|
|
|
|
স্মরণ |
চুম্বন করিনি আগে ভুল হয়ে গেছে |
সৈয়দ মির্জা গালিবের
পর বাংলা কবিতার একমাত্র ‘মিথ’।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ২৫ নভেম্বর তিনি ৮০। লিখছেন সুবোধ সরকার |
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ওপরে একজন আছেন, তাঁর নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়, নীচে একজন আছেন তাঁর নামও শক্তি চট্টোপাধ্যায়। একেই বলে মিথ। মিথ একজনকে নিয়ে তৈরি হয়, কিন্তু তার পরম্পরা ছড়িয়ে পড়ে তিনজন চারজন পাঁচজনকে নিয়ে। পাঁচজন মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করে পুনরায় পাইপগানের মধ্যে ঢুকে একজন হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
কবিতা লিখে খ্যাতি পাওয়া যায়, গুচ্ছের পুরস্কার পাওয়া যায়, কিন্তু কিংবদন্তি হওয়া অত সহজ নয়। শক্তি এখনও ডুয়ার্সের জঙ্গলে হেঁটে চলেছেন। শক্তি এখনও চাইবাসা দিয়ে ‘ওই কপালে কী পরেছ’ বলতে বলতে দৌড়ে চলেছেন, তাঁর জলদগম্ভীর গলা শোনা যাচ্ছে, ‘রাতের কল্লোল শুধু বলে যায় আমি স্বেচ্ছাচারী।’ এই উপ মহাদেশে সৈয়দ মির্জা গালিবের পর এরকম মিথ আর হয়নি। কবিতার সংখ্যায় তিনি গালিবকে হারিয়েছেন, তবে পেয়ালায় কে কাকে হারিয়েছেন, জানি না।
শক্তিদাকে প্রথম দেখি কৃষ্ণনগরে। আমি তখন খুব ছোট। টালমাটাল শক্তিকে দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ওরকম চারশো চল্লিশ ভোল্ট চার্জ করে রবীন্দ্রভবনের মঞ্চে আমি আর কাউকে উঠতে দেখিনি।
বালক চোখে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম শক্তির দিকে। কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কে কবিতা সিংহ, কে সন্তোষ কুমার ঘোষ, আমার আর্ত চোখ তখন শুধু শক্তিকে দেখছে।
মাইকে যেই উঠলেন, সে কী করতালি, এটা পড়ুন, ওটা পড়ুন বলে চিৎকার, ‘সোনার মাছি খুন করেছি’ থেকে একটার পর একটা কবিতা পড়ে গেলেন। একটা শেষ হচ্ছে হাততালি, একটা শুরু হচ্ছে, তার জন্যও হাততালি। ছোটবেলায় আর কোনও কবিকে এরকম সংবর্ধিত হতে দেখিনি। তখনও আমি আমার প্রথম কবিতাটাও লিখিনি। কিন্তু পিঠে করে আমি একটা অদৃশ্য আগ্নেয়গিরি নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
শিয়ালদার বর্ডার পার হয়ে আমি যেদিন কলকাতায় থাকতে এলাম, বড় বড় লেখকের বাড়ি খুঁজে দেখতাম। ওই তো লেকের ধারে হেঁটে চলেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, গাড়ি থেকে নামছেন সমরেশ বসু বাংলা উপন্যাসের উত্তমকুমার, লম্বা নির্মেদ নীরেন্দ্রনাথ বাংলা কবিতার চাবুক এসে দাঁড়ালেন সদনের উল্টো দিকের বইমেলায়। গড়িয়াহাটায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাট এঁদের দূর থেকে দেখতাম, কাছে যাওয়ার ভিসা ছিল না। |
