মনোরঞ্জন...
আমাকে আমার মতো নাচতে দাও
রুমাল যদি বেড়াল হয়, হারমোনিয়াম থেকে গিটার হতে কত ক্ষণ? আর, কত্থক থেকে সালসা?
কী হল? বোঝা গেল না? আচ্ছা, তবে কয়েকটা ঘটনা বলি।
উঁচু ক্লাসে পড়াশোনার চাপ বাড়ছে। গলা সাধার সময় বার করা ক্রমশ মুশকিল হচ্ছে। ক্লাস নাইনের মেয়েটি ঠিক করল, স্কুলে একস্ট্রা কারিকুলার সাবজেক্ট হিসেবে ইস্টার্ন মিউজিকই নেবে। তা হলে সপ্তাহে এক দিন অন্তত স্কুলেই রেওয়াজটা হয়ে যাবে।
কিন্তু সেটা করা গেল না। কেন? কারণ, ইস্টার্ন মিউজিকের ক্লাস করার মতো যথেষ্ট ছাত্রীই জুটল না। ফলে ওই বছরের জন্য সাবজেক্টটাই মুলতুবি হয়ে গেল। অথচ ওই একই ক্লাসে ওয়েস্টার্ন মিউজিকে ভিড় কিন্তু ঠাসা।
দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী স্কুলের ঘটনা। মেয়ের মা, রুশতী সেন, নিজে দক্ষিণ কলকাতারই একটি মেয়েদের কলেজের শিক্ষিকা। কথায় কথায় তাঁর কাছেই গল্পটা শোনা।
পাশাপাশি রাখুন, স্বপন মিত্রের বয়ান। স্বপনবাবু কলকাতার পদাতিক ডান্স সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত। পদাতিক ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য, মূলত কত্থক শেখায়। পাশাপাশি আছে ওয়েস্টার্ন ডান্সের কোর্স। কত্থকের ক্লাসে ১০০-র ওপর ছাত্রছাত্রী থাকলে ওয়েস্টার্ন ডান্সে সেটা হাজার ছাড়িয়েছে। কলকাতা শহরে ৩০-৩২টা সেন্টার খুলেও ভিড় সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। অথচ বছর চার-পাঁচ আগে সল্টলেকে কত্থকের জন্য একটি দ্বিতীয় সেন্টার খোলা হয়েছিল। ছাত্রছাত্রীর অভাবে বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
আরও শুনবেন? “একটা নতুন ছেলে পাই না আজকাল। স্টুডিয়োতে সেতার, সরোদ বা বাঁশিতে নতুন হাত খুঁজে পাওয়া দায়!” আক্ষেপ করছেন প্রবীণ যন্ত্রশিল্পী-সুরকার চন্দন রায়চৌধুরী, ১৯৭২ সালে কলকাতায় প্রথম কি-বোর্ড এসেছিল যাঁর হাত ধরে! বলছেন, মারুতি গাড়ির স্পেয়ার পার্টসের মতো ঢেলে বিকোচ্ছে গিটার, কি-বোর্ড। পাঁচ থেকে পঁচিশ, মজেছে এই দুই বাদ্যযন্ত্রের ফ্যাশনে!
বছর দশ-পনেরোর মধ্যে বদলটা এল, মানছেন তিন জনেই। কলকাতার মধ্যবিত্ত পাড়া মানেই সেই যে সন্ধে হলে শাঁখের আওয়াজ আর ধূপের গন্ধের সঙ্গে অবধারিত ভাবে হারমোনিয়ামের প্যাঁ-পোঁ, আর কচি থেকে শুরু করে কিশোরী গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত-নজরুলগীতি প্র্যাকটিস করার চল কিংবা একটু কান খাড়া করলে ঘুঙুরের সঙ্গে ‘তা তেই তেই তৎ’... তাঁতের শাড়ি পরা গানের দিদি, ঘাড়ে পাউডার-ল্যাপা তবলা কাকু, কোমরে ওড়না বাঁধা কত্থকের মিস্... না মশাই, সে দিন আর নেই!
খামোখা থাকবেই বা কেন? “সাদা-কালো টিভি আছে? এটা কি দূরদর্শনের ফার্স্ট চ্যানেল-সেকেন্ড চ্যানেল, হরেকরকমবা-চিচিং ফাঁকের যুগ?” ঝাঁঝিয়ে ওঠে সায়ন, কলকাতার নামী কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কাঁধে গিটার ঝুলছে। ঠিক যেন ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-য়ের সমদর্শী দত্ত! এক্ষুনি গেয়ে উঠবে, ‘ট্রামগাড়ি চলছে ঘটাং ঘটাং...’!
