চাই’ বলে মেয়েটি পাটিয়ালার এক টিভি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দেয়। হুমকি আরও বেড়ে যায়। পুলিশ এক সপ্তাহ পরে ২৭ নভেম্বর ডাক্তারি পরীক্ষার নির্দেশ দেয়। এর মধ্যে মেয়েটিকে ও তার পরিবারকে মিটমাট করে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হতে থাকে। অভিযুক্তরা বলে, তারা মেয়েটির পণের টাকা দিয়ে দেবে, অবিলম্বে তার বিয়ে দিয়ে দিতে। পুলিশ বলে, অভিযোগ তুলে না নিলে তার ও তার মায়ের বিরুদ্ধে বারবনিতাবৃত্তির মামলা দেওয়া হবে। কিছু দূরে এক আত্মীয়বাড়িতে মেয়েটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার পরেও কেউ গ্রেফতার হল কি না জানতে সে রোজ ফোন করত। ২৬ ডিসেম্বর সে আত্মহত্যা করে, নোটে লিখে যায় সব কিছু। চ্যানেলটি তার সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করে ২৭ ডিসেম্বর। তার পর ছ’জন গ্রেফতার, দুই পুলিশ আধিকারিক সাসপেন্ড, তদন্তে মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ কমিটি গঠন। তখনও দিল্লি গণধর্ষণের নিগৃহীতা বেঁচে। জীবন যে সবচেয়ে দামি, নিগ্রহের থেকেও, নিগৃহীতা হয়ে বেঁচে থাকা লড়াই করার জন্যই সেই কথা, সেই পরম আশ্বাস পাটিয়ালার ছাত্রীটিকে কেউ দিয়ে উঠতে পারেনি। পরিবার, রাজনৈতিক দল, পঞ্চায়েত বা পুলিশ প্রশাসন, কেউ না।
যে মেয়েরা এগিয়ে আসছেন, তাঁদের আর এক প্রয়োজনীয় সহায়তা হল ফরেনসিক পরীক্ষার ফলাফল। দিল্লি বা মুম্বই মামলার তদন্তপ্রক্রিয়া দৃষ্টান্ত তৈর করার মতো দ্রুত ঘটলেও কামদুনিতে দেখলাম, ফরেনসিক পরীক্ষার ফলাফল যথাসময়ে না আসায় চার্জশিট দায়ের করতে দেরি। ২০১২ সালের অগস্ট মাসে শক্তিবাহিনী বলে দিল্লির একটি সংগঠন জেলা আদালতের ৪০টি ধর্ষণ মামলার রায় বিশ্লেষণ করে দেখে, যে ক’টিতে অভিযুক্তরা ছাড় পেয়ে গেছে, তার অর্ধেকের বেশি ক্ষেত্রে পুলিশ প্রয়োজনীয় তদন্তই করেনি। সাক্ষ্যপ্রমাণ বা সাক্ষী জোগাড় না করার জন্য বিচারকরা তদন্তকারী অফিসারদের ভর্ৎসনা পর্যন্ত করেছেন। দিল্লি সরকার, জাগোরী ও ইউ এন উইমেন-এর করা এক সমীক্ষায় অধিকাংশ পুরুষই বলেন, নারী নিগ্রহের ঘটনা দেখলেও তাঁরা প্রতিরোধ করতে এগিয়ে যাবেন না। প্রশাসন সক্রিয় না হলে, শাস্তিদানের হার না বাড়লে এ ঔদাসীন্য কমবে না। আমরা আর কোনও আত্মঘাতী আমিনুল চাই না। নিগৃহীতা মেয়েরা এগিয়ে আসছেন, মুখ খুলছেন। এখন চাই সক্রিয় প্রশাসন আর উদ্যোগী সমাজ। মেয়েরা এগোচ্ছে, সমাজ, রাষ্ট্র এগোবে না? |