|
|
|
|
|
|
|
খেলাধুলা... |
|
|
|
চব্বিশ নয়! পঁচিশ বছর ধরে সচিন তেন্ডুলকরকে কাছ থেকে দেখছেন। সাতমহলা সেই
সব
অভিজ্ঞতার মধ্যে তাঁর মনে গেঁথে যাওয়া সেরা ১০ বাছলেন গৌতম ভট্টাচার্য |
১. বিপদের মুখে শৌর্য |
আগে কখনও লিখিনি এই ঘটনার কথা! আজ আর সেই দায় নেই। ২০০৬-য়ের কোনও একটা সময়। কলকাতায় তাঁর হোটেলের ঘরে গিয়েছি সৌজন্য সাক্ষাতে। কয়েকটা ছবি আর কারও অটোগ্রাফ খাতার কুরিয়ার হয়ে! ঘরে তখন কলকাতার ক্লাবকর্তা, তাজ বেঙ্গল হোটেলের পদস্থ আধিকারিক এবং আরও কেউ। সচিন তেন্ডুলকরের ঘরের দরজা আধখানা খোলা মানে এই। কেউ না কেউ অবধারিত ঢুকে পড়বে। হঠাৎ সইটই সেরে সচিন বললেন, “একটু শুনবে? আমার কথা আছে।” বলে ইঙ্গিত করলেন বাইরে বেরিয়ে আসার। বেশ অবাকই লাগল। ব্যালকনিতে বেরিয়ে আসার তো দরকার নেই। ঘরে যারা আছে তাদের বললেই হয়, একটু কথা আছে ওর সঙ্গে। যা হোক, বেরিয়ে এলাম। সচিন ঠিক ঘরের বাইরে নয়। টেনে নিয়ে গেলেন ব্যালকনির আরও কোণে। যা বললেন, তার জন্য একেবারেই তৈরি ছিলাম না। “মিডিয়ার একটা অংশ এটা কী ক্যাম্পেন শুরু করেছে আমার বিরুদ্ধে? আমি নাকি রান পাচ্ছি না! আমায় নাকি টেনিস এলবো খেলা ভুলিয়ে দিয়েছে এ সব কী চলছে?” পঁচিশ বছর ধরে ওঁর সঙ্গে পেশাদারি ঘনিষ্ঠতা এবং তারই মাঝে হাল্কা ব্যক্তিগত আদান-প্রদান। কখনও মিডিয়ার লেখা নিয়ে সচিন তেন্ডুলকরকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুনিনি। এ দিক থেকে তিনি একেবারে অনন্য। কেরিয়ারের শুরুর দিন থেকেই কী ছবি ছাপা হল, তাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। |
|
কী লেখা হল তাকে নয়! মাত্র একবারই শুনেছি স্টার নিউজ-য়ের একটা অনুষ্ঠান সম্পর্কে তীব্র আপসেট হয়েছিলেন। শো-টার নাম ছিল ‘ম্যাচ কা মুজরিম’। ভারতের ম্যাচে এক একদিন এক একজনকে ম্যাচের ‘মুজরিম’ শনাক্ত করে তাকে গালাগাল দিতেন বিষেন বেদি। সচিন নাকি তখন বলেছিলেন, “ক্রিকেট ম্যাচে আবার আসামি শব্দটা কেন? যে পারেনি সে তো ইচ্ছাকৃত কোনও অপরাধ করেনি।” কিন্তু সেটাও ওঁর মুখে সরাসরি শোনা নয়। ঘুরপথে এসে ছিল। সচিনের নিজের মুখে কথাটা শুনে তাই স্তম্ভিত লেগেছিল। টিমের কোচ তখন গ্রেগ চ্যাপেল। সৌরভ বাইরে। তাঁর যন্ত্রণাকাতর মুখ দেখে নিমেষে বোঝা গেল, মিডিয়ার তির এত জখম করেছে মানে অভ্যন্তরীণ কোনও রক্তক্ষরণ নিশ্চয়ই হচ্ছে। কোচ বা ক্যাপ্টেন নির্ঘাত পাশে নেই। “যে পিরিয়ডটার কথা ওরা লিখছে, সেই সময় আমার টোটাল রান যোগ করুন। দেখবেন সেকেন্ড