ভারতীয় দাবার ‘ওয়র্ল্ড ট্রেড সেন্টার’ গড়াগড়ি খাচ্ছে মাটিতে! মিশিগানে বসে শুক্রবার সাতসকালে এক অধ্যাপিকার অন্তত ঠিক এমনটাই মনে হচ্ছিল। তিনি বিশ্বনাথন আনন্দের দিদি, আরাধনা।
আরাধনা না-হয় নিজের দিদি। কিন্তু এ দিন চেন্নাইয়ে হৃদয়বিদারক ‘দ্য এন্ড’-এর জন্য কার্যত কোনও প্রস্তুতি ছিল না নিযুত ভারতবাসীরও। তাঁরা মজে ছিলেন ইতিহাসে। খেয়াল করেননি কখন, কোন কালে সে বই পোকায় কেটে দিচ্ছে।
ইতিহাস অবশ্যই গরিমার। যদি মাইলা থুরাইয়ের (চেন্নাইয়ের অদূরে অবস্থিত) এক সাধারণ রেলকর্মীর ছেলে আঠারোয় গ্র্যান্ডমাস্টার হন, পাঁচ বার বিশ্বখেতাবের মুকুট পরেন, ২৮০০ এলো রেটিং (আন্তর্জাতিক দাবায় পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে প্রাপ্ত পয়েন্ট) নিজের পার্সে রাখেন, হাফ ডজন দাবা অস্কারের ট্রফিতে ওয়ার্ডরোব সাজান, যাঁর নামের পাশে লেখা হয় সর্বকালের সেরা ব্লিৎজ দাবাড়ু— তা হলে তাঁকেই করতে হয় আইকন। ভারতীয়রা যথারীতি সেটাই করেছিল এত দিন।
করাটাই স্বাভাবিক। “কিন্তু দাবা দুনিয়ায় হালফিলে জল কতটা গড়িয়েছে, তার হদিস না রাখাটাও বোকামো হয়েছে”, বলছেন দিব্যেন্দু বড়ুয়া। না হলে আম-দর্শকেরও জানার কথা ছিল যে, নরওয়ের আকাশে সূর্য ওঠার পরে এই দিনটা আসতেই চলেছে। ৬.৫-৩.৫, অর্থাৎ একটা ম্যাচও না জিতে আনন্দ এ দিন যে ভাবে হারলেন, তার পরে এই মর্মান্তিক সত্যটা উপলব্ধি করছেন অনেকেই। স্বভাবতই ভেঙে পড়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে সেঁধিয়ে থাকা আনন্দের অজস্র ভক্ত। আর আনন্দ নিজে? আন্দাজ করাটা কষ্টসাধ্য নয়। যতই তাঁকে সৌজন্যের মোড়কে মোড়া ভদ্রলোক মনে হোক, আসলে তো অসম্ভব ইগো তাঁরও। |
কয়েক বছর আগে হায়দরাবাদের এক বিশ্ববিদ্যালয় আনন্দকে ডক্টরেট উপাধি দেবে ঠিক করেও পিছিয়ে আসে এই সংশয়ে যে তিনি ভারতের, না স্পেনের লোক? পরে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হস্তক্ষেপ করেন। আনন্দ রাজি হন উপাধি নিতে। কিন্তু সেটা ছিল নেহাতই মন্ত্রীর প্রতি তাঁর সৌজন্যবোধ। শত অনুরোধেও তাঁকে হায়দরাবাদে আনা যায়নি। তাঁর জাতীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, ব্যাপারটা আনন্দের আঁতে লেগেছিল। এ বার ভাবুন, সিংহাসন চলে যাওয়ায় কতখানি বিপর্যস্ত বোধ করতে পারেন মানুষটা। চেন্নাইয়ে শুক্রসন্ধ্যায় চুপসে যাওয়া অভিব্যক্তিতে সেটা পরতে পরতে ফুটে উঠছিল।
ফুটে উঠবেই বা না কেন? আনন্দের আগে ২৭ বছর দাবাবিশ্ব শাসন করা ইমানুয়েল লাসকার এমনই বিশ্রী ভাবে খেতাব হারিয়েছিলেন (০-৪) হোসে রাউল কাপাব্লাঙ্কার কাছে। পরাজিত লাসকারের বয়স তখন ৫৭। নূতন যৌবনের দূত কাপাব্লাঙ্কাকে তিনি হয়তো মানতে পারেননি। আনন্দের বয়স এখন ৪৩। ২২ নভেম্বরের পর থেকে নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন যিনি, সেই ম্যাগনাস কার্লসেনের বয়স ২২। দিন সাতেক পরে তাঁর বার্থডে কেক কাটা হবে।
এবং এমনটা একেবারেই নয় যে, নরওয়ের এই দাবাড়ু কাম অভিনেতা কাম ফুটবলার কাম মডেল কাম ইত্যাদি ইত্যাদি এই বাইশতম বসন্তে এসে হঠাৎ কোনও কলম্বাস দ্বারা আবিষ্কৃত হলেন! পরিস্থিতিটা অন্য রকম হতে শুরু করেছিল অনেক আগে থেকেই। আনন্দ নামক অলঙ্কারের মরচে ধরা শুরু ২০০৮-এর অক্টোবরে। সে মাসেই তাঁর ২৮০০-র ম্যাজিক ফিগার নড়ে গেল। ক্রমশ দেখা গেল, বিশ্ব খেতাবটা থেকে গেলেও আনন্দ এই গ্রহের প্রথম তিনের বাইরে।
