প্রবন্ধ ২...
দর্শক ‘হয়ে ওঠা’ও শিখতে হয়
নিশতম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শেষ হল। আট দিন সিনেমাকে দিয়ে কলকাতাবাসী ধন্য হলেন। পয়লা দিন উদ্বোধনে যাঁরা সিট পাননি, হাহাকার চেপে বাকি দিনগুলো লাইনে ভুবন, থুড়ি, নন্দন-রবীন্দ্রসদন ভরিয়েছেন। কান চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা ছবি ‘ব্লু ইজ দ্য ওয়ার্মেস্ট কালার’ আর ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘সানগ্লাস’ দেখতে লাইন ছুঁয়েছিল এক্সাইড মোড়। ন’শো একত্রিশ আসনের প্রেক্ষাগৃহে একটি ছবি দেখার জন্য দু’ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে পনেরো থেকে পঁচাত্তর, রোজ সন্ধেয় নন্দন দুইয়ে উপচে পড়া ভিড়। কর্তৃপক্ষ কলার তুলতেই পারেন। ছবির জন্য এই ক্রেজ দেখাতে পারে কলকাতাই। আমন্ত্রিত যে বিদেশি ছবি-করিয়ে উৎসব চত্বরে হাঁটছিলেন, তাঁর চোখমুখের অস্ফুট মুগ্ধতা বলছিল, স্যালুট!
যে কোনও উৎসব পূর্ণতা পায় সাধারণের সম্মিলনে, সকলের অংশগ্রহণে। চলচ্চিত্র উৎসবে শুধু গম্ভীর ছবি-বোদ্ধা বা ইন্ডাস্ট্রির নয়া যোদ্ধারাই ভিড় জমান না। আসেন ছাত্রছাত্রী, গৃহবধূ, রিটায়ার্ড শিক্ষক, অফিস-ফেরত শ্বাস নিতে চাওয়া আই টি প্রফেশনাল, এলআইসি এজেন্ট, এক বেলা বিক্রিবাটা বন্ধ রাখা দোকানদার। সবার মানসিক, সামাজিক গড়ন আলাদা, চাওয়া নানাবিধ।
এঁরা যখন ছবি দেখতে ভিড় জমান, তখন ধরে নেওয়াই যায়, চলচ্চিত্র নিয়ে এঁদের একটা ভাল-লাগা আছে, ইন্দোনেশিয়া মিশর বা আইসল্যান্ড-এর যে ছবি হয়তো সারা জীবনেই আর দেখার সুযোগ মিলবে না, তা নিয়ে একটা ঔৎসুক্য আছে। নইলে একটা ছবির এন্ড টাইট্ল শেষ না হতেই এঁরা দৌড়ে পরের ছবির লাইন দেবেন কেন, পিলপিল লাইনে চেনামুখ কাউকে দেখে ‘দাঁড়াচ্ছি, হ্যাঁ?’ বলে ঢুকে পড়বেন কেন, পাঁচ টাকার বিস্কুট আর জলের বোতল ব্যাগ থেকে বের করে সোনামুখ করে কেন সারবেন ওয়ার্কিং লাঞ্চ! কী অপার টান, একটা ছবির জন্য!