হায়েস্ট। তাহলে ফর্ম নেই কীসের?” বেশ উত্তেজিত শোনালো সচিনকে। বললেন, “সাবজেক্টিভ ব্যাপার নিয়ে লোকের দ্বিমত থাকতে পারে। স্ট্যাটস হাতে নিয়েও কী করে মিথ্যে লেখে?” এই দুঃসহ পরিস্থিতিতে দৃশ্যটা কী হতে যাচ্ছে খুব সহজ। সুপারস্টার এ বার সাংবাদিককে অনুরোধ করবে, মিডিয়ায় আরও বন্ধুবান্ধব জোগাড় করে আমার দিকটা ফোকাস করো। তবে আমায় কোথাও ‘কোট’ কোরো না। সচিন ঠিক উল্টোটাই বলেছিলেন। “আমি জানি আমায় কী করতে হবে। দুই থেকে এক-য়ে আসতে হবে। বাট এদের বিচারটা অদ্ভুত লাগল।” এক বছরের মধ্যে শুধু দুই থেকে এক-য়ে এলেন না, ২০০৮ থেকে তেন্ডুলকরের ফের মহানাটকীয় উত্থান ঘটল। তার পর থেকে আজ পর্যন্ত কখনও মিডিয়ার সেই সময়কার তাঁর বিরুদ্ধে ক্যাম্পেনিং প্রসঙ্গটা ওঠেনি। তবে চাপের মুখে, চূড়ান্ত সমস্যার মধ্যে ওই সংলাপটা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মনে থাকবে। “আমি জানি আমায় কী করতে হবে। দুই থেকে এক-য়ে আসতে হবে!” অসাধারণ বিপদের মুখে নতুন সংকল্পে দীক্ষা! |
২. অনন্ত পরিশ্রম জিনিয়াসেরও লাগে |
সিডনি ২০০৩। টেস্ট শুরু হওয়ার আগের দিন। প্র্যাকটিসে কোথাও তেন্ডুলকরকে দেখতে পাচ্ছি না। তা হলে কি আজ আসেননি? এ রকম তো কখনও দেখিনি যে, এত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে সচিন অ্যাবসেন্ট। তা-ও এ বার একেবারেই ফর্মে নেই। শুনলাম, মুখে অ্যালার্জির র্যাশ বেরিয়েছে। ভরপূর চড়া রোদে না বেরিয়ে তাই হোটেলে বিশ্রাম নিচ্ছেন। এর পর প্র্যাকটিস প্রায় শেষের দিকে। হঠাৎ দেখা গেল পাশের প্র্যাকটিস হল থেকে ব্যাট হাতে বেরিয়ে আসছেন সচিন। কেমন একটা অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সারা মুখে সানস্ক্রিন লোশন। পিছন পিছন বোলাররা। যাঁরা তাঁকে এত ক্ষণ ইন্ডোর প্র্যাকটিস সেন্টারে প্র্যাকটিস দিচ্ছিলেন। তারই মধ্যে বাংলার সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। সচিনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের বৃত্তে থাকা সুব্রত তখন গজগজ করছেন, “বাপরে বাপ! বল করতে করতে হাত খুলে যাওয়ার মতো অবস্থা। তবু থামছে না!” পরের দিন সচিন করেন অপরাজিত ২৪১। সেঞ্চুরির আগে একটাও কভার ড্রাইভ মারেননি। যে স্ট্রোকে বারবার আউট হচ্ছিলেন সিরিজে। পরের দিন জানা গেল, ইন্ডোর প্র্যাকটিসেও কোনও কভার ড্রাইভ মারেননি। |
|