হ্যাঁ, ঠিকই তো! এটা ডান্স বাংলা ডান্স, সারেগামাপা লিটল চ্যাম্প, ইন্ডিয়ান আইডল আর ঝলক দিখলা জা-র যুগ! ব্যান্ড সঙ্গীতের যুগ। তন্ত্র আর ইনকগনিটো-র যুগ। সাবেকি চেহারা তো বদলাবেই।
নামী শিল্পীদের কাছে শিক্ষার্থীর ভিড় হয়তো পাতলা হয়নি। দক্ষিণী, গীতবিতান বা বাণীচক্র-র মতো নামী প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা হয়তো কমেনি। বাণীচক্র-য় প্রায় আড়াই হাজার ছেলেমেয়ে গান শেখে, দু’লক্ষের বেশি নাচের ক্লাস করে। তার বাইরে স্কুল-কলেজ, পাড়ায়-ক্লাব, অ্যামেচার নাচ-গানে ধরন অনেকটা অন্য রকম।
রুশতী বলছিলেন, কলেজের মেয়েদের কোনও অনুষ্ঠান করতে বললে আগে তারা নিজেরা নেচেগেয়ে কিছু করার চেষ্টা করত। এখন বলে, “ব্যান্ড আনব। ব্যান্ডের গানের সঙ্গে নাচব।” পার্ক স্ট্রিটে বিখ্যাত ব্রাগাঞ্জার দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, দশ বছর আগেও যদি সেখানে মাসে ১০টি গিটার বিক্রি হত, এখন হচ্ছে ৬০টি! অন্য দিকে, মুখে স্বীকার করতে না চাইলেও একাধিক দোকানির হাবেভাবে স্পষ্ট, ঘুঙুরের চাহিদা কমতির দিকে!
ঘরে ঘরে সেতার-সরোদ সবাই শিখত না কোনও দিনই। উঠতি বয়সের ছেলেরা কেউ কেউ তবলায় ঠেকা দিত, কারও কারও মাউথ অর্গানের শখ থাকত। বাকিরা শিস দিয়ে আর টেবিল বাজিয়েই খুশি ছিল। ইদানীং তাদের মুখে গিটার, কি বোর্ড আর ড্রাম ছাড়া কথা নেই। বাঙালির নাচও আর পাড়ার ফাংশন বা ভাসানের মিছিলে সীমাবদ্ধ নেই। বাঙালি বিয়েতেও এখন দিব্যি ‘সঙ্গীত’-য়ের আসর বসছে! নাচ এখন পার্ট অফ লাইফ!
স্বপনবাবু বলছিলেন, কত্থকের ক্লাস আর ওয়েস্টার্ন ডান্সের ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা স্পষ্ট তফাত ওঁদের চোখে পড়ে। ছেলেমেয়েকে কত্থক শেখাতে নিয়ে আসেন যে বাবা-মায়েরা, তাঁরা চান নাচটা শিখুক। ভাল ভাবে শিখুক।
ওয়েস্টার্ন ডান্সে কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাজ চালানো গোছের শিখে নেওয়াটাই বড় কথা। নাচটা সেখানে গ্রুমিংয়ের অংশ। পার্টিতে, নাইটক্লাবে, বিয়েবাড়িতে যাতে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়তে না হয়, সেটাই আসল উদ্দেশ্য। “শুধু কী ছোটরা, নতুন দম্পতিরাও আসছেন! এসে বলছেন, পার্টিতে যেতে হয় তো! একটু শিখে না নিলে চলছে না!”

