গতির টানেই ৬ হাজার কিমি পাড়ি চার ‘যুবক-যুবতী’র
অ্যাকসিলেটরে আপনা আপনিই যেন পা-টা চেপে বসে যাচ্ছিল।
মসৃণ রাস্তা। মনে হচ্ছিল মাটি থেকে ৪০ হাজার ফুট উপরে হাওয়া কেটে উড়ে যাচ্ছে ইনোভা। যমুনা এক্সপ্রেসওয়ের মিশকালো পিচের সড়ক কামড়ে ছুটে যাচ্ছিলেন চার যুবক-যুবতী। স্টিয়ারিং-এ অতনু। ঠোঁটের কোণে ধরা সিগারেট। চোখে সানগ্লাস।
স্পিডোমিটারের কাঁটা ১৪০-এর ঘরে পৌঁছতেই পিছন থেকে সতর্ক করলেন মঞ্জুশ্রী। “কথা দিয়েছিলে, ১০০-র বেশি স্পিড তুলবে না” মনে করিয়ে দেন তিনি। কিন্তু, সে কথা মনে ছিল না অতনুর। গতি যেন নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল। পাশের সিট থেকে আড়চোখে বন্ধুর দিকে দেখলেন সঞ্জয়। দুই বন্ধুর চোখে চোখে হাসি খেলে গেল। স্ত্রী-র কথা শুনে অতনু হালকা করে দিলেন পায়ের চাপ। স্পিড নেমে এল ১২০-তে। পিছনের আসনে মঞ্জুশ্রীর পাশে বসা লক্ষ্মী, সঞ্জয়ের স্ত্রী। তাঁরাও দু’জন সানগ্লাসের ফাঁক দিয়ে নিজেদের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে নিলেন।
“কী করব? গতি আমাকে আনন্দ দেয়। পাশের গাছপালা, নদীনালা, বাড়িঘর কত দ্রুত উল্টোদিকে ছুটে চলে যায়। আমার ভাল লাগে” অকপট স্বীকারোক্তি অতনুর। আর সঞ্জয়ের কথায়, “ছোটবেলা থেকেই এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। মখমলের মতো রাস্তার উপরে ছুটবে চাকা। যত দিন বাঁচব, সেই স্বপ্ন বুকে নিয়েই বাঁচব।”
গত ১৪ দিনে ৬০০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছেন সঞ্জয়-অতনু, দুই বন্ধু। প্রথম দিন ভোরে কলকাতা থেকে রওনা হয়ে একটানা প্রায় সাড়ে সাতশো কিলোমিটার গাড়ি চালান দু’জন। অঙ্কটা বেশ কঠিন। তবে সেটা আরও কঠিন মনে হয় যদি জানা যায়, ওই অতটা দূরত্ব লাগাতার ড্রাইভ করে অবলীলায় অতিক্রম করেছেন একষট্টি থেকে তেষট্টি বছর বয়সের চার যুবক-যুবতী। যুবকই, কারণ বয়সে না হলেও মনে-প্রাণে এখনও ততটাই তরতাজা তাঁরা।
ওঁরা চার জন। —নিজস্ব চিত্র।
অতনু চট্টোপাধ্যায় (৬১) ও মঞ্জুশ্রী (৬১) থাকেন সল্টলেকে। সঞ্জয় ঘোষ (৬৩) এবং লক্ষ্মী (৬৩) থাকেন বাইপাসের পাশে। ৬ নভেম্বর সল্টলেক থেকে বেরিয়ে সে দিনেই টানা ১৩ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ৭৭৫ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পৌঁছে যান অন্ধ্রপ্রদেশে। এর পরে ১২ রাজ্যের ৬ হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে, পুরো ‘গোল্ডেন কোয়াড্রিল্যাটারাল’ বা সোনালি চতুর্ভুজ ঘুরে বৃহস্পতিবারেই কলকাতায় ফিরেছেন তাঁরা। সামনে যখন দু’জন পালা করে গাড়ি চালিয়েছেন, তখন পিছন থেকে প্রয়োজন মতো গুগ্ল ম্যাপ নয়তো বিস্কুট, চকোলেট, কাপের মধ্যে গরম জলে সেদ্ধ করা ম্যাগি সরবরাহ করে গিয়েছেন মঞ্জুশ্রী ও লক্ষ্মী।
মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম বলছেন, “৬০ পেরোলেই আমাদের সমাজ মনে করিয়ে দেয় যে তোমার বাণপ্রস্থে যাওয়ার সময় এসেছে। ফলে, যা কিছু যৌবনে মানানসই, তা এই বয়সে করাটা প্রায় অপরাধেরই সামিল। এই মানসিকতা যে আমাদেরই দীনতা, তা তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন অতনু-সঞ্জয়।” তাঁর মতে, অনেকেই এমন আছেন, যিনি মনের মধ্যে এ রকম স্বপ্নের বীজ বোনেন। কিন্তু, লোকচক্ষুর ভয়ে করতে পারেন না। ‘বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে’ এই বাক্যবাণকে অনেকেই ভয় করেন।
অতনু-সঞ্জয়রা অবশ্য সেই দলে পড়েন না। অতনু-মঞ্জুশ্রী এখনও নিয়মিত জিম করেন। অতনুর ধূমপানের অভ্যাসও বজায় আছে। তবে ব্লাড-প্রেশার, ব্লাড-সুগার, কোলেস্টেরল, ইউরিয়া কেউই ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেনি। সঞ্জয়কে হাল্কা প্রেশারের ওষুধ খেতে হয়। তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী এখনও নিয়মিত সাঁতার কাটেন।
রাস্তাঘাটে পঞ্চাশোর্ধ আর দশটা লোককে “কেমন আছেন,” জিজ্ঞাসা করলে যখন বিষণ্ণ মুখের উত্তর আসে, “ওই, এক রকম চলছে” অথবা, “বেঁচে আছি,” তখন অতনু ও সঞ্জয় ১৪ দিনে ৬ হাজার কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে, ১২টি রাজ্য ছিন্ন-ভিন্ন করে ফিরে এসে বলেন, “সামনের বছরের ট্যুরটা এ বার প্ল্যান করে ফেলতে হবে।”
জেরন্টোলজিস্ট ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর কথায়, “এটা জীবনীশক্তির উপরে নির্ভর করে। অনেকেই আছেন, যাঁরা আগেই বুড়িয়ে যান। অনেকে আবার বেশি বয়সেও চাঙ্গা থাকেন। ৬০ বছরে পৌঁছলেই কেন মনে হবে আর মাত্র কয়েক দিন বাঁচব? নিয়মিত শরীরচর্চা, মানসিক প্রশান্তি প্রাণবন্ত থাকতে সাহায্য করে।” উদাহরণ দিয়ে ইন্দ্রাণীদেবী জানাচ্ছেন, বিদেশে এ রকম প্রবীণেরা সরাসরি রাস্তায় নেমে সমাজকে সাহায্যও করেন।
এখনও ৭৫ বছর বয়সে সপ্তাহে দু’দিন করে টেনিস খেলেন চুনী গোস্বামী। তাঁর কথায়, “মানসিক জোরের সঙ্গে মনের মধ্যে অ্যাডভেঞ্চারের মানসিকতা থাকলে বয়স ধরে রাখা সম্ভব। সব সময়ে পজিটিভ ভাবতে হবে।” একটু বয়স বাড়ার সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসে সংযম রাখার দিকেও জোর দিয়েছেন তিনি।
নিয়মিত শরীরচর্চা, পরিমিত খাদ্যাভ্যাস বজায় রেখে এই ভাবেই বাকি জীবনটা বাঁচতে চান অতনু-সঞ্জয়রা। এই বেঁচে থাকার মধ্যে আছে কাজ। বই পড়া, গান শোনা। আর নির্ভেজাল আড্ডা। আর মাঝে-মধ্যে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়া। ৪০ বছরের অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব।
এক জন ঘোরতর ঈশ্বর-বিশ্বাসী, অন্য জন নাস্তিক। কিন্তু, দু’জনের জীবনের মন্ত্র এক “যতদিন বাঁচব, প্রাণ খুলে বাঁচব।”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.