জাম্প কাট। মেলবোর্ন, ২৫ ডিসেম্বর ২০১১। ক্রিসমাসে এ দেশে কেউ বড় একটা বাইরে আসে না। পরিবারের সঙ্গে কাটায়। অস্ট্রেলিয়া সে দিন প্র্যাকটিস করছে না। ভারত উপায়ান্তর না-দেখে করছে। পরের দিনই তো বক্সিং ডে টেস্ট ম্যাচ! অথচ এমন অবস্থা যে, নেটে কার্যত বলবয় পর্যন্ত নেই। লোকাল বোলার কম। নিজের টিমের বোলাররা পরের দিন টেস্ট বলে অপেক্ষাকৃত কম বল করছেন। এই অবস্থায় সচিন নেটে ব্যাট করলেন আড়াই ঘণ্টা। দাঁড়িয়ে তাঁর ওই প্র্যাকটিস দেখতে দেখতে আমরাই টায়ার্ড হয়ে গেলাম। ‘আজ তক’-য়ের বন্ধু রিপোর্টারকে দেখলাম প্রচণ্ড উসখুস করছে। বলল, “কী ব্যাপারটা হচ্ছে বুঝতে পারছি না। একটার সময় মেলবোর্ন জু-তে ওর যাওয়ার কথা সারা-অর্জুনকে নিয়ে। আমাদের ক্যামেরাম্যান তখন থেকে জু-য়ের বাইরে দাঁড়িয়ে। আর ও তো প্র্যাকটিস করেই যাচ্ছে।” সচিন ঘামতে ঘামতে নেট ছাড়লেন দুপুর পৌনে দু’টো নাগাদ। আমি ততক্ষণে একটা লোভনীয় এক্সক্লুসিভ হেডিং আনন্দবাজারের খেলার পাতায় চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। ‘অস্ট্রেলিয়ায় এ বারেরটাই তো শেষ, তাই বাড়তি পরিশ্রম করছি’, নীচে এক লাইনের ইন্ট্রো বক্তার নাম সচিন তেন্ডুলকর। নেট শেষ করে নীচের চেঞ্জিং রুমে বেরিয়ে যাচ্ছেন সচিন। দ্রুত তাঁর কাছে পৌঁছে গেলাম। অন্যদের পিছনে ফেলে একা পৌঁছনো মানেই তো এক্সক্লুসিভ আর সোনার খনি। লোকটা এ বার কত কিছু বলতে পারে। এ-ও বলতে পারে ব্র্যাডম্যানকে শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছি তাই আরও উজাড় করে দেব। সচিন হেলমেটের ফাঁক দিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। লম্বা প্র্যাকটিস শেষ করে একটা অন্য মানসিকতার মধ্যে চেঞ্জিং রুমে ফিরছেন। মনে হল না পরিচিত সাংবাদিকের মুখও তাঁর এখন দেখতে ইচ্ছে করছে বলে। কিন্তু প্রশ্নটা করেই দিলাম কী ব্যাপার, আজ এত লম্বা নেটে থাকলেন? টেস্ট শুরুর আগের দিন এত লম্বা তো কখনও করেন না। সচিন এক সেকেন্ড থামলেন, বললেন, “হু, আজ থোড়া কম হো গয়া,” ঢুকে গেলেন ড্রেসিংরুমে। |
৩. আম আদমির প্রতি দায়িত্ব |
গত তিরিশ বছরে দুশোরও বেশি ক্রীড়াবিদ দেখেছি। সবাই চান, ভাল খেলতে। বাড়তি দায়িত্ব নিতে। দেশকে জেতাতে। কিন্তু তেন্ডুলকর একমাত্র যিনি বছরের পর বছর দেশবাসীর প্রতি ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধের কথাও প্রতি মিনিট মনে রেখেছেন। তাঁকে কভার করতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে, এই লোকটা একসঙ্গে দু’দিকের উইকেট ডিফেন্ড করে। একটা নিজের। আরেকটা আম আদমির। লোকটা জানে তার একটা সেঞ্চুরি কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা আলো জ্বালিয়ে দিতে পারে। ম্যাচ জেতানো একটা ৭৫, রাম জন্মভূমি হিসেবে দেখা উচিত না বাবরি মসজিদ থাকতে দেওয়া উচিত, এই বিতর্ক সাময়িক থামিয়ে দিতে পারে। সে জানে আমি কোম্পানির বড় কর্তা হতে পারি, কিন্তু আসল শেয়ার হোল্ডার এই লোকগুলো। আমরা তাঁদেরই ভাগ্যবান প্রতিনিধি। তাই প্রতি মুহূর্তে এদের কাছে আমার জবাবদিহি করার দায় থাকে। ওয়াংখেড়ের বিখ্যাত বক্তৃতায় সচিন যে দেশের ক্রীড়ামোদী মানুষকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করলেন সেটা তো এই দায় থেকেই। কত লোক তো রিটায়ার করে। ক’জনই বা বিদায়বেলায় সাধারণ মানুষের কথা মনে রাখে। ফ্লাশব্যাকে যাই, ২০০৭ পোর্ট অব স্পেন-য়ের এক বিকেল। ঠিক আগের দিন টিম চ্যাপেল প্রাথমিক রাউন্ডে বিদায় নিয়েছে বিশ্বকাপ থেকে। দেশ জুড়ে ক্ষোভ। |
|
ধোনির বাড়িতে পাথর ছোড়া হয়েছে। বেহালায় সৌরভবিরোধী বিক্ষোভ। বেঙ্গালুরু দ্রাবিড় নিয়ে উত্তেজিত। সচিনের বাড়িতে পর্যন্ত এই প্রথম হামলা হয়েছে। টিমের মধ্যেও চাপা উত্তেজনা আর টেনশন। দু’টো শিবিরে দল কার্যত ভাগ হয়ে গিয়েছে। একদিকে গ্রেগ-রাহুল। ওদিকে সৌরভ-সচিন। গ্রেগ টিমে নাকি কিছু ইনফর্মারও রেখে দিয়েছেন। যারা সৌরভ-সচিনকে একসঙ্গে দেখলে খবর দিচ্ছে, আবার দল বিরোধী চক্রান্ত শুরু হল। এই অবস্থায় ফ্লোরের কোনার দিকে সচিনের ঘরে বেল বাজালাম। দরজা খুলে যে বিধ্বস্ত সচিন বার হলেন, তাঁকে এমন জীর্ণ দশায় আগে কখনও দেখিনি। সব চেয়ে অবাক লাগল, পরনে সেই দশ নম্বর জার্সি, যা পরে তাঁকে শ্রীলঙ্কা ম্যাচে শূন্য রানে আউট হতে দেখেছি। পাশের প্লেটে আধখানা ক্লাব স্যান্ডউইচ পড়ে রয়েছে। শুনলাম গত একদিনে ওই স্যান্ডউইচই খেয়েছেন। শোকে গলা দিয়ে খাবার ঢুকছে না। আমায় শুধু জিজ্ঞেস করলেন, “দেশ থেকে আর নতুন কোনও খবর এল? আর কোনও উত্তেজনার?” এর পর বললেন, “কাউকে আমি দোষ দিই না। দেশবাসী এত আশা করে ছিল ওয়ার্ল্ড কাপে। আমরা পুরো ডুবিয়েছি।” মর্মস্পর্শী লেগেছিল খাটের ওপর ওই দশ নম্বর জার্সি পরে বসে থাকাটা। ওই নিশ্চেষ্টতা আর সর্বগ্রাসী অপরাধবোধের মধ্যেও কোথাও একটা নতুন জ্বলে উঠতে চাওয়ার স্ফুলিঙ্গ লুকিয়ে ছিল। কিন্তু তার চেয়েও আকর্ষণীয় লেগেছিল যে, মানুষটা শুধু নিজের ব্যর্থতায় ক্ষতবিক্ষত নয়। আমাদের বিষণ্ণতার কথাও সে মনে রেখেছে আর দ্বিগুণ কষ্ট পাচ্ছে। এর পর লোকটা যে দিন রান করবে আর জিতবে, সে দিনও স্বার্থপর পেশাদারের মতো কেবল নিজের কথা ভেবে উল্লাস করবে না! |
৪.
