কর্মীর অভাবে পুর-পরিষেবা দিতে না পারায় তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকারের দিকে আঙুল তুলছেন পুরপ্রধানেরা। বিশেষ করে আজ, শুক্রবার যে সব পুরসভায় ভোট তাদের মধ্যে কৃষ্ণনগরে তৃণমূলের, বহরমপুরে কংগ্রেসের বা ঝাড়গ্রামে সিপিএমের পুরপ্রধান।
রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম অবশ্য বলেন, ‘‘আমরা পুরসভায় উন্নত পরিষেবা দিতে দায়বদ্ধ। কিন্তু প্রয়োজনীয় টাকা নেই। তাই স্থায়ী কর্মী নিয়োগে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।”
পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের এক শীর্ষ-কর্তার মন্তব্য, “কম-বেশি কর্মীর অভাব রয়েছে রাজ্যের ১২৭টি পুরসভাতেই। পুরসভাগুলির চাহিদা মেনে স্থায়ী কর্মী দেওয়াও হয়। তবে স্থায়ী পুরকর্মীদের বেতনের ৮৫ শতাংশ রাজ্য এবং ১৫ শতাংশ পুরসভা বহন করে। তাই চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে স্থায়ী কর্মী পেয়ে যাবে পুরসভাগুলি, এমন ভাবার কারণ নেই।” পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর সূত্রের খবর, কর্মীর অভাবে পরিষেবা দিতে না পারার সমস্যা ছাড়াও, দেরি হচ্ছে কেন্দ্রীয় প্রকল্প রূপায়ণে। এমনকী, কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ফেরত চলে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। তবে এ সমস্যা নতুন নয়। বিভিন্ন পুরসভার প্রধানেরা জানাচ্ছেন, বাম-আমলে যে সব অস্থায়ী কর্মীরা ১০ বছরের বেশি পুরসভায় কাজ করেছেন, তাঁদের স্থায়ী করার চেষ্টা হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আপত্তিতে সে পদ্ধতি কাজে দেয়নি। এই অবস্থায় বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কাজে অস্থায়ী ভাবে কিছু লোককে নেওয়া হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও তাঁদের অনেককে পুরসভার কাজে ব্যবহারের রীতি চালু হয়।
প্রতিটি পুরসভার কাজ ও কর্মীর অনুপাত খতিয়ে দেখতে ২০০৭-এর ফেব্রুয়ারিতে একটি কমিটি তৈরি করে বামফ্রন্ট সরকার। কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় কলকাতার তত্কালীন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যকে। কমিটি ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারিতে পুরসভাগুলিতে শূন্যপদ পূরণ এবং কর্মী পদ বাড়ানোর সুপারিশ করে রিপোর্ট জমা দেয়। রিপোর্টে প্রায় ১৫ হাজার কর্মী নিয়োগের সুপারিশ ছিল। কিন্তু সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি।
তৃণমূল পরিচালিত কৃষ্ণনগর পুরসভায় ৫১৯টি স্থায়ী পদের মধ্যে বর্তমানে ৪১০টিতে কর্মী আছেন। ফাঁকা পদের মধ্যে সাফাই কর্মী ও জঞ্জালের গাড়ির চালকের পদের সংখ্যাই অর্ধেকের বেশি। বিদায়ী পুরপ্রধান তথা তৃণমূল নেতা অসীম সাহার কথায়, “স্থায়ী পদে বিরাট সংখ্যক প্রার্থী না থাকায় মানুষকে সর্বোচ্চ মানের পরিষেবা দিতে পারিনি। শহর ও নর্দমা সাফাইয়ের বিষয়টি এ বারের পুর-ভোটের প্রচারে হাতিয়ার করছেন বিরোধীরা। কিন্তু সরকার থেকে এক জনও কর্মী না মেলায় চুক্তিতে নিয়োগ করে বিভিন্ন প্রকল্প চালানো হচ্ছে। তাদের বেতন বাবদ মাসে ১২ লক্ষ টাকা খরচ হচ্ছে। টাকাটা রাজ্য দিলে আমরা শহরের উন্নয়নের কাজ করতে পারতাম!”
