কার্লসেন এফেক্ট— দাবা দুনিয়ায় সম্ভ্রম জাগানো শব্দ। আমরা যারা শুতে-বসতে দাবা বোর্ডের চৌষট্টি খোপের সংসারে রয়েছি, তারা জানি এই ‘এফেক্ট’ কতটা ভয়াল আর শক্তিশালী।
এ দেশের দাবাপ্রেমী সাধারণ মানুষও এ বার ‘কার্লসেন এফেক্ট’কে চেন্নাইয়ের বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে বুঝতে শুরু করলেন নিশ্চয়ই।
কী বিশেষত্ব এই ‘এফেক্টে’র? জঙ্গলে চিতা বা সিংহ যেমন তার শিকারকে ধীরে ধীরে কোণঠাসা করে, শেষ দিকে মানসিক ভাবে একদম অসহায় করে তোলে, আনন্দের প্রতিপক্ষ কার্লসেনও সে ভাবেই প্রতিপক্ষকে নিজের কব্জায় নিয়ে নেয়। আর বিপক্ষ সেই ফাঁদে দশবারের মধ্যে ন’বার পা দিয়ে বসে। শিক্ষানবিশের মতো ভুল করতে থাকে। বিপক্ষের জেতা ম্যাচও সে ভাবে অনেক সময় ঢুকে পড়ে নরওয়ের বছ তেইশের এই বিস্ময় দাবাড়ুর পকেটে। এটাই দাবা দুনিয়ার চোখে ‘কার্লসেন এফেক্ট’।
আরও ভাল করে বুঝতে গেলে নবম গেমে আনন্দের এ বারের চ্যাম্পিয়নশিপে তৃতীয় হারটা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। জানতাম শেষ চার গেমে দু’টো হারের ধাক্কা সামলাতে আনন্দ নবম গেমে একটা মরণকামড় দেবেই। এ দিন শুরু থেকেই সাদা ঘুঁটি নিয়ে আনন্দ সে ধরনেরই চাল দিতে শুরু করেছিল। কার্লসন তখন কোণঠাসা। আর ‘ডু অর ডাই’ পরিস্থিতিতে আনন্দ তুমুল আক্রমণাত্মক। টিভিতে গেমটা দেখতে দেখতে তখন ভাবছি— ভিশি, তুমি আরও আগে জাগলে না কেন? যাক, এখনও দাবার বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। |
বিপন্ন বিশ্বজয়ী। খেতাব হারানোর আশঙ্কা বিশ্বনাথন আনন্দের। বৃহস্পতিবার নবম রাউন্ডের
শেষে
ম্যাগনাস কার্লসেনের পয়েন্ট ৬, আনন্দের ৩। বাকি তিন গেমের মধ্যে একটা ড্র হলেই
বিশ্বজয়ীর
শিরোপা খোয়াবেন আনন্দ। আজ, শুক্রবার তিনি খেলবেন কালো ঘুঁটি নিয়ে। |
সবাই যখন আশায় বুক বাঁধছি, তখন কিন্তু এটাও লক্ষ করছিলাম আনন্দের জবরদস্ত সব চাল অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে সামলাচ্ছে কার্লসেন। আর মাঝেমাঝে ওর মডেলসুলভ মুখ তুলে জরিপ করে নিচ্ছে আনন্দকে। এবং ছাব্বিশ নম্বর চালে আনন্দের পা পড়ে গেল ‘কার্লসেন এফেক্টে’র গর্তে। ঘোড়ার বদলে মন্ত্রী দিয়ে চাল দিল। কার্লসেন তখনও স্থির দৃষ্টিতে মাপছে আনন্দকে। দু’টো চাল পরেই ফের ভুল করে বসল আনন্দ। বিশ্ব খেতাবটাও কার্যত তুলে দিল কার্লসেনের হাতে। ৩-৬ পয়েন্টে পিছিয়ে পড়েছে আনন্দ।
অলৌকিক কিছু না ঘটলে দাবার নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পেতে চলেছি আমরা। সাড়ে ছয়ের ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছতে বাকি তিন গেম থেকে স্রেফ আধ পয়েন্ট দরকার কার্লসেনের। একটা ড্র করলেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব বগলদাবা করে নিয়ে যাবে অসলোতে। শুক্রবার দশম গেমে ও খেলবে সাদা ঘুঁটি নিয়ে। ফলে ড্র করতে বিশেষ অসুবিধা না হওয়ারই কথা।
জানি, মানুষ মাত্রই আশা নিয়ে বাঁচেন। আর বৃথা আশা তো মরতে মরতেও মরে না! এ দিন সন্ধেতেও দেখলাম অনেকে বলছে, নবম গেমে হারলেও আনন্দ গোড়ার দিকে যে রকম স্বমহিমায় খেলেছে তাতে পরের তিন গেমের তিনটেতেই জিতে লড়াই টাইব্রেকারে নিয়ে গেলেও যেতে পারে। তা যদি হয় তা হলে আমার চেয়ে আনন্দিত আর কেউ হবে না। কিন্তু সেটা হলে তাকে অলৌকিকই বলতে হবে। কেউ কেউ কার্লসেনের একদা কোচ কাসপারভের প্রসঙ্গ টেনেছেন। বলতে চেয়েছেন, কাসপারভও এক বার তিন পয়েন্ট পিছিয়ে থেকে কামাল করেছিলেন পরপর তিন গেম জিতে। কিন্তু ভুলে যাবেন না, সেটা ছিল চব্বিশ গেমের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। আর এটা বারো গেমের। এবং সেখানেও বাকি আর তিনটে গেমই!