তুঙ্গ সাফল্য নিয়েও বসে না থাকা |
সেঞ্চুরিয়নের অমর ৯৬ ঘটেছে ঠিক একদিন হল। অথচ দুপুরে ইন্ডিয়ান টিম হোটেলে গিয়ে তেন্ডুলকরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সৌরভের ঘরে গেলাম। আগের দিনের পাকিস্তান জয় নিয়ে কথা বললাম। সচিন পাকিস্তান বধের মুখ্য কারিগর, তিনি কোথায় গেলেন? ঘর তো অন্ধকার। সৌরভের ঘরে আবার ফেরত। তিনি জানেন না। হরভজনও ঘাড় নাড়লেন, “কোনও ধারণা নেই। তবে লবিতে তো দেখিনি।” তা হলে কি টিম রুমে? না, সেখানেও নেই। কী মনে হল সচিনের ঘরেই টোকা মারলাম। দরজাটা সামান্য ফাঁক করে যে মুখটা বার হয়ে এল, তাঁকে আসমুদ্রহিমাচল চেনে। কিন্তু ঘরটা এমন অন্ধকার করে দিয়ে তিনি কী করছিলেন? ঘুমোচ্ছিলেন? না, এতক্ষণে দেখা গেল ঘরের একটা অংশে আলো রয়েছে। টিভি থেকে ঠিকরে আসা আলো। বললাম, গোটা ভারতবর্ষ অকাল দেওয়ালি পালন করছে আপনার ব্যাটিংয়ে। কী খুশি সবাই পাকিস্তানকে এই ভাবে হারিয়ে। আর আপনি নিজে কিনা এমন অন্ধকারে বসে রয়েছেন। সচিনকে তখন লাগছিল ‘রক্তকরবী’র রাজা। নিজে আড়ালে থেকে যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে। |
|
সব কিছু চলছে তার অঙ্গুলিহেলনে। অথচ নিজে সে নেপথ্যে। সচিন দেশের উৎসবের খবরটা আগেই পেয়েছেন। ডিটেলস পেয়ে আরও খুশি। বললেন, “একটু চা বানাই দাঁড়ান।” সেই ফাঁকে নজরে এল তিনি কী দেখছেন। দেখছেন অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ। দুধ কতটা, চিনি লাগবে কি না বেশ তুরীয় মেজাজে। এরই মধ্যে পন্টিং বল তুলে দিলেন ব্রেট লি-কে। সচিনও চা বানানো থামিয়ে দিলেন। “দাঁড়ান, ওভারটা দেখে নিই।” মুহূর্তে তিনি মাঠের মধ্যে থাকা অপরিচিত লোকটা। চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেল, “ফাইনালে যদি যাই, লি-কে খেলতে হবে। একটু দেখে নেওয়া ভাল।” অতুলনীয় মনে হয়েছিল মুহূর্তটা! ব্রেট লি মঙ্গলগ্রহ থেকে হঠাৎ নেমে পড়া কোনও অপরিচিত চ্যালেঞ্জ নন, যাকে সচিন আগে দেখেননি। বহু বার খেলেছেন। লি-র কোনও রহস্যই অবশিষ্ট থাকা উচিত নয় তাঁর কাছে। তবু আজ এই আনন্দে ভেসে যাওয়ার দিনেও পরের পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছেন। এ জন্যই তিনি আদর্শ, যে গন্তব্যে পৌঁছে গেছি কখনও ভাবেননি। বরঞ্চ গন্তব্যকে আরও বিস্তৃত করে দিয়েছেন। এজন্যই চব্বিশ বছরের পেশাদার জীবনে মিডিয়া একবারের জন্যও বলার সুযোগ পেল না, সচিন একটু যেন আত্মতুষ্ট হয়ে পড়েছে! |
৫.
চ্যাম্পিয়নের বন্য সাহস |