তত দিনে ভাবী রাজার পদযাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে, সিংহাসনের দিকে। রাজ্যাভিষেকের জন্য তিনি হাঁটছিলেন না দৌড়চ্ছিলেন। তিনি কার্লসেন, ১৩ বছর ১৪৮ দিনের মাথায় গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছেন, ১৯ বছর ৩২ দিনে বিশ্বের এক নম্বর। অচিরে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক ২৮৭২ এলো রেটিংয়ের খেলোয়াড়। আর যাঁকে পিছনে ফেলে এই রেটিং সেই কাসপারভ বলছেন, এ ছেলে ফিশার আর করপোভের মিশেল। কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে তাঁর মিডল ও এন্ডগেমে দেখছেন মোৎসার্টের সুরমূর্ছনা।
অথচ এটাও নিশ্চিত মনে হবে যে, শেষ পর্যন্ত মোৎসার্ট তিনি নন। তিনি দুনিয়া কাঁপানো ‘ওয়ান ডিরেকশন’ ব্যান্ডের আধপাগলা গায়কদের কেউ। এই বুঝি গাইবেন ‘হোয়াট মেকস ইউ বিউটিফুল’ বা ‘কিস ইউ’! অবিকল হ্যারি স্টাইলসের মতো। তিনি গোমড়াথেরিয়াম কোনও দাবাড়ু হলে কেন কসমোপলিটন ম্যাগাজিন তাঁকে সেক্সিয়েস্টদের এক জন বাছবে? কেন টাইম ম্যাগাজিনের বিচারে বিশ্বের একশো প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের এক জন হবেন?
আরও অনেক কিছুই যে বলার মতো আছে। অসলোয় এক ফুটবল ক্লাবে তিনি লেফটব্যাকে খেলেন। নিয়মিত মডেলিং করেন। হলিউডের পরিচালক জেজে অ্যাব্রামস ‘স্টার ট্রেক ইনটু ডার্কনেস’-এ তাঁকে দিয়ে অভিনয় করাতে চেয়েছিলেন এবং রাজিও ছিলেন কার্লসেন। মার্কিন মুলুক ওয়ার্ক পারমিট দেয়নি বলে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। সুতরাং ম্যাগনাস কার্লসেন আর যেই হন বিশ্বনাথন আনন্দ বা আনাতোলি কারপোভের পংক্তির দাবাড়ু না। দাবার নতুন রাজা সব অর্থেই নতুন জমানার ব্র্যান্ড। দিব্যেন্দু বড়ুয়া তাই বলছেন, “শারাপোভা-বেকহ্যামদের মতো ক্যারিশমাওয়ালা কাউকে অনেক দিন ধরে খুঁজছিলাম দাবায়। কার্লসেনের মধ্যে আমি সেটা দেখতে পাচ্ছি।”
কার্লসেন নিজে নিজেকে বলেন, কুমির। যে কিনা আপাত দৃষ্টিতে বড় আলসে, ঘাপটি মেরে থাকে। আকস্মিক ভাবে চৌষট্টি খোপে আছড়ে পড়ে কুমিরের লেজ। ধরা পড়ার পর শিকার তার কাছে খাবি খায়। বিপক্ষ বোঝেই না, কী ভাবে তৈরি হবে। ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য আনন্দকে চিবিয়ে ফেলল সেই কিম্ভূত সরীসৃপটাই! দ্রোণাবলী হরিকা, মেরি অ্যান গোমসের মতো কেউ কেউ যা দেখে শিহরিত। এন্ডগেমে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য এক জন যে এ ভাবে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে পারেন তা ভাবতেই পারছেন না। আনন্দ নিজেও বলছেন, “ভেবেছিলাম লম্বা গেমগুলোতে ওকে ভয় না পেয়ে ওর সঙ্গে পাল্লা দেব। কিন্তু কার্লসেন এতটাই ভাল খেলল যে, সেটা হল না। বরং পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হয়ে গেল।” সূর্যশেখর গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য এখনও বাজি ধরছেন, পদস্খলিত সম্রাট আবার সিংহাসন ফিরে পাবেন!
কিন্তু আপাতত দাবার ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার’ গুঁড়িয়ে গিয়েছে। রুশ সাম্রাজ্যের পতনের পর এক তামিলের মৌরসি পাট্টাও কার্লসেন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। হয়তো সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের পথেই একাকী হাঁটা শুরু করলেন বিশ্বনাথন আনন্দও।
এত তাড়াতাড়ি দ্বিতীয় ধাক্কার ঢেউ সামলাতে হবে, কে জানত! |