এক যুগ হয়ে গেল প্রভিডেন্ট ফান্ডে (পিএফ) এক পয়সাও পেনশন বাড়েনি বিমল সেনের। ২০০১ সালে অবসরের পর যা পেতেন, আজও তাই। মাঝের ১২ বছরে পেঁয়াজ ৭০ টাকা হয়েছে। সব্জি আগুন। নিত্য ব্যবহারের সব জিনিসই অগ্নিমূল্য। শুধু এক রয়ে গিয়েছে তাঁর পেনশনই। এক নয়াও না-বেড়ে সেই ২৮৮ টাকা!
বিমলবাবু একা নন। এই হাল পিএফের পেনশন প্রকল্পের আওতায় থাকা ৪৪ লক্ষ মানুষের। গত ১৩ বছরে যাঁদের পেনশন আর বাড়েনি। শেষ বেড়েছিল ২০০০ সালে, ৪%। শুধু তা-ই নয়। পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গিন যে, খোলনলচে না-বদলালে আগামী দিনে এই পেনশন প্রকল্প চালিয়ে যাওয়া আদৌ সম্ভব হবে কি না, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েই।
পিএফের পেনশন তহবিলের মূল্যায়ন ও ঝুঁকি (অ্যাকচুয়ারিয়াল) সংক্রান্ত রিপোর্ট সম্প্রতি জমা দিয়েছে নিগমের অ্যাকচুয়ারি, মেসার্স কে এস পণ্ডিত। সেই অনুযায়ী, তহবিলের অবস্থা টলমল। তার উপর হাল ফেরাতে উদ্যোগ দেখা যায়নি কেন্দ্রের দিক থেকেও। সব মিলিয়ে যা অবস্থা, তাতে ভবিষ্যতে পেনশনের টাকার সংস্থান করতেই সমস্যা দেখা দেবে। |
কেন? অন্তত তেত্রিশ বছর চাকরি হলে, তবে পুরো (সাধারণত বেতনের ৫০%) পেনশন মেলে। কিন্তু পিএফে পেনশন প্রকল্প চালুই হয়েছে ১৯৯৫ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে। ফলে এর আওতায় থাকা বহু কর্মী এখনও পুরো পেনশন পান না। কিন্তু একটা সময় আসবে, যখন তাঁরা ৩৩ বছর চাকরির সুবাদে তা পাওয়ার অধিকারী হবেন। তখন আকাশছোঁয়া হবে ঘাটতি। শুধু আজকের হিসাবেই (সদস্য সংখ্যা একই থাকলে) তা দাঁড়াবে ৪১ হাজার কোটি টাকার বেশি। ফলে পেনশন বাড়ানো তো দূরের কথা, তার টাকা জোগাড় করতেই নাভিশ্বাস উঠবে পিএফ কর্তৃপক্ষের।
রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৬ থেকে ২০০৭, এই এক বছরে ঘাটতি বেড়েছে ১৮,৪৬০ কোটি টাকা। এ ভাবে ঘাটতি বাড়লে, প্রকল্প চালানোই মুশকিল হবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কারণ হিসেবে তাঁদের ব্যাখ্যা, কে কত পেনশন পাবেন, তা ঠিক হয় নির্দিষ্ট ফর্মুলার ভিত্তিতে। সেখানে কারও চাকরির মেয়াদ যত লম্বা হবে, তাঁর পেনশনও তত বেশি হওয়ার কথা। তাই আগামী দিনে সেই মোটা অঙ্ক জোগাতে নাভিশ্বাস উঠবে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
পিএফ কমিশনার কে কে জালানের অবশ্য দাবি, “ওই রিপোর্ট সঠিক নয়। অসম্পূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি। আমরা আরও তথ্য সংগ্রহ করেছি। তার ভিত্তিতে তৈরি রিপোর্টেই তহবিলের লাভ-ক্ষতির ছবি পরিষ্কার হয়ে যাবে।”
কিন্তু এমন বেহাল দশা কেন?