ম্যাঞ্চেস্টার ১৯৯৯। দেশজোড়া বিশাল বিতর্ক উঠে গিয়েছে যে বিশ্বকাপে সচিনের ওপেন করা উচিত হবে কি না? কপিল দেব অসমসাহসী কপিল দেব পর্যন্ত রায় দিয়েছেন, সচিন খেলুক চার নম্বরে। ইংল্যান্ডের পরিবেশে বল এত সিম আর সুইং করে যে, সচিনের ওপেন যাওয়াটা বিশাল ঝুঁকি হয়ে যাবে। একটা বল যদি অতর্কিতে খুব বেশি ভাল পড়ে, তা হলেই তো গেল। আর শুরুতে সচিনের উইকেট যাওয়া মানে আর টিম মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এমন নেগেটিভ পরিকল্পনার যিনি সব চেয়ে বিরোধী, তিনি স্বয়ং সচিন তেন্ডুলকর। বাবা মারা যাওয়ার পর ফেরত এসে কিনিয়ার বিরুদ্ধে ওই অবিস্মরণীয় সেঞ্চুরিটা করলেন। ব্রিস্টলের সমাধিতেই হয়তো নাড়িয়ে দিলেন ডব্লু জি গ্রেসকে। কিন্তু তার পরেও তাঁকে নিয়ে বিতর্কটা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এক না চার? কোন জায়গাটা ঠিক হবে? ম্যাঞ্চেস্টারে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অসম্ভব তাৎপর্যপূর্ণ ম্যাচ! কার্গিলযুদ্ধ চলছে তখন। ম্যাচটা জেতা মানে যুদ্ধেও একধাপ এগিয়ে যাওয়া। ফের টিম মিটিং। ফের সেই প্রসঙ্গ। কোচ অংশুমান গায়কোয়াড় বললেন, “আক্রম হয়তো ওদের বোলিং ওপেন করবে। তার পর শোয়েব আছে। |
|
ওয়াকার আছে। এক বলের ব্যাপার। কী করবে? আগে যাবে?” সচিন বললেন, “এক বল যেটা বলছেন, সেটা তো আমার স্ট্রোকে বাউন্ডারিও হতে পারে।” আগের দিন রাত্তির অবধি আনন্দবাজারে পরিস্কার করে লিখতে পারিনি সচিন ওপেন যাবেন কি না? যেহেতু টিম মিটিং দ্বিধাবিভক্ত ছিল। পরের দিন দেখা গেল, ভারতীয় ইনিংসে স্ট্রাইক নিচ্ছেন সচিন-ই। প্রথম বল পয়েন্ট দিয়ে চার। বোলার? আক্রম। রান করেছিলেন চল্লিশের কিছু বেশি। চার বছর পর পাকিস্তান ম্যাচের সময় যুদ্ধ-টুদ্ধর ব্যাপার নেই। কিন্তু বিশ্বকাপ বলে একটা গা ছমছমে ব্যাপার তো রয়েছেই। রোমাঞ্চটা টেনে ছিঁড়ে দিল পাকিস্তান প্রথম ব্যাটে গিয়ে ২৭৩ করে। সৌরভের ভারত যখন ড্রেসিংরুমে ফিরছে, তাদের বডি ল্যাঙ্গোয়েজ থেকেই বোঝা যাচ্ছে এর পর কী ঘটতে চলেছে। ভাবলাম ম্যাচ রিপোর্টটা এখনই শুরু করে দেওয়া যায়।
সচিন-সহবাগ যখন এর পর কথা বলতে বলতে ড্রেসিংরুম থেকে নামছেন, আন্দাজ করার চেষ্টাই করিনি কী কথা হচ্ছে। আর কী, ম্যাচই তো চলে গ্যাছে। গোটা টুর্নামেন্টে সচিন ওপেনিংয়ে নন-স্ট্রাইকার থাকছিলেন। প্রথম বল খেলছিলেন সহবাগ। আজ উল্টো হচ্ছে খটকা লাগলেও তখনকার মতো দূর করার সময় পেলাম কোথায়! প্রথম বল থেকেই তো মারতে মারতে ধুতরো ফুল দেখিয়ে দিলেন সচিন। পরের দিন জানলাম, ব্যাট করতে যাওয়ার সময় কী কথা হয়েছিল?
সহবাগ: পাজি কেয়া করনা হ্যায়?
(ছোট একটা প্রেক্ষাপট আছে। সৌরভ নির্দেশ দিয়েছেন প্রথম দশ ওভার উইকেট হাতে রেখে সেফ খেলতে)
সচিন: কেয়া করনা হ্যায়, পাকিস্তানকো শুরু সে মারনা হ্যায়।
সহবাগ: (তখন মাঠের ঘাসে পা পড়ে গেছে) একটা রিকোয়েস্ট করছি।
সচিন: কী?
