প্রবন্ধ ...
বড় পণ্ডিত এবং দক্ষ প্রশাসক
মার জীবনে যে বিশিষ্ট মানুষদের সংস্পর্শে এসেছি, অধ্যাপক চিন্তামণি নাগেশ রামচন্দ্র রাও তাঁদের প্রথম সারিতে। এই বিজ্ঞানী সি এন আর রাও নামেই সুপরিচিত, আর বন্ধুবান্ধবদের কাছে তিনি স্রেফ সি এন আর। সি এন আর কত বড় বিজ্ঞানী, সে তো আর নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবেও তিনি আমাকে বরাবর আশ্চর্য করে দিয়েছেন। এমন সহৃদয় এবং খোলা মনের মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। স্বীকৃতি, খ্যাতি, সম্মান, এ-সবের ফলে তাঁর স্বভাবে একটুও টোল পড়েনি, মানুষটা চিরকাল যেমন দিলদরিয়া ছিলেন তেমনই আছেন। এ ব্যাপারে আর এক জন ভারতরত্ন এবং নোবেলজয়ীর সঙ্গে তাঁর স্বভাবের তফাতটা দেখবার মতো, তাঁর নাম সি ভি রমন। সি এন আর স্বাভাবিক ভাবেই রমনের বিশেষ গুণগ্রাহী, কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে তিনি অনেক বেশি স্নেহময়, অনেক সহজে তাঁর কাছে যাওয়া যায়। সমস্ত সৃষ্টিশীল মানুষের মতোই মাঝে মাঝে তাঁর মুডের উত্থানপতন ঘটে, কিন্তু তাঁর অমায়িক স্বভাব দেখতে দেখতে সে সব কাটিয়ে ওঠে। সি এন আরের স্বভাবের সবচেয়ে চমৎকার ব্যাপার হল ওঁর নির্মল এবং প্রখর আগ্রহ। ওঁর চোখে বহু বার যে তীব্র কৌতূহলের আলো জ্বলতে দেখেছি, তা মানুষটির সজাগ, সতেজ মনকে চিনিয়ে দেয়।
অনেকেই জানেন না, সি এন আর বাঙালি সংস্কৃতির পরম অনুরাগী। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার পরম ভক্ত, বিশেষ করে প্রথম আলো এবং সেই সময় তাঁর অত্যন্ত প্রিয় উপন্যাস। কিছু দিন আগেই বেঙ্গালুরুতে আমাকে বলছিলেন, ‘আচ্ছা, শংকরের চৌরঙ্গী-র ইংরেজি অনুবাদ হতে এত বছর দেরি হল কেন?’ গীতাঞ্জলি-র বিশেষ ভক্ত, তার অনেক কবিতাই অনায়াসে আবৃত্তি করতে পারেন।
বেঙ্গালুরুতে স্কুলের পাট চুকিয়ে সি এন আর রাও পড়াশোনা করতে যান বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে। তাঁর জীবনে খুব বড় প্রভাব ছিল প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী, খড়্গপুর আই আই টি’র প্রাণপুরুষ এবং প্রথম অধিকর্তা জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের। সি এন আর বলেন, ওঁর প্রথম পেপারটিই ওঁর রসগোল্লা-প্রীতির কারণ। এত অল্প বয়সে এত ভাল পেপার লিখেছিলেন তিনি যে, স্যর জে সি ঘোষ সেটি পড়ে বলেছিলেন, তাঁর স্ত্রী ওঁকে রসগোল্লা খাওয়াবেন। সেই থেকে সি এন আর রসগোল্লার ভক্ত। বাঙালিরও। সি এন আর বলেন, তাঁর সবচেয়ে উজ্জ্বল ছাত্ররা সাধারণত বাংলার সন্তান। তাদের তিনি একসঙ্গে ডাকেন না। এক জন, বড় জোর দুজনকে নিয়ে বসেন। তার বেশি হলে সামলানো যায় না!
পঞ্চাশের দশকে উচ্চতর গবেষণার জন্য সি এন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। তার পর ধীরে ধীরে, কিন্তু নিঃসংশয় ভাবে তাঁর অসামান্য প্রতিভা দুনিয়ার কাছে উন্মোচিত হতে থাকে। একের পর এক অসাধারণ মৌলিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে থাকেন তিনি। ১৯৬৩ সালে সি এন আর কানপুর আই আই টি’তে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তখন সেখানে অনেক সমস্যা, পরিকাঠামো খুবই দুর্বল। কিন্তু তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির সামনে অনেক বাধা, অনেক সমস্যা তুচ্ছ হয়ে যায়। কানপুর আই আই টি’র গৌরবময় ইতিহাসে তাঁর অবদান অনেক। প্রসঙ্গত, ইন্দিরা গাঁধী সি এন আর রাওকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর পুত্র রাজীব গাঁধীর সঙ্গে সি এন আরের এক চমৎকার সৌহার্দ্য তৈরি হয়, সেই বন্ধুত্বে শ্রদ্ধার একটা বড় জায়গা ছিল।
একটা কথা আমাকে বলতেই হবে। বিজ্ঞানে ব্যুৎপত্তির পাশাপাশি বিজ্ঞান নীতি সম্পর্কে এমন স্বচ্ছ ধারণা এবং তার সঙ্গে প্রশাসনিক প্রজ্ঞা ও দক্ষতার এমন সমন্বয় আমি খুব কম মানুষের মধ্যে দেখেছি। সি এন আর এত দ্রুত প্রশাসনিক কাজ করতে পারেন, এত রকমের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করতে পারেন এবং এত কিছু করার পরেও বিজ্ঞানের সাম্প্রতিকতম গবেষণা সম্বন্ধে এতখানি নির্ভুল ধারণা সহকারে ওয়াকিবহাল থাকতে পারেন, সত্যিই অ-সামান্য!