|
ছবি: অলক মিত্র। |
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ হতেই বললেন, ‘চলো আমার সঙ্গে।’ সোজা ওঁর বেকবাগানের বাড়ি, মিঠাইয়ের পাশ দিয়ে নিয়ে গেলেন। বাড়িতে গিয়ে কোনও কথা বলছেন না। শুধু বসে আছেন আর পা নাড়ছেন। আমি বললাম, কৃষ্ণনগরে আপনার কবিতা শুনেছিলাম। কী দারুণ সব কবিতা পড়েছিলেন, কী হাততালি। উনি বললেন, হু। আমি বললাম, আপনাকে আমার খুব ভয় করে। উনি বললেন, হু। আমি বললাম, আপনাকে নিয়ে কত গল্প শুনেছি। উনি বললেন, হু। আমি বললাম, চলি। উনি বললেন, এসো।
পরে সন্দীপনদার (চট্টোপাধ্যায়) কাছে শুনেছি, তিনবার পর পর শক্তির মুখে ‘হুঁ’ শুনলে বুঝবে ও এ বার কবিতা লিখবে।
দ্বিতীয় দিন উনি আমাকে ধরলেন স্টেটস্ম্যান হাউসের সামনে। বললেন, চলো। আমি চললাম। তিনি আমাকে একটা গলি, তার ভিতরে একটা গলি, শেষে আরও একটা গলির ভিতর নিয়ে এসে একটা বেঞ্চে বসালেন, ‘‘তারক, দু’টো দে”। দু’টো মানে যে দু’টো বাংলা মদের বোতল সেটা বোঝার মতো নাগরিক কাণ্ডজ্ঞান আমার হয়েছে।
আমি প্রমাদ গুনলাম, আমি তখনও মদ ছুঁয়ে দেখিনি, বাংলা খেতে হবে? শক্তিদা প্রথম পাইট খুললেন, ঢক ঢক করে খেলেন, হাতের চেটো দিয়ে মুখ মুছলেন। দ্বিতীয় পাইট খুললেন, ঢক ঢক করে খেলেন, চেটো দিয়ে মুখ মুছলেন এবং উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “তারক লিখে রাখ।” তার পর সারা রাস্তা ‘নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা’ গাইতে গাইতে আমাকে পুনরায় বাড়ি নিয়ে এলেন। শোনালেন সদ্য লেখা একটা দীর্ঘ কবিতা ওই গলা, ওই পড়া, আর ওই কবিতা। বললেন, কী ঠিক আছে? কালকেই দিতে হবে সাগরদাকে।
শক্তির কবিতা আগুন, শক্তির মদ গরল, শক্তির জীবন স্বেচ্ছাচারী। লোকের মনে আঘাত দিতে পটু। এক বার লিখলেন, ‘এত কবি কেন’। একবার লিখলেন, ‘মেয়েরা আবার ছন্দ জানে নাকি?’ ‘এই পান কিনে আসছি’ বলে ভুটান চলে গিয়েছিলেন।
পরবর্তী সময়ে কবিদের সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘এরা মধ্যবিত্ত। ঝোলা কাঁধে বৌ ছেলে নিয়ে সুখে থেকে কবিতা লেখা যায় না।’
কথাটা নিষ্ঠুর, কিন্তু সত্যি। তাই বলে এটা তো আর হয় না সব কবির বৌ ছেলেমেয়ে মরে যাবে আর বাংলা কবিতা সোনার ফসলে ভরে উঠবে।
তাঁর ‘কবিতা সমগ্র’র সাতটি খণ্ডই আনন্দ থেকে প্রকাশিত হয়েছে, সারা জীবনের সারাংশ, সারা জীবনের বিষ এবং বিশল্যকরণী।
সব চেয়ে অবাক লাগে ‘অগ্রন্থিত’ খণ্ড দু’টি হাতে নিয়ে, এত কবিতা তিনি লিখেছেন, ছাপিয়েছেন, কিন্তু বই করে যাননি? এখানেই অমোঘ হয়ে ওঠে কবিতার লাইন: ‘মদ খাইয়ে খাইয়ে মদ্যপ করেছ
পদ্য খাইয়ে খাইয়ে করেছ পদ্যপ’।
