কয়লা-ঘুঁটে গুঁজে জ্বালানো উনুন। ঝুলকালি মাখা দেওয়ালে ঝুড়ি-কুলো। একটা সময় বাঙালি বাড়ির রান্নাঘর ছিল এমনই। ক্রমে ছবিটা পাল্টেছে। উনুনের জায়গা নিয়েছে গ্যাস। ঝুলকালির হাত থেকে বাঁচাতে এসেছে চিমনি। মধ্যবিত্ত বাঙালি গিন্নিরও মনে হয়, টোস্টার, স্যান্ডউচ মেকার, ইন্ডাকশন ওভেন, মিক্সার গ্রাইন্ডার, মাইক্রোওভেন ছাড়া রান্নাঘর ঠিক জমে ওঠে না। আর ছিমছাম ‘মডিউলার কিচেন’ তো স্বপ্ন।
তেমন সুদৃশ্য রান্নাঘর তৈরির খরচ এক-দেড় লক্ষ টাকার কম নয়। সাধারণ গেরস্ত ঘরে কোথায় মিলবে অত টাকা? মেয়েদের সাধের রান্নাঘর গড়তে সহজ ঋণই বা দিচ্ছে কে? এ বার এগিয়ে এল সদ্য-প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় মহিলা ব্যাঙ্ক। এ দেশের মেয়েদের জন্য তাদের উপহার রান্নাঘর সাজানোর ঋণ। ব্যাঙ্কিং পরিভাষায় ‘কিচেন লোন’।
পশ্চিমবঙ্গে মহিলা ব্যাঙ্কের একমাত্র শাখাটি খুলেছে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে। শাখা ম্যানেজার সুজাতা বড়ুয়া জানালেন, কর্মরতা হোন বা গৃহিণী, যে কোনও মহিলাই এই ঋণ পেতে পারেন। বয়স হতে হবে ২১ বছরের বেশি। রোজগেরে গিন্নিদের বার্ষিক আয় ন্যূনতম আড়াই লক্ষ টাকা হতে হবে। কর্মরতা নন এমন মহিলা স্বামী বা অন্য কোনও পরিজনের সঙ্গে যুগ্ম ভাবেও ঋণের আবেদন করতে পারেন। সুদের হারও তুলনায় কম, ১২.৭৫ শতাংশ। শুধুমাত্র রান্নাঘর সাজানোর জন্য বিশেষ ঋণের বন্দোবস্ত অন্য ব্যাঙ্কে সে ভাবে নেই। এ ক্ষেত্রে ‘পার্সোনাল লোন’ দেওয়ার রীতিই চালু রয়েছে। তবে সে ক্ষেত্রে সুদের হার চড়া, ১৪-১৭ শতাংশ। |
কী কী করা যাবে ঋণের টাকা দিয়ে? রান্নাঘরের মেঝে, দেওয়াল ঝাঁ চকচকে করা থেকে কিচেন ক্যাবিনেট বানানো, বিদ্যুতের লাইনের কাজ, গ্যাস ওভেন, মাইক্রোওয়েভ কেনা সবের জন্যই মিলতে পারে ঋণ। এমনকী রান্নাঘর সৌরবিদ্যুৎ চালিত করতে চাইলেও ঋণ মিলবে। ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৭ লক্ষ টাকা। তার মধ্যে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ মিলবে বাসনপত্র কেনার জন্য। সুজাতাদেবীর কথায়, “আমরা চাই আজকের দিনের আধুনিক মহিলাদের স্বাস্থ্যকর, ঝকঝকে রান্নাঘর উপহার দিতে।” এই ঋণ-প্রকল্পের স্লোগানও তাই, ‘দক্ষ রসুই, দক্ষ মহিলা’ (‘এফিশিয়েন্ট কিচেন, এফিশিয়েন্ট মহিলা’)।
মহিলা ব্যাঙ্কের কলকাতা শাখার উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের সিএমডি শুভলক্ষ্মী পানসে। তিনি মনে করেন, ‘ব্যাঙ্কিং প্রোডাক্ট’ হিসেবে ‘কিচেন লোন’ জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শুভলক্ষ্মীদেবীর কথায়, “প্রত্যেক মহিলাই চান তাঁর রান্নাঘর ঝাঁ চকচকে হোক। তা তিনি যত কম সময়ই রান্নাঘরে কাটান না কেন। তবে সেটা নির্ভর করছে ঋণ নিয়ে তা ফেরত দেওয়ার প্রবণতার উপরে।”
সরকারও যে মেয়েদের রান্নাঘরের হাল ফেরানোর কথা ভাবছে এবং ব্যাঙ্কের মাধ্যমে পদক্ষেপ করছে, সে কথা জেনে রীতিমতো উৎসাহী শোনাল প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্যের গলা। তাঁর কথায়, “এই উদ্যোগকে স্বাগত। মেয়েরা যতই বাইরে কাজ করুক, হেঁসেল তাদেরই সামলাতে হয়। ফলে, রান্নাঘরে যত আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকবে, তত মেয়েদের পরিশ্রম কম হবে, সময় বাঁচবে। মেয়েদের স্বাস্থ্যের জন্য আধুনিক রান্নাঘর ভীষণ জরুরি।”
একই মত ইন্টেরিয়র ডেকরেটর চিত্রলেখা ঘোষের। তিনি বলেন, “মেয়েরা দিনের বেশ খানিকটা সময় এখনও রান্নাঘরে কাটায়। তাই সেখানকার পরিবেশটা স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া প্রয়োজন। সাধারণ মধ্যবিত্তও নানা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি কেনে। সাধ্যমতো মডিউলার কিচেনও বানাচ্ছেন অনেকে। ঋণ পেলে সুবিধাই হবে।” তাঁর মতে, মহিলা ব্যাঙ্কের এই উদ্যোগ রীতিমতো সাড়া ফেলবে।
এই অনুমান যে ভুল নয় তা প্রমাণ হল মহিলা ব্যাঙ্কের পার্ক স্ট্রিট শাখার ম্যানেজারের কথায়। সুজাতাদেবী বলেন, “মাত্র দু’দিন হল আমরা ব্যাঙ্ক খুলেছি। এর মধ্যেই অনেকে এসে ‘কিচেন লোন’ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। দরখাস্তও জমা পড়ছে।”
(আগ্রহীরা যোগাযোগ করতে পারেন, অনুপম বিশ্বাস: ৯০৮৮১০৬৪৪৯) |