সহবাগ: আক্রমকে আমি কখনও খেলিনি। তুমি প্লিজ স্ট্রাইক নেবে? মনে রাখতে হবে সচিন গোটা বিশ্বকাপে রান করেছিলেন ওপেনিংয়ে নন-স্ট্রাইকার থেকে। বলতেই পারতেন, এত পরে বললি কেন? অন্তত ইন্দো-পাক ম্যাচে আমার মেন্টালি অ্যাডজাস্টমেন্টের জন্য তো একটা সময় লাগবে। কিছুই বললেন না। সটান চলে গেলেন স্ট্রাইক নিতে। চ্যাম্পিয়নের বন্য সাহস! |
৬. রামচন্দ্রের হনুমান |
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি মুগ্ধ বিস্ময়ে প্রথম কথাটা বলেন, “ক্রিকেট যদি রাম হয়, সচিন হল হনুমান। সব চেয়ে বড় ধার্মিক।” রাহুল দ্রাবিড়ও একমনা ছিলেন। উপাসনার মতো করে ব্যাটিংকে দেখেছেন। অনবরত শ্যাডো করতেন ড্রেসিংরুমে। হোটেলের ঘরে। তফাত হল, ক্রিকেট ভালবাসায় সচিন যেন মৌলবাদী। আর অসম্ভব ধর্মভীরু। অন্ধ একটা বিশ্বাস ছিল তাঁর যে, ক্রিকেটের বিশুদ্ধতার সঙ্গে বাণিজ্যকে গুলিয়ে ফেললে ঈশ্বর খেপে গিয়ে রান দেবেন না। দু’টোকে আলাদা রাখতে হবে। পবিত্রতায় কোনও বেনোজল ঢোকানো যাবে না। সিরিজের মধ্যে তাই কখনও কোনও পণ্যের বিজ্ঞাপনে কাজ করেননি সচিন। একবার ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় আর তৃতীয় টেস্টের মধ্যে ন’দিনের বিরতি। পেপসি বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার অতুল কাসবেকর-কে বলল, সচিনের অ্যাড শ্যুট নতুন করে করতে হবে। আপনি ইংল্যান্ড চলে যান। অতুলের বুকিং লন্ডনের টিম হোটেলেই করা হল। হোটেলে যখন চেক ইন করছেন, ইন্ডিয়ান টিম তখন প্র্যাকটিসে বার হচ্ছে। সচিন এমনিতে অতুলের বন্ধু। মুখোমুখি পড়ে যেতে বললেন, “আরে তুমি এখানে?” ফোটোগ্রাফার তো অবাক, “এখানে মানে? আমি তো তোমার কাজেই এসেছি। পেপসি শ্যুটে।” সচিনের বিস্ময় যাচ্ছে না। এর পর ডিনারে বসে অতুলকে বললেন, “কী ব্যাপার বলো তো? পেপসি শ্যুট তো আমি না-করে দিয়েছি। সিরিজের মধ্যে আমি শ্যুট করি না। আমি ক্রিকেটটাকে কোনও ভাবে অবহেলা করতে চাই না।” |
|
বেশ কনফিউজড হয়ে যাওয়া অতুল এর পর ফোনে ধরলেন পেপসি কর্তাকে, “আরে এ তো বলছে শ্যুট করবে না। তাছাড়া ও নাকি আপনাকে শ্যুটটা কনফার্ম করেনি?” কর্তাটি বলেন, “ও গাঁইগুঁই করছিল। কিন্তু আমি জানি তুমি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তুমি সামনে দাঁড়িয়ে গেলে ঠিক শ্যুট করে দেবে। তা ছাড়া ন’দিনের গ্যাপ আছে দু’টো টেস্টের মধ্যে। কয়েক ঘণ্টা বার করা এমন কী ব্যাপার?” সচিন কিন্তু ‘না’টাকে আর ‘হ্যাঁ’ করলেন না। বললেন, “অতুল, তুমি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এখানে থেকে যাও। আমরা রোজ আড্ডা মারব। ডিনার খাব। কিন্তু শ্যুটটা করতে পারব না। ওটা আমার নীতিবিরুদ্ধ হবে।” অতুল কমার্শিয়াল ফোটোগ্রাফির জন্য লন্ডন বয়ে আনা প্রয়োজনীয় সব ভারী ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে পরের দিন ন’ঘণ্টার মুম্বই ফ্লাইটে চড়লেন। একেবারে নিস্ফল সফর। কিন্তু সারাটা রাস্তা ভাবতে ভাবতে এলেন, এ জন্যই সচিন তেন্ডুলকর! বেঙ্গালুরুতে তাঁরই জীবনের ওপর, তাঁকে নিয়ে ‘সচ্’ রিলিজের আগেও একই ছবি। ১০ ফেব্রুয়ারি ডেট পাওয়া গেল সচিনের। তার আগে তুঙ্গ ব্যস্ততা। আগের রাতে বেঙ্গালুরু পৌঁছবেন কন্ডিশনিং ক্যাম্পের জন্য। আর সচিনের সামনে বই রিলিজ করবেন কুম্বলে-ধোনি। হঠাৎ সচিন জানিয়ে দিলেন, তিনি অনুষ্ঠানে আসবেন, স্টেজে বসবেন না। সে কী? উদ্যোক্তারা চরম আতঙ্কিত। আপনি স্টেজে বসবেন না, হয় নাকি? আপনার উপরই তো বই।