এক কথায়, তহবিল লগ্নি করে আয় কমে আসা। পেনশন-সহ পিএফের পুরো তহবিল কোথায় কোথায় লগ্নি করা যাবে, তা নির্দিষ্ট রয়েছে। তহবিলের সিংহভাগ টাকাই রাখা হয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্পেশাল ডিপোজিট স্কিমে। কিছুটা ঢালা হয় সরকারি ঋণপত্রে। নির্দিষ্ট মানের বেসরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করা যায় মাত্র ১০% টাকা। ১৯৯৫ সালে যখন পিএফের পেনশন চালু হয়, তখন স্পেশাল ডিপোজিট প্রকল্প থেকে প্রায় ১৪% সুদ পাওয়া যেত। কিন্তু কমতে-কমতে তা এসে ঠেকেছে ৮ শতাংশের আশেপাশে। ফলে কমে গিয়েছে পিএফ তহবিলের আয়। আর সেই কারণেই পেনশনের টাকা মেটাতে খাবি খাচ্ছেন পিএফ কর্তৃপক্ষ।
এই আয় কী ভাবে বাড়ানো সম্ভব, তা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি কেন্দ্রও। চড়া রিটার্নের আশায় শেয়ারে ওই টাকা খাটানোর প্রস্তাব একাধিক বার দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। কিন্তু তাতে আবার বেঁকে বসেছে শ্রমিক সংগঠনগুলি। মূলত তাদের বিরোধিতার কারণেই পিএফের অছি পরিষদ ওই প্রস্তাবে সায় দেয়নি।
এই পরিস্থিতিতে তহবিলের আয় বাড়াতে কেন্দ্রের কাছে মূলত দু’টি প্রস্তাব দিয়েছিল ইউনিয়নগুলি। এক, নিয়োগকারীর দেয় টাকা ২% বাড়িয়ে ১৪% করা। আর দুই, কেন্দ্রের অনুদান আরও ১% বাড়িয়ে ২.১৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু নিয়োগকারী বা কেন্দ্র কেউই এই প্রস্তাব মানতে নারাজ। ফলে আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে পেনশন প্রকল্পের ভবিষ্যৎ।
কিন্তু পেনশন দিতে যদি এতই বেহাল দশা, তা হলে অবসরের পর পিএফেই সব টাকা দিয়ে দিতে আপত্তি কোথায়? তা হলে মাসে-মাসে নির্দিষ্ট টাকা পেতে নিজেদের মর্জি মাফিক ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে তা লগ্নি করতে পারেন গ্রাহকেরা।
কিন্তু কর্মী সংগঠনগুলি তাতে নারাজ। এআইইউটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক ও পিএফের অছি পরিষদের সদস্য শঙ্কর সাহা বলেন, “শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প বলতে রয়েছে একমাত্র এই পিএফ। তাই তা তোলার প্রস্তাব মানব না। কেন্দ্রের বরং উচিত অনুদান বাড়ানো। সেই সঙ্গে পিএফের পেনশনকে মূল্য সূচকের সঙ্গে যুক্ত করার দাবিও জানিয়েছি। যাতে মূল্য -বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা বাড়ে।”
সাধারণত দু’একটি নির্দিষ্ট শিল্প ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ ৬,৫০০ টাকা বেতন ধরে পেনশন হিসাব করা হয়। বাদবাকি বেতন এর আওতায় ধরা হয় না। এ জন্য বেতনের ১২% কেটে পিএফ তহবিলে জমা দেওয়া হয়। একই পরিমাণ টাকা তহবিলে জমা দেন নিয়োগকারীও। নিয়োগকারীর টাকার ৮.৩৩% পেনশন খাতে জমা পড়ে। বাকি ৩.৬৭% যায় পিএফ খাতেই। এ ছাড়া, বেতনের উপর ১.১৬% অনুদান দেয় কেন্দ্র। |