|
আনন্দের আর একটা খারাপ দিন। বৃহস্পতিবার চেন্নাইয়ে। |
সবাই জানতে আগ্রহী আনন্দের হলটা কী? পাঁচ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। কিন্তু কার্লসেনের সামনে শুরুর দিন থেকেই এমন কুঁকড়ে থাকছে কেন? আমি বলব এর পিছনে বয়স একটা ফ্যাক্টর অবশ্যই। আনন্দ যেখানে চুয়াল্লিশ, কার্লসেন সেখানে সবে তেইশের দরজায় কড়া নাড়ছে। প্রায় অর্ধেক বয়স। ফলে ক্ষিপ্রতা, ফিটনেস আগ্রাসনে প্রথম গেম থেকেই টেক্কা দিয়ে গিয়েছে আনন্দকে।
দ্বিতীয়ত, পাঁচ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আনন্দের ফিডে রেটিং যেখানে ২৭৭৫, সেখানে চ্যালেঞ্জার কার্লসেন ২৮৭০। চ্যাম্পিয়ন লড়তে গিয়ে যদি দেখে যে, নতুন প্রতিপক্ষ তার থেকে রেটিংয়ে অনেকটা এগিয়ে, তখন তার ভেতর একটা অদ্ভুত মানসিক চাপ তৈরি হয়। হাজার হোক, দাবা খেলাটাই হল মাইন্ড গেম। আনন্দও সেই মানসিক চাপ পুরোপুরি কাটিয়ে বেরোতে পারল না। নবম গেমে যখন খানিকটা বেরোল, তখন আবার ‘কার্লসেন এফেক্ট’ পড়ল ওর উপর। জেতা গেমও তুলে দিল প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে। পাশাপাশি বাবা হওয়ার পর ইদানীং স্বভাবতই পরিবারকে বেশি সময় দিতে হচ্ছে আনন্দকে। সেটাও হয়তো ওর মনঃসংযোগে কিছুটা হলেও চিড় ধরিয়েছে।
মোদ্দা কথা হল, আনন্দ অতীতে বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে যেমন টোপালভ, ক্র্যামনিক, গেলফাঁকে শুরুতেই পড়ে ফেলতে পেরেছিল, এ বার সেটা করে উঠতে পারেনি। কার্লসেন ছেলেটা কাসপারভের কথায়, ফিশার আর করপোভের ককটেল। তার চেয়েও বড় কথা, কার্লসেন কোনও ওপেনিংয়ের ধার ধারে না। সহজাত প্রতিভা। চালে ভ্যারিয়েশন প্রচুর। অনেকটা ক্রিকেটের সহবাগ বা শিখর ধবনের মতো। এ ছেলে যে আগামী দিনে কোথায় গিয়ে থামবে তা ভেবে তল পাচ্ছি না! |
“একটা যুগের অবসান ঘটল”
নাইজেল শর্ট |
“খেলার যা অবস্থা ছিল তাতে আমার একটা মরিয়া চেষ্টা করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা ছিল না। বার দু’য়েক এমন পরিস্থিতি হয়েছিল, যেখান থেকে ম্যাচটা ড্র হতে পারত। কিন্তু আমি একটা ঝুঁকি নিয়েছিলাম। এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। চল্লিশ মিনিট ধরে আমি ওই চালটা নিয়ে ভেবেছিলাম। কিন্তু চালটা দেওয়ার পরই বুঝতে পারলাম, ভুল করে ফেলেছি। জানি শেষ তিনটে গেমে আমার সামনে চ্যালেঞ্জটা খুব কঠিন। কিন্তু পরিস্থিতি খুব একটা ভাল দেখাচ্ছে না।”
বিশ্বনাথন আনন্দ |
“এই গেমটায় আমি সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে ছিলাম। আনন্দের অবস্থাটা খুব ভাল ছিল। একটা সময় তো মনে হচ্ছিল, আমার বেরিয়ে আসা খুব কঠিন হবে। আমার ভাগ্যটা ভাল যে আনন্দ ভুলটা করল।”
ম্যাগনাস কার্লসেন |
|