সি এন আর রাওয়ের জওহরলাল নেহরু সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্টিফিক রিসার্চও এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। কাজের দিক থেকে তো বটেই, পরিবেশের দিক থেকেও। বেঙ্গালুরুর জাকুর-এ এই প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস। চার ধারে বিশাল সমস্ত গাছের সারি, ভিতরে সুন্দর বাগান, অপূর্ব সব ভাস্কর্য। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মনে এক আশ্চর্য শান্তি নেমে আসে, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে নিজের মধ্যে ডুব দেওয়া যায়। মানুষের শোরগোল প্রায় শোনাই যায় না, কানে আসে পাখির ডাক। খাবারদাবার ঘরোয়া, কিন্তু অত্যন্ত সুস্বাদু। নিজের কাজে, নিজের চিন্তায় মনোনিবেশের পক্ষে খুবই অনুকূল পরিবেশ। এই গোটা ক্যাম্পাসটা, তার সমস্ত খুঁটিনাটি ব্যাপার, সব কিছুর পরিকল্পনা সি এন আরের নিজের।
কয়েক বছর আগের কথা। আমি সে দিন কোনও একটা কাজের সূত্রে বক্রেশ্বরে। হঠাৎ সি এন আরের ফোন। জানালেন, এইমাত্র খবর পেয়েছেন যে তিনি ড্যান ডেভিড পুরস্কার পাচ্ছেন। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি এবং সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে এই পুরস্কারটির বিশেষ মর্যাদা আছে। যে বছর (২০০৫) সি এন আর এই পুরস্কার পান, সে বার অন্যতম প্রাপক ছিলেন প্রসিদ্ধ নাট্য-নির্দেশক, ‘মহাভারত’ ফিল্মের পরিচালক পিটার ব্রুক। খবরটা শুনে ভীষণ ভাল লেগেছিল। এ-যাবৎ আর কোনও ভারতবাসী সম্ভবত এই পুরস্কার পাননি।
অধ্যাপক সি এন আর রাও বহু আন্তর্জাতিক সম্মানে সম্মানিত। পৃথিবীর কত প্রতিষ্ঠান যে তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট দিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু আজও, আশি বছর বয়সেও তাঁর চিন্তা আর পরিশ্রমের বিরাম নেই, নিরন্তর প্রবল উৎসাহে তিনি কাজ করে চলেছেন। রোজ ভোর সাড়ে চারটেয় ঘুম থেকে ওঠেন। বেঙ্গালুরুতে থাকলে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স-এর সুবিস্তীর্ণ ক্যাম্পাসে অন্তত দু’পাক হাঁটেন। সকাল আটটার মধ্যে কাজে ডুব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। ভাল গানবাজনা, ভাল বই, ভাল খাবার এবং উজ্জ্বল, উৎকৃষ্ট চিন্তা এই হল তাঁর দৈনন্দিন খোরাক। যে বয়সে সচরাচর বেঁচে থাকাটাই একটা লড়াইয়ের ব্যাপার, সি এন আর তখন চল্লিশের তারুণ্যে ক্রমাগত এক মহাদেশ থেকে আর এক মহাদেশ চষে বেড়াচ্ছেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হিসেবে সি এন আর রাওকে দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে খুব কাছ থেকে দেখছি। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ইন্দু, দুজনের মধ্যেই দেখেছি এক সহজ এবং অদম্য প্রাণশক্তি। যারাই তাঁদের কাছে আসে, তারাই তাজা হাওয়ার মতো সেই প্রাণের স্পর্শে সতেজ হয়ে ওঠে।
আমার এই বন্ধুর চরিত্রের যে দিকটা আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করে, তা হল তাঁর নির্ভীক এবং গভীর প্রত্যয়, তাঁর অসামান্য ধীশক্তি এবং তাঁর সুতীব্র স্বদেশপ্রীতি। অধিকাংশ প্রতিভাধন মানুষের মতোই, তিনি খুব বড় মাপের ভারতীয়, কিন্তু তাঁর উপর সমগ্র বিশ্বের অধিকার। এই ধরনের মানুষ পৃথিবীতে কোনও দিনই সুলভ নয়। তাঁকে কাছ থেকে চেনার এবং জানার সুযোগ পেয়েছি, এ জন্য নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি। কয়েক মাস পরেই আমরা এই ভারতরত্নের আশিতম জন্মদিন (৩০ জুন) পালন করব।

ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার-এ হোমি ভাবা অধ্যাপক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.