ইচ্ছে থাকলেও মকাইবাড়ি চা বাগানের বাংলোয় থাকতে পারেননি? যেতে পারেননি ডুয়ার্সের জুরান্তি চা বাগানের প্রাচীন বাংলোয়? অথবা সেলিম হিলের ডিরেক্টরস বাংলোর ‘রেস্ট শেড’-এ বসে মহানন্দা অভয়ারণ্যের বুনো জন্তুদের দল বেঁধে যাতায়াত দেখার সুযোগ পাননি?
মন খারাপের কিছু নেই।
চা-পর্যটনে জোর দিতে সরকারি প্রক্রিয়া শুরু হতেই পাহাড় ও সমতলের অন্তত ৩০টি চা বাগানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। খোদ রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী চা বাগান মালিক ও পর্যটন ব্যবসায়ীদের মধ্যে মেলবন্ধনের চেষ্টা করছেন। কারণ, চা বাগানের পাঁচ একর পর্যন্ত জমি পর্যটনের কাজেও ব্যবহার করতে দেওয়া হবে বলে সম্প্রতি রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার পরেই বিভিন্ন চা বাগান মালিক ও নানা পর্যটন সংস্থাও এ নিয়ে বিনিয়োগের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করছে।
পর্যটনমন্ত্রী বলেন, “যে পাঁচ একর জমি পর্যটনের কাজে ব্যবহার করা যাবে, তার মধ্যে এক একরে নির্মাণের অনুমতি মিলবে। বাকি জায়গা সৌন্দর্যায়নের জন্য ব্যবহার করা গেলেও কোনও পাকা নির্মাণ করা যাবে না। এতে পাহাড়, তরাই ও ডুয়ার্সের চা বাগানেও বহু পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে। রাজ্য সরকার লাইসেন্সও দেবে। ফলে, আগামী দিনে চা বাগানে অলিখিত ভাবে পর্যটন কেন্দ্র চালানোর প্রবণতা থাকবে না। আবার সরকারের রাজস্বও বাড়বে।” |
ডুয়ার্সে জুরান্তি চা বাগানের বাংলো। —নিজস্ব চিত্র। |
চা বাগানকে কেন্দ্র করে পর্যটন পরিকল্পনা নতুন নয়। তবে বাম আমলে চা বাগানের জমি পর্যটনে ব্যবহারের সম্মতি মেলেনি। ২০০৫-এ ডুয়ার্স সফরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মালিকদের সঙ্গে আলোচনার সময়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন। কিন্তু, তৎকালীন ভূমি সংস্কারমন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা বেঁকে বসায় সেই উদ্যোগ থমকে যায়। কেন রাজি হননি? প্রাক্তন ভূমি সংস্কারমন্ত্রীর জবাব, “বুদ্ধবাবু চাইলেও টি-ট্যুরিজম নিয়ে আগ্রহ দেখাইনি। কারণ, মালিকেরা এক বার পর্যটনের ছাড়পত্র পেয়ে গেলে চা গাছ উপড়ে বহুতল নির্মাণে ঝুঁকে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা ছিল। তাতে শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। সে জন্য চা বাগানে দু-একরের বেশি জমি আমরা দিতে রাজি হইনি। বাড়তি করও দিতে হবে বলেছিলাম। সে জন্য কাজটা এগোয়নি।”
বস্তুত, আর পাঁচটা জায়গার তুলনায় চা বাগানের ডিরেক্টরস বাংলো কিংবা অতিথি নিবাসে রাত কাটানো ও বেড়ানোর অভিজ্ঞতা একেবারে আলাদা। বিশেষত, শতবর্ষ প্রাচীন চা বাগানে ইংরেজ আমলে তৈরি ‘কটেজ’-এ থাকার সুযোগ মিললে তো কথাই নেই।
শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে তিনধারিয়ার পাহাড়ি উপত্যকায় সেলিম হিল চা বাগানে রয়েছে ইংরেজ আমলে তৈরি কাঠের সুদৃশ্য বাংলো। সমতল শিলিগুড়িতে যখন গ্রীষ্মের দাবদাহ চলে, সেই জুন মাসেও কার্শিয়াঙের সেলিম হিলে গেলে হিমেল বাতাসে গা শিরশির করে ওঠে। ডুয়ার্সের মেটেলি ব্লকের জুরান্তি চা বাগানের মাঝখানে ডিরেক্টরস বাংলোয় বিলিয়ার্ড থেকে নানা ধরনের খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। দার্জিলিঙের গ্লেনবার্ন চা বাগানের মতো আরও কিছু চা বাগানেও ভ্রমণপিপাসুদের থাকা-খাওয়ার যাবতীয় বন্দোবস্ত রয়েছে। কিন্তু এই সব বাগানে থাকা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ।
তাই সব শ্রেণির পর্যটকদের জন্য ভাবনাচিন্তা করছেন ট্যুর অপারেটররা। একটি বেসরকারি পর্যটন সংস্থার কর্ণধার সম্রাট সান্যাল বললেন, “যাঁরা কম খরচে, চা বাগানে থাকার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চান, তাঁদের জন্য পাহাড় ও সমতলের অন্তত ২০টি বাগানে অপেক্ষাকৃত কম বাজেটে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা নিয়েছেন মালিকপক্ষ।” এতে চা বাগান মালিকদের আয় তো বাড়বেই, নতুন কিছু কর্মসংস্থানের জায়গাও তৈরি হবে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের অভিমত। কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ (সিআইআই)-এর উত্তরবঙ্গ শাখার পর্যটন বিষয়ক মুখপাত্র রাজ বসুর হিসেব, “উত্তরবঙ্গে ৩০০ টি চা বাগানে দু’হাজার ঘর রয়েছে। যেখানে অনায়াসে পর্যটকেরা থাকতে পারবেন। প্রচুর কর্মসংস্থানও হবে।”
এই কাজ যাতে দ্রুত হয় তার ব্যাপারে সহমত চা বাগান মালিকপক্ষ, ট্যুর অপারেটর সংস্থা ও প্রশাসনও। জলপাইগুড়ির জেলাশাসক পৃথা সরকার জানান, সরকার নিয়ন্ত্রিত ডুয়ার্সের হিলা চা বাগানেও পর্যটন কেন্দ্র করার কথা ভাবা হচ্ছে। টি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার ডুয়ার্স শাখার সচিব প্রবীর ভট্টাচার্য বলেন, “চা বাগানে পর্যটন শিল্পের দাবি নতুন কিছু নয়। তবে বর্তমান রাজ্য সরকার এ বিষয়ে যে আগ্রহ দেখাচ্ছে, তাতে বাগানগুলিতে পর্যটন কেন্দ্র তৈরির কাজে গতি আসবে।” |