প্রার্থীদের অনেকেই স্নাতক। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও অনেকের দখলে। এমনকী পিএইচডি ডিগ্রিধারীও ছিলেন। তা সত্ত্বেও সাড়ে ১৭ লক্ষ পরীক্ষার্থীর মধ্য থেকে ৩৫ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক পদ পূরণের যোগ্য লোক পাওয়া গেল না। প্রায় অর্ধেক পদই ফাঁকা থেকে গেল। কারণ, প্রাথমিক শিক্ষক বাছাই পরীক্ষা (টেট)-য় ১.০৭ শতাংশের বেশি প্রার্থী পাশই করতে পারেননি!
টেট-এ পাশের হারের চিত্র এমন করুণ কেন, ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষাবিদদের একাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলেই এই পরীক্ষায় বসা যায়। সেই ধরনের প্রার্থীদের সঙ্গেই ছিলেন স্নাতক, স্নাতকোত্তর, পিএইচডি ডিগ্রিধারীরা। সেই সব পরীক্ষার্থী কেন উত্তীর্ণ হতে পারলেন না, তা পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ। শুধু শিক্ষাবিদ মহলে নয়, এই ফল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অন্দরেও। তাই সাফল্যের হার এত কম কেন, তা তাঁরা বিশ্নেষণ করে দেখবেন বলে জানান পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য। শুক্রবার টেট-এর ফল প্রকাশের পরে তিনি বলেন, “সম্প্রতি সিবিএসই বোর্ড জাতীয় স্তরে একটি টেট নিয়েছে। দেখা গিয়েছে, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষক বাছাইয়ে সাফল্যের হার এক শতাংশেরও কম।”
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু অবশ্য মনে করেন না, টেট-এ পাশের হার খুব খারাপ। তাঁর ব্যাখ্যা, যে ১.০৭ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাশ করেছেন, তাঁদের দিয়েই ৩৫ হাজারের মধ্যে সাড়ে ১৮ হাজারেরও বেশি পদ পূরণ করা যাবে। এ দিক থেকে সাফল্যের হার প্রায় ৫০ শতাংশ বলে মনে করেন মন্ত্রী। ব্রাত্যবাবু বলেন, “প্রায় ৫০ শতাংশ পদের জন্য শিক্ষক বাছাই করা গিয়েছে। সাফল্যের হার তাই ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। পরিস্থিতি অত্যন্ত আশাপ্রদ।” অঙ্কের হিসেব বলছে, পাশের হার ১.০৭ শতাংশ। সেটাকে ৫০ শতাংশ বলা যায় কী ভাবে? ব্রাত্যবাবুর বক্তব্য, এই ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্থীর নিরিখে সাফল্যের হার যাচাই করা ঠিক নয়। শিক্ষামন্ত্রীর এ-হেন মন্তব্যে শিক্ষাজগৎ বিস্মিত।
যে-সব পদ শূন্য থেকে গেল, সেগুলি কী ভাবে পূরণ করা যাবে?
ফাঁকা থেকে যাওয়া পদগুলিতে শিক্ষক বাছাইয়ের জন্য চলতি আর্থিক বছরের মধ্যে ফের পরীক্ষা নেওয়া হবে বলে জানান মানিকবাবু। আর শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “এই পরীক্ষায় যাঁরা সফল হতে পারেননি, তাঁদের মধ্যে যাঁরা ফের টেট দিতে চাইবেন, পরের পরীক্ষায় তাঁদের থেকে ফি নিতে বারণ করা হয়েছে মানিকবাবুকে।”
গত ৩১ মার্চ টেট নেয় প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। শুক্রবার পর্ষদ-সভাপতি জানান, ১৭ লক্ষ ৫১ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৮ হাজার ৭৯৩ জন সফল হয়েছেন। শূন্য পদের সংখ্যা ৩৪ হাজার ৫৫৯। সফল পরীক্ষার্থীদের ইন্টারভিউ নেওয়া হবে। আগামী ২ জানুয়ারির মধ্যে তাঁরা যাতে স্কুলে যোগ দিতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী প্রশিক্ষণপ্রাপ্তেরা আগে সুযোগ পাবেন বলে জানান সভাপতি। তবে পর্ষদ বলছে, কাজে যোগ দিলেও ওই সব প্রার্থীর চাকরির স্থায়িত্ব আদালতের রায়ের উপরে নির্ভর করবে। কারণ, ওই পরীক্ষার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছেন এক পরীক্ষার্থী। সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। পরবর্তী পরীক্ষায় ক্ষেত্রে আইনি সমস্যা এড়াতে যথাযথ পরামর্শ নিয়ে এগোনো হবে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী।
পরে যে-ভাবেই পরীক্ষা নেওয়া হোক, এ বারের টেট-এ সাফল্যের এই হারে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ দে-ও বিস্মিত। তিনি বলেন, “পুরো বিষয়টিই অবিশ্বাস্য। উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক স্তরে উত্তীর্ণ প্রার্থীরা এই পরীক্ষায় পাশ করতে পারবেন না, এটা মানতে পারছি না।” শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার মনে করেন, কোনও খামতির জন্যই সাফল্যের হার এতটা কম। তাঁর কথায়, “প্রশ্নপত্র কেমন হয়েছিল, উত্তরপত্র দেখার ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছিল, তা দেখতে হবে। তা হলেই বোঝা যাবে, ব্যর্থতা আসলে পরীক্ষা ব্যবস্থার, নাকি পরীক্ষার্থীদের।”
প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ অবশ্য জানিয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার এডুকেশন (এনসিটিই)-এর নির্ধারিত মানেই প্রশ্ন তৈরি করা হয়েছিল। উত্তরপত্রের মূল্যায়ন হয়েছে কম্পিউটারের মাধ্যমে। তাই পরীক্ষা ব্যবস্থায় ত্রুটি হয়নি বলেই পর্ষদ-কর্তৃপক্ষের দাবি।
এই ফল নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর ব্যাখ্যাতেও বিস্মিত পবিত্রবাবু। তিনি বলেন, “পরীক্ষার্থীর সংখ্যার ভিত্তিতে ফল বিশ্লেষণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যেমন মাত্র ১.০৭ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাশ করেছেন। এটাই পরীক্ষার ফল। তাই শিক্ষামন্ত্রীর ব্যাখ্যা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।”
শিক্ষাবিদ মর্মর মুখোপাধ্যায় অবশ্য পাশের এই হার খুব একটা অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন না। তাঁর মতে, কোনও একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের পরীক্ষা দেওয়া এবং সফল হওয়া অনেক সহজ। টেট তেমন পরীক্ষা নয়। মোট ১০০ নম্বরের টেট-এ শিশু মনস্তত্ত্ব, ইংরেজি, পরিবেশ, গণিত, আঞ্চলিক ভাষার পরীক্ষা হয়েছে। সফল হওয়ার জন্য পরীক্ষায় অন্তত ৬০% নম্বর পাওয়া বাধ্যতামূলক। মর্মরবাবু বলেন, “এমন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র শুধু বিষয়ের উপরে তৈরি হয় না। আমার মতে, প্রার্থীরা নিজেদের সে-ভাবে প্রস্তুত করতে পারেননি। তাই সমস্যায় পড়েছেন।” |