সেচ এলাকা বাড়েনি। তার উপর যে কয়টি প্রকল্প চালু, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি অকেজো। সেই সঙ্গে এ বার পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়নি। এর প্রভাব আমন ধান চাষে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কোচবিহার জেলার চাষিরা। জলের অভাবে গত বছরের তুলনায় আমনের উৎপাদন ৫৭ হাজার টন কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে কৃষি দফতরও। কোচবিহারের মুখ্য কৃষি আধিকারিক প্রণবজ্যোতি পণ্ডিত বলেন, “পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় আমনের উৎপাদন কমতে পারে।”
কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এই জেলায় মোট কৃষি জমি রয়েছে ২ লক্ষ ৫৩ হাজার ৬৩ হেক্টর। তার মধ্যে আমন ধান চাষ হয় ২ লক্ষ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। প্রায় ১ লক্ষ ৯ হাজার হেক্টর এলাকা ক্ষুদ্র সেচের আওতায় রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি ভাবে ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থার মধ্যে পড়ে ৪৩ শতাংশ এলাকা। অর্থাৎ কোচবিহারের ৫৭ শতাংশ কৃষি জমি সরকারি হিসেবেই সেচের আওতার বাইরে। অগত্যা বৃষ্টির উপর নির্ভর করতে হয় চাষিদের। গত বার জেলায় জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরে বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ৩৩০০ মিলিমিটার। এ বার জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ১৫০০ মিলিমিটার। নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৯০০ মিলিমিটার। তাও বিক্ষিপ্ত। আবার কালীপুজোর পর তুফানগঞ্জ মহকুমায় ব্যাপক ঝড়বৃষ্টিতে অন্তত হাজার বিঘের ধান নষ্ট হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র দীপঙ্কর মজুমদার বলেন, “সরকারি ও বেসরকারি ভাবে জেলা জুড়ে অগভীর নলকূপ, শ্যালো-সহ মোট ৫৭৫৯টি প্রকল্প হস্তান্তর হয়েছে। আরও কিছু প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। আগামী বছর ক্ষুদ্র সেচের এলাকা বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা যাবে বলে আশা করছি।” জেলায় ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থা দেখভালের রয়েছে কৃষি সেচ, কৃষি যান্ত্রিক দফতর ও ক্ষুদ্র সেচ নিগম। চাষিদের অভিযোগ, বহু প্রকল্প অকেজো হয়ে রয়েছে। কৃষি যান্ত্রিক বিভাগের সিতাই, তুফানগঞ্জ, মাথাভাঙার ১০টি ‘আরএলআই’ কেন্দ্র অচল হয়ে রয়েছে। নদীর জল শুকিয়ে যাওয়া, যন্ত্র বিকল হয়ে পড়া, পাইপ ফুটো হয়ে যাওয়ায় মতো নানা সমস্যায় সেচের দুর্ভোগ বেড়েছে। কৃষি যান্ত্রিক দফতরের জেলা এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র তরুণকান্ত রং বলেন, “ওই সমস্যা মেটানর পাশাপাশি সেচের এলাকা বাড়াতে পরিকল্পনা হয়েছে। বরাদ্দ এলে কাজ হবে।”
ক্ষুদ্র সেচ নিগমের অধীন তুফানগঞ্জ ২ ব্লকের গড়ভাঙা ও মাথাভাঙা ২ ব্লকের রুইডাঙার আরএলআই কেন্দ্র অকেজো হয়ে রয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় দিনহাটার পেটলায় গভীর নলকূপের একটি প্রকল্প চালু করা যায়নি। ওই দফতরের এক আধিকারিক স্বপন চৌধুরী বলেন, “রুইডাঙা ও গড়ভাঙা আরএলআই কেন্দ্র দু’টিকে ডিজেলের বদলে বিদ্যুৎ চালিত করার কাজ হচ্ছে। কিছুটা সময় লাগছে।”
বৃষ্টি ও সেচ এই দুই সমস্যায় এ বার আমন চাষ মার খাবে বলে আশঙ্কা চাষিদের। কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গত বছর জেলায় আমন ধান উপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ লক্ষ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন। এ বার গড়ে যদি কুড়ি শতাংশ ফলন মার খায়, তা হলে উপাদনের পরিমাণ বড় জোর ৪ লক্ষ ১৮ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়াবে বলে ধারণা কৃষি দফতরের। কোচবিহার সদরের মরানাওতারা এলাকার চাষি শ্যামল বর্মন বলেন, “১০ বিঘে জমিতে আমন চাষ করেছি। গত বছর ফলন পেয়েছিলাম প্রায় ৬০ মণ। এ বার এখনও পর্যন্ত যা ধান কাটা হয়েছে, তাতে বিঘে প্রতি ৫ মণের বেশি হচ্ছে না। পরিমাণ মতো বৃষ্টি, সেই সঙ্গে সেচের জল ঠিকঠাক পেলে এই অবস্থা হত না।” ঘুঘুমারির নন্দ বর্মনের বক্তব্য, “গত বছর এক বিঘা জমি চাষ করে প্রায় ৮ মণ ফলন উঠেছিল। এ বার দুই বিঘের ধান কেটে পেয়েছি মাত্র ৯ মন।” কোচবিহার জেলা পরিষদের তৃণমূল সদস্য সিদ্ধার্থ মণ্ডল বলেন, “দানা জমাট বাঁধার সময় বৃষ্টিটা জরুরি। এ বার সেটা হয়নি। তাই গতবার যেখানে উন্নত জাতের আমন বীজ লাগিয়ে বিঘে প্রতি ১২ মন পর্যন্ত ফলন উঠেছিল, এবার এখনও পর্যন্ত ৭ বিঘের ফলন কেটে একই বীজে বিঘে প্রতি ৮ মন ধান পেয়েছি। কালীপুজোর পরে ঝড়বৃষ্টি হল। তাতে আরও ধাক্কা খেলাম।” কোচবিহার জেলা আলু, পাট ও ধানচাষি সংগ্রাম সমিতির সম্পাদক নৃপেন কার্জি বলেন, “সরকারি পরিসংখ্যান যাই থাক, জেলায় ৮০ শতাংশের বেশি এলাকায় সেচ নেই। চাঁদামারির তিতিয়ারছড়া, চিলকিরহাট, সিতাইয়ে বহু আরএলআই অকেজো। তিস্তার বাঁ হাতি খালের কাজের অগ্রগতি হচ্ছে না। ফলে বৃষ্টিই মূল ভরসা। সেটা হয়নি বলে এ বার আমনের ফলন কমেছে।” |