সত্যিই কি টান? কে কী চাইছেন, কেন লাইনে দাঁড়াচ্ছেন, দুদ্দাড় হলে ঢুকে ব্যাগ-রুমাল-জলের বোতল দিয়ে জায়গা আগলাচ্ছেন বাথরুমে যাওয়া বন্ধুর জন্য, সত্যি জানেন? উৎসব-চত্বরে ওপ্ন সিক্রেট, কোন ছবি ‘অন্য রকম’। তাই কি ভিড় চারিয়ে যায় রাস্তায়? সে জন্যেই একটা হলে পর পর দুটো শো-য় ওই ছবিটাই? ছবির লাইনে অপেক্ষমাণ জনৈক দর্শক সেই দৃশ্যের সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক-নান্দনিক তথ্য-তত্ত্ব বলে যাচ্ছেন, উত্তেজিত। পাশে উৎকর্ণ জটলা: ‘কত্ত জানেন তাই না, কিন্তু কোনও গর্ব নেই!’ হল-এ তো দেখবই, এখন শুনে রাখি, মেলাতে সুবিধে। এক জন বেরিয়ে বললেন, আমার মেয়েটা এই ছবি দেখতে চেয়েছিল, কী ভাগ্যি আসতে দিইনি! নিজে একটা শটও ছাড়েননি। কিছু লোকের কাজ: ছবি নয়, সেলেব্রিটি দেখা। বিকেল থেকে রাত অবধি হলের সামনে হা।ঁ বচ্চনকে পেলুম না, বাহা-ই সই। পঞ্চকন্যে অগোচর, সিরিয়ালপ্রপঞ্চই দেখে যাই। আরও আছেন। এপিক ছবির পরদা-ভরানো মৃত সৈনিকের মতো প্রাঙ্গণ-ভরানো দর্শক। কাজ, স্রেফ উৎসবের রোদ পোয়ানো। ক্ষেত্র ফিল্মোৎসবই হোক, বইমেলা, বা হস্তশিল্পমেলা।
এ সবই যে খারাপ, তা নয়। উৎসবের আবহে যে কেউ যা কিছু মোটিভ নিয়ে আসতেই পারেন। তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু উৎসবের যেমন একটা মেজাজ থাকে, তেমনই একটা আচরণবিধিও থাকে। যাকে ‘এটিকেট’ বলি। উচ্চমার্গের শিল্প-অভিজ্ঞতা নিতে গেলে, তার প্রতি শ্রদ্ধায় যে আদব মানতে হয়। যার গোড়ার কথা, আমি একটা ছবি দেখতে ঢুকছি, মানে আমি এই দু’ঘণ্টা ছবিটাতেই মন দেব। সময়ে ঢুকব, বেরোবও। লাস্ট দুটো সিন আগেই কী হতে চলেছে জেনে যাওয়া মাত্র পরের শো-য় লাইন দিতে পাঁইপাঁই ছুটব না। কলকাতার দর্শক জানেনই না, বিশ্বাসও করতে পারেন না যে ছবি দেখারও কোনও সহবত আছে, বা থাকতে পারে। এঁরা ধরেই নেন, আমার কার্ড আছে, মানে যখন খুশি হল-এ ঢুকব। মোবাইল সাইলেন্ট করব না, ডিসপ্লের ব্রাইটনেস কমাব না (কমাতে জানিও না)। এসএমএস করব লালনীল আলো সহদর্শকের চোখে ফেলে। ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে ফিশফ্রাই খাব। কল এলে ধরব তো বটেই, জোরে কথা বলব। অন্য কেউ কথা বললে ধুয়ে দেব, আবার অমুকের তমুককে বলা গালাগাল শুনে হাসব। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিচ্ছু বলব না, চুপচাপ সয়ে যাব। আমি কলকাতা চলচ্চিত্রোৎসবের দর্শক। আমোদগেঁড়ে ও সর্বংসহা।
এত সবের মধ্যে ছবিটা, ছবি দেখাটা, হারিয়ে যায়। কারণ আমরা কেউ ‘দর্শক’ই নই। সমঝদার হওয়া তো পরের কথা। যে কোনও শিল্প-অভিজ্ঞতারই দর্শক ‘হয়ে উঠতে’ হয়। তার জন্য জ্ঞানগম্যিরও দরকার পড়ে খানিক। টি এস এলিয়ট যেমন কবিতায় আচমকা জার্মান বা সংস্কৃত শব্দ ঢুকিয়ে দেন, অমিতাভ ঘোষের উপন্যাসে মস্তানি নিয়ে রাজ করে কথ্য বাংলার বোলচাল, বই-শেষের গ্লসারি ছাড়াই। মানে, এ এমন সাহিত্য, পড়তে-বুঝতে গেলে পাঠককে ‘নলেজেব্ল’ হতে হবে, জানার ও বোঝার একটা মন থাকতে হবে। আজকের বাঙালি জ্ঞানে এত দীন, মনে এত হীন যে, শিল্পের অন্তরমহলে ঢোকার পরীক্ষাতেই সে ডাহা ফেল।
ফিল্মোৎসব তো উদাহরণ মাত্র। যে কোনও উৎসবে তার রিপিট কদাচরণ। রাজা আসেন, রাজা উৎসব ঘোষণা করেন, ব্যবস্থাপনার যত খামতি বাঙালির আন্তরিকতার দোহাই পেড়ে ঢাকেন। আমরাও ভুলে থাকি, উৎসবদ্বারে লাইন লাগাই, গেট খুললেই হু-হা ছুটে সিটটা নিতে হবে তো!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.