তিনি অসহিষ্ণু, স্বেচ্ছাচারী, এই সব শুনে এসেছি সারা জীবন। আমি এক বার শক্তিদাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই বললেন, প্রণাম করছ কেন? আমি কি চোর? লোকে আজকাল চোরেদের প্রণাম করে।
আমি বললাম, যিনি লেখেন, ‘আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে’ (জরাসন্ধ), ‘মানুষ বড় কাঁদছে’, ‘তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও’, যিনি লেখেন ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’, যিনি লেখেন, ‘ওঁ চিরপ্রণম্য অগ্নি’, আমি তাঁকে প্রণাম করলাম। কিন্তু যে সহিষ্ণুতার পরিচয় তিনি দিয়েছিলেন, এখনকার কোনও কবি তা ভাবতেও পারবেন না।
মল্লিকা তখন এম.এ পড়ছে, সদ্য তার ২২ পৃষ্ঠার একটি কবিতার বই বেরিয়েছে, ‘চল্লিশ চাঁদের আয়ু’, দেশ পত্রিকার জন্য সুনীলদা মল্লিকাকে ডেকে একটি বই রিভিউ করতে দিলেন। বইটির নাম ‘কক্সবাজারে সন্ধ্যা’, বইটির লেখক শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
মল্লিকা লিখল, ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই বইটি ভাল না, অজস্র কাঁচের টুকরো ঘেঁটে একটা দু’টো হীরের কুচি খুঁজে বের করা বেশ খাটনির কাজ।’ বোমা ফাটল। আনন্দবাজারের করিডরে শক্তিদার মুখোমুখি পড়ে গেলাম আমরা দু’জনে। একে ডাকছেন, তাকে ডাকছেন, আর বলছেন এই হল মল্লিকা। আমার কাগজে আমার কবিতা ভাল হয়নি বলার সাহস দেখিয়েছে। এসো চা খেয়ে যাও।
পরে একটি সাক্ষাৎকারে বলেওছিলেন সে কথা, বইটি ভাল হয়নি। মানুষ অনেক উঁচুতে উঠলেও, মানুষের মন উঁচুতে ওঠে না। সেদিন শক্তিদা আমাদের কাছে যে উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন, তা কোনও দিন ভুলতে পারব না।
তিনি মোজার ভেতর টাকা রাখতেন না কি, তিনি ডবল ডেকার ঘুরিয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন কি না, তিনি ভারত ভবনের খোলা ছাদে উঠে শিল্পী স্বামীনাথনের সঙ্গে লাফ দিতে গিয়েছিলেন কি না (অশোক বাজপেয়ীর কাছে শুনেছি)।
এগুলো বড় কথা নয়। বড় কথা তাঁর কবিতা, তাঁর পরম্পরা।
তাঁকে টুকে কবিতা লেখেননি এ রকম তরুণ কবি আজও জন্মায়নি। তাঁর মতো করে অনেকেই মদ খেয়েছেন, কিন্তু কবিতাটা হয়নি। এটা ঠিক তিনি অনেক সম্মান পেতে পারতেন, পাননি তিনি মদ খেতেন বলে।
যখন তিনি মধ্যগগনে, তখন বামপন্থীরাও মধ্যগগনে, তবু তিনি পুরস্কার পাননি। ভাগ্যিস দিল্লি থেকে অকাদেমি পেয়েছিলেন।
শ্মশানে বিরাট সম্মান দেখিয়ে গান স্যালুট দেওয়ার পরে পরেই আদিখ্যেতা করে তাঁকে রবীন্দ্র পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
পসথিউমাস পুরস্কার পেয়ে কোনও কবির কোনও উপকার হয় না, বরং তাঁর সৎকার প্রলম্বিত করা হয়।
২৫ নভেম্বর তাঁর জন্মদিন। কিন্তু পুরুলিয়া থেকে সুন্দরবন, তরুণ কবিরা তাঁর জন্মদিন পালন করে রোজ, তাঁর কবিতা পাঠ করে। |
|
|
|
|
|