বহরমপুর পুরসভায় ৯২৮ জনের মধ্যে ৫৫৬ জন কর্মী রয়েছেন। বিদায়ী পুরপ্রধান কংগ্রেসের নীলরতন আঢ্যর ক্ষোভ, “শূন্য পদ পূরণে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই।” ঝাড়গ্রাম পুরসভায় ১১০ জন স্থায়ী কর্মীর মধ্যে রয়েছেন ৬৪ জন। সাফাই কর্মীর ৩৯টি পদের মধ্যে ৩২টি পদই খালি। বিদায়ী পুরপ্রধান সিপিএমের প্রদীপ সরকার বলেন, “পর্যাপ্ত স্থায়ী কর্মী না থাকায় পরিষেবা দেওয়ায় বিঘ্ন ঘটছে।”
কর্মী-সঙ্কট মোকাবিলায় ঠিকা-কর্মী নিয়োগ পুরসভার পক্ষে ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। ওই ঠিকাকর্মীদের বেতন দিতে হয় পরিকল্পনা বহির্ভূত খাত থেকে। এখানেই আসছে পুরসভার বিকল্প আয়ের প্রশ্ন। কল্যাণী পুরসভার প্রাক্তন প্রধান তথা বর্তমান বিরোধী দলনেতা সিপিএমের শান্তনু ঝা জানান, বাম আমলে কর্মী-সমস্যা মেটাতে প্রতি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের হাতে ওয়ার্ড অফিসে চার জন করে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগের ক্ষমতা দিয়েছিল পুরসভা। পুরসভার সামগ্রিক কাজের নিরিখে চাহিদা অনুযায়ী ওই অস্থায়ী কর্মীদের কাজে লাগানো হত। তাঁদের বেতন দিতে পুরসভার তহবিল থেকে যে খরচ হত, তা মেটাতে বহুমুখী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। জলকর বসানো, জঞ্জাল সরানোর জন্য টাকা নেওয়া, জঞ্জাল থেকে সার তৈরি করে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে বিক্রির মতো নানা উপায়ে বাজেট-ঘাটতি মেটানো হত। শান্তনুবাবুর বক্তব্য, “পুরসভার জন্য বিকল্প আয়ের রাস্তা ভাবতে হবে। না হলে অস্থায়ী-কর্মীদের খরচ চালানো দুষ্কর।”
তবে বিকল্প মতও রয়েছে। কলকাতার উপকন্ঠের একটি পুরসভার দীর্ঘ দিনের তৃণমূল প্রধান বলছেন, “নাগরিকেরা যে সম্পত্তি কর দেন, তার মধ্যেই জল সরবরাহ, জঞ্জাল সাফাইয়ের খরচ ধরে নেওয়ার কথা। অতিরিক্ত কর বসবে কোন যুক্তিতে?”
তাঁর সংযোজন, “জনসংখ্যা, কাজের ধরন এবং পরিকাঠামোর উপরে এক-একটি পুরসভায় কত কর্মী প্রয়োজন তা ঠিক হয়। কোথাও যে ভাবে বিকল্প আয় দিয়ে ঠিকাকর্মীদের খরচ চালানো সম্ভব, অন্যত্র তা না-ও হতে পারে।”
প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের মন্তব্য, “কর্মীর অভাবের সমস্যা মেটাতে পুরসভা পরিচালনায় অভিজ্ঞদের নিয়ে আলোচনা করুক রাজ্য সরকার। পুরপ্রধান বা বিরোধী দলনেতা তাঁদের মধ্যে সব দলের লোকই থাকতে পারেন। আলোচনা করে সমস্যা মেটানোর নীতি ঠিক করতে হবে।” |