সচিন: কিছু এসে যায় না। দিনের শেষে এটাও কমার্শিয়াল প্রোডাক্ট। আমি নিজে যখন বিশ্বকাপের আগে স্পনসরদের এত ধরাধরিতেও অ্যাড শ্যুট করিনি, এটাই বা করব কী করে? তাছাড়া কন্ডিশনিং ক্যাম্প হওয়ার দিন এটা রিলিজ হচ্ছে। আমার কাছে সে দিন থেকে বিশ্বকাপ শুরু। তাই আমি স্টেজে বসব না। বই নিয়েও কিছু বলতে পারব না। যদি আমাকে স্টেজে তুলতেই হয়, রিলিজটা বিশ্বকাপের পরে করুন। শেষমেশ বহু বুঝিয়ে এক মিনিটের জন্য তাঁকে মঞ্চে তোলা গেল। যখন ধোনি তাঁর হাতে বিশ্বকাপের জন্য শুভেচ্ছাসূচক ফুলের তোড়া তুলে দিলেন। কিন্তু এইটুকুই। এমনকী টিভিতে বাইট দিতেও রাজি হলেন না। অসামান্য লেগেছিল সেই মনোভাব! এই হল সত্যিকারের ক্রিকেটধার্মিক যে কোনও মূল্যে, কোনও প্রলোভনেই নিজের উপাসনার সঙ্গে আপস করতে রাজি হয় না।
পুনশ্চ: সচিন রমেশ তেন্ডুলকর সম্পর্কে সেরা অভিজ্ঞতা হল, তাঁর রূপকথাসদৃশ বিবর্তন! ডারউইনের তত্ত্বেও বোধহয় একজন্মে এই পর্যায়ের বিবর্তনের ব্যাখ্যা হয়নি। নইলে ১৯৮৮-তে ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামে যাঁর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে বারবার থমকেছি। বিব্রত আর বিরক্ত হয়েছি ভাঙা ভাঙা সেনটেন্স আর ওই মেয়েলি গলা নিয়ে কী করব ভেবে? পরবর্তী সময়েও মন খুলে কথা বলেননি। মনে হয়েছে এ ব্যাটিংয়েই চ্যাম্পিয়ন। মাঠের বাইরে নয়। ওয়াংখেড়েতে বিখ্যাত, বিদায়ী বক্তৃতার পর সব কথাবার্তা বন্ধ। এক এক সময় মনে হচ্ছে বক্তৃতাটা সচিনের ১০১তম সেঞ্চুরি। এমনই প্রভাব হয়েছে তার যে ভারতীয় খেলাধুলোর ইতিহাসে আর কখনও এর কাছাকাছি কেউ কখনও শোনেনি। বা দেখেছি ইস্টবেঙ্গল এখন ভাবছে বড় ম্যাচের আগে সেই বক্তৃতার টেপ ড্রেসিংরুমে ফুটবলারদের জন্য বাজাবে। ম্যানেজমেন্ট স্কুলগুলো ভাবছে তাদের শিক্ষার্থীদের শোনাবে। ইউ টিউবে যার হিট অলরেডি দশ লাখের কাছাকাছি। ওবামার সেই বিখ্যাত ‘ইয়েস উই ক্যান’য়ের সঙ্গে ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রভাবে সমতুল্য মনে করছেন কেউ কেউ। এত কাল মনে করা হয়েছে কেবল ব্যাটকে হাতিয়ার করেই লড়তে আর জিততে পারেন তেন্ডুলকর। মাইক্রোফোন হাতেও এই ইনিংস খেলতে পারেন কে জানত! কোথাও তাই মনে হচ্ছে, মনে গেঁথে যাওয়া সেরা আধ ডজন কাহিনি লিখলাম, তার ভাষ্যতে সংশোধন হতে বাধ্য। নতুন এডিশন বার হতে বাধ্য। কারণ তেন্ডুলকর যে নিছক এক নম্বর হতে আসেননি। এসেছেন জিততে। আরও বেশি করে দিশারী হতে।
চ্যাম্পিয়ন হয় বাকিরা। তাঁর লক্ষ্য যে রূপকথার চ্যাম্পিয়ন হয়ে চিরকালীন থেকে যাওয়া। |
|
|
|
|
|