|
|
|
|
বিধির কড়াকড়ি, তবু হেনস্থার শিকার কর্মরতারা |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
মোবাইলে একের পর এক মেসেজ। তাতে পাত্তা না পেয়ে অফিসের মধ্যেই অধস্তন মহিলা কর্মীর গায়ে হাত দিচ্ছিলেন ‘বস’। তা দেখে চিৎকার করে উঠলেন অফিসেরই এক পুরুষ কর্মী।
কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হেনস্থা ঠেকাতে টিভির চ্যানেলে-চ্যানেলে কেন্দ্রীয় সরকারের এই বিজ্ঞাপন ইদানীং নজরে পড়ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে কর্পোরেট অফিস, যৌন হেনস্থার শিকার হচ্ছেন বহু মহিলাই। সম্প্রতি তহেলকা সম্পাদক তরুণ তেজপালের বিরুদ্ধে সহকর্মীকে যৌন নিগ্রহ করার অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে ফের সরব হয়েছে বিভিন্ন মহল।
বিভিন্ন পেশায় কর্মরত মহিলারা বলছেন, পুরুষ সহকর্মীরা যে সব সময় শারীরিক হেনস্থা করেন, এমন নয়। কিন্তু অশ্লীল মন্তব্য বা কুপ্রস্তাব দেওয়ার মতো ঘটনা বিরল নয়। সে সব উপেক্ষা করলে কর্মক্ষেত্রে নানা রকম বাধা আসে। এমনই এক ঘটনার শিকার বছর সাতাশের এক যুবতী। কাজ করতেন একটি বেসরকারি সংস্থায়। এক ‘সিনিয়র’-এর কুপ্রস্তাবকে আমল না দেওয়ায় পদে পদে অসুবিধায় পড়তে হয় তাঁকে। শেষ পর্যন্ত ওই সংস্থা ছাড়তে বাধ্য হন ওই যুবতী।
কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হেনস্থার কথা মাথায় রেখে বিশেষ সেল গড়ছে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা। এমনকী, সংসদেও মহিলাদের অভিযোগ জানানোর জন্য ‘গ্রিভ্যান্স সেল’ খোলা হয়েছে। শনিবার কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে লোকসভার অধ্যক্ষ মীরা কুমার এ কথা জানিয়ে বলেন, “সব কর্মক্ষেত্রেই এই ধরনের ‘সেল’ থাকার প্রয়োজন রয়েছে। সমাজের দায়বদ্ধতা না এলে শুধু আইন করে মহিলাদের যৌন নিগ্রহ আটকানো যাবে না।” বিষয়টির সঙ্গে একমত ন্যাসকমের ভাইস প্রেসিডেন্ট সঙ্গীতা গুপ্ত-ও। তিনি বলেন, “ন্যাসকমের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নিরন্তর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সচেতনতা বাড়াতে মহিলা ও পুরুষ কর্মীদের নিয়ে কর্মশালা হচ্ছে।”
মাইক্রোসফট রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের জনসংযোগ প্রধান দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘শুধু আইনি ব্যবস্থা থাকাই যথেষ্ট নয়। সেই আইন কার্যকর হল কি না, সেই ব্যাপারে নজরদারি দরকার।” তাঁর মতে, এই সমস্যা ঠেকাতে অফিসের চতুর্থ শ্রেণীর মহিলা কর্মীর সঙ্গে কথা বলা বেশি জরুরি। কারণ, অভিযোগ জানানো নিয়ে তাঁদের ভয় বেশি থাকে। |
|
গুগল ইন্ডিয়ার পাবলিক অ্যাফেয়ার্স শাখার প্রধান পরমা রায়চৌধুরীর বক্তব্য, কর্পোরেট সংস্থা, বিশেষত বহুজাতিক সংস্থাগুলিতে মেয়েদের হেনস্থা ঠেকানোর রক্ষাকবচ ঢের আঁটোসাঁটো। কিন্তু তা সত্ত্বেও মেয়েদের বিষয়ে অনেকেরই অবচেতনে কিছু গোঁড়ামি বা ভুল ধারণা কাজ করে। কোনও