ওঁরা বললেন
গান শেখানোর দিদিমণি পাওয়াই এখন খুব মুশকিল। অত কম পয়সায় কেই বা গান শেখাবে! ওঁরা এখন রাতারাতি গানের স্কুল খুলে অনেক বেশি পারিশ্রমিক নিচ্ছেন।
শ্রীকান্ত আচার্য
বেশির ভাগেরই লক্ষ্য এখন রিয়্যালিটি শো, টাকা, নাম-যশ। চটজলদির যুগ। কনভেনশনাল নাচ-গান করতে যে ডেডিকেশন লাগে, সেটা এখন উধাও।
অলকানন্দা রায়
আমাদের ছোটবেলায় যে নিয়মিত রিহার্সাল বা চর্চার ব্যাপারটা ছিল, সেটা
যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। তবে যাদের সিরিয়াসলি শেখার, তারা কিন্তু এখনও শিখছে।

লোপামুদ্রা মিত্র
সাক্ষাৎকার: অদিতি ভাদুড়ি।

ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অব ডান্স ড্রামা মিউজিক অ্যান্ড ভিস্যুয়াল আর্টস-এর তরফে হৈমন্তী চট্টোপাধ্যায় লক্ষ করেছেন, নাচ এবং গানে ফিউশনের প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। এবং তাতে ক্লাসিকাল, ওয়েস্টার্নের পাশাপাশি মিশছে ফোক-ও।
ক্লাসিকাল নাচের আসর এখন হয় ক’টা? আক্ষেপ করলেন নৃত্যশিল্পী পলি গুহ। ক্রিয়েটিভ ডান্স ছাড়া তো উপায়ও নেই সে ক্ষেত্রে। তবে সেটার জন্যও ক্লাসিকালের প্রশিক্ষণ লাগে। ফলে যে বাবা-মায়েরা চাইছেন, ছেলেমেয়েরা নাচটা ঠিকঠাক শিখুক, তাঁরা ক্লাসিকালই শেখাচ্ছেন।
গানের ক্ষেত্রেও অঙ্কটা একই। তবে রিয়ালিটি শো নিয়ে বাবা-মায়েদের ক্রেজটা ইদানীং খুবই লক্ষ করছেন পলি। বিশেষত শহরতলিতে। তবে তাঁর বিশ্বাস, স্রোতে গা ভাসানোর প্রবণতা সব যুগেই থাকে। আবার অন্য একটা দলও থাকে, যারা নিজেদের জায়গাটা ধরে রাখে।
এই ধরে রাখার শিক্ষাটা বাবা-মায়েরই দেওয়ার কথা, বলছেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। সহজে বাজিমাত করার মন নিয়ে ক্লাসিকাল শেখা যায় না, বলছিলেন অজয়বাবু। “মনে হবে, আর বুঝি পারলাম না। তাও থামলে চলে না। সেই ধৈর্য আজকের দিনে খুব কম চোখে পড়ে।”
হৈমন্তী শুক্লা বলছেন, “গান নকল করে গাওয়াটাই মুখ্য হতে বসেছে এখন! নাম হবে, টাকা হবে, টিভিতে মুখ দেখা যাবে তার জন্য গানবাজনা?” একই সুর চন্দনবাবুর গলাতেও। বললেন, ভাল পিয়ানো বাজাতে না জানলে ভাল কি-বোর্ড বাজানোও যায় না। কিন্তু বাজনাটা ভাল করে শেখার প্রবণতা এখন কম। “এখনকার গানও অনেক সরল হয়ে এসেছে। গিটারে তিনটে কর্ড বাজাতে জানলেই একটা গান তুলে ফেলা যাচ্ছে। ফলে গিটার, কি-বোর্ড শেখাটাও জলভাত হতে বসেছে।”
অমল লাহা আর চন্দন মিলে যখন সত্তর দশকে কি-বোর্ড আনলেন, তখন এক-একটা ডবল ডেক কি-বোর্ডের ওজন ৬৩ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হত। এখন সেখানে নানা সাইজের হালকা কি বোর্ড বেরিয়েছে, গিটারও ছোট আর হালকা হয়েছে। বাচ্চাদের পক্ষে এটাও সুবিধাজনক। এবং এর সঙ্গে অবশ্যই রয়েছে কবীর সুমনের প্রভাব।
দু’দশক আগে গিটার হাতে ‘তোমাকে চাই’ গেয়ে বাংলা গানের মানচিত্র বদলে দিয়েছিলেন সুমন। বাঙালি যুবকের নতুন রোল মডেল হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তার পর থেকে বাংলা ব্যান্ডের রাস্তা বেয়ে সেই ধারা এখনও সচল।
চন্দ্রবিন্দু-র অনিন্দ্য বলছিলেন, “গিটার মানে যৌবন, গিটার মানে রেবেল! তার সঙ্গে মূলধারার সঙ্গীতচর্চা, গুরুশিষ্য পরম্পরা ইত্যাদির যোগ সে ভাবে নেই কিন্তু!”
নিজের মতো করে গান বাঁধা, ব্যক্তিগত গান তৈরির ঝোঁকই এই সময়টাকে ইন্টারেস্টিং করে তুলেছে বলে মনে করেন অনিন্দ্য। কিন্তু চন্দনবাবুর আক্ষেপ, “সুমনের মতো সঙ্গীতজ্ঞান ক’জন কতটা অর্জন করার চেষ্টা করল কে জানে! যেমন তেমন করে গিটার বাজানোর ঝোঁকটা গেল বেড়ে!”
তাতে অসুবিধা কোথায়? সায়ন আবার উত্তেজিত। “প্রত্যেকটা সময়ই তার নিজস্ব রিদ্ম-এ বাঁচে। আমরা ব্যান্ড কালচারের সঙ্গে রিলেট করি। গিটার বাজাই। যেমন পারি, তেমন বাজাই। এতে আপত্তি কেন?” শুধু বাংলায় তো নয়, সারা ভারতেই এক ছবি।
অতএব? আমাকে আমার মতো নাচতে দাও, আমাকে আমার মতো গাইতে দাও...জেন ওয়াইয়ের থিম টিউন নিঃসন্দেহে এটাই।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.