সংস্থার শীর্ষস্তর থেকে নিচুতলায় হেনস্থার ঘটনাকে কর্পোরেট পরিভাষায় ‘চেন অফ কম্যান্ড হ্যারাসমেন্ট’ বলা হয়। পরমার কথায়, “মেয়েরা ভয় না পেয়ে প্রতিবাদ করলে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানো যায়।” তরুণ তেজপালের ঘটনায় অভিযোগকারিণীর প্রতিবাদের সাহসকেও কুর্নিশ করেছেন পরমা।
সরকারি অফিসগুলিতেও মাঝেমধ্যেই মহিলা কর্মীদের হেনস্থার অভিযোগ ওঠে। আইনজীবী মহলেও মহিলাদের মাঝেমধ্যে কটূ মন্তব্যের মুখে পড়তে হয়। কলকাতার এক মহিলা ফৌজদারি আইনজীবী বলছিলেন, “বিচারক পক্ষে রায় দিলে কখনও শুনতে হয়, ‘মহিলা তো, তাই জজসাহেব মুখ দেখে রায় দিয়েছেন।’’
মহিলা সহকর্মীদের প্রতি হেনস্থার অভিযোগ মেলে পুলিশের অন্দরেও। সম্প্রতি কলকাতা এবং বিধাননগর পুলিশের দুই ওসি-র বিরুদ্ধেও মহিলা সহকর্মীকে কুপ্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। লালবাজারের এক মহিলা অফিসার অবশ্য এ-ও বলছেন, পুলিশের মতো চাকরিতে মেয়েদেরও বেশি স্পর্শকাতর হওয়া উচিত নয়। পুলিশে অনেক ক্ষেত্রেই ছেলে বা মেয়েদের একই রকম কড়া ভাষায় বলা হয়। সেটা মানিয়ে নেওয়ার মতো কাঠিন্য মেয়েদের থাকা চাই। লালবাজার সূত্রের অবশ্য দাবি, ইদানীং পুলিশের বিভিন্ন স্তরে তালিমের সময়ে মেয়েদের সঙ্গে কী ভাবে ব্যবহার করা উচিত তা
শেখানো হয়।
সমাজের নানা স্তরে মহিলারা নানা ভাবে হেনস্থার শিকার হলেও পুলিশে অভিযোগ দায়ের হওয়ার সংখ্যাটা বেশ কম। কিন্তু কেন? পুলিশের বক্তব্য, কর্মক্ষেত্রে বা তার বাইরে নানা সমস্যার কথা ভেবে যৌন হেনস্থার অভিযোগ জানাতে ভয় পান মহিলারা। বিশেষ করে, ঊর্ধ্বতনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালে বহু ক্ষেত্রেই চাকরি হারানোর আশঙ্কা থাকে। নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ বলেন, “একটি বেসরকারি সংস্থায় ঊর্ধ্বতন পুরুষ সহকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই চাকরি গিয়েছিল এক তরুণীর। চাকরি যাওয়ার সময় বেতনও দেওয়া হয়নি তাঁকে।”
শাশ্বতীদেবীর বক্তব্য, আদালতে সওয়াল-জবাবের সময়ও নানা অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় অভিযোগকারিণীকে। সম্প্রতি মুম্বইয়ে এক মহিলা চিত্র-সাংবাদিক ধর্ষণের মামলার সওয়াল-জবাবের সময় এমনই পরিস্থিতির জেরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন অভিযোগকারিণী।
তবে কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য ভুয়ো অভিযোগেরও প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। লালবাজারের একটি সূত্র জানিয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে প্রতিহিংসা মেটাতে এ ধরনের অভিযোগ করা হয়। পরমাও বলছেন, “যৌন হেনস্থা প্রমাণ হলে কড়া শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু দুভার্গ্যজনক ভাবে কয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, পেশাগত খামতি ঢাকতে মেয়েরা লিঙ্গ-বৈষম্যের অভিযোগকে ঢাল করছেন।” |
|
|
|
|
|