চক্ষুদানের অঙ্গীকার করেছেন বছর দুয়েক আগে। এবার ইচ্ছে, মরণোত্তর দেহ দানের। কিন্তু ‘পরিকাঠামোর অভাব’ দেখিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ দু’বার ফিরিয়ে দিয়েছে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধকে। রঘুনাথগঞ্জের চাঁদপাড়া গ্রামের জামালউদ্দিনের আশঙ্কা, তাঁর শেষ ইচ্ছেটা হয়তো অপূর্ণই থেকে যাবে।
|
জামালউদ্দিন |
জামালউদ্দিন বলেন, “মরলেই তো মাটি চাপা দিয়ে দেবে। তার থেকে এ দেহ কাজে লাগিয়ে ছেলেমেয়েরা যদি লেখাপড়া করে মন্দ কী?” পেশায় রাজমিস্ত্রী জামালউদ্দিন এখন আর কাজ করতে পারেন না। অভাবের সংসারে গাঁটের পয়সা খরচ করে বাড়ি থেকে প্রায় ১১০ কিমি উজিয়ে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজেও গিয়েছেন দু’বার। ফোন করেছেন বহুবার। তাঁর আক্ষেপ, “এত কিছু করেও তো হাসপাতাল থেকে বিশেষ কোনও সাড়া পাচ্ছি না।”
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ তথা সুপার মণিময় গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “মেডিক্যাল কলেজটির বয়স সবে তিন বছর। মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য এখনও পর্যন্ত কোনও পরিকাঠামো আমাদের নেই। কেউ মরণোত্তর দেহদান করতে চাইলে সে দেহ তো শুধু নিলেই হবে না। দেহ ঠিকমতো সংরক্ষণও করে রাখতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু যন্ত্রপাতিও দরকার। আশা করা যায় জানুয়ারি মাস নাগাদ এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারব। ফলে দেহদানে ইচ্ছুক এমন কারও সঙ্গেই এখনই লিখিত ভাবে কোনো চুক্তি করা সম্ভব নয়।”
কিন্তু গত তিন বছরেও কেন তৈরি করা গেল না উপযুক্ত পরিকাঠামো? অধ্যক্ষ মণিময়বাবুর জবাব, “পরিকাঠামো সম্পূর্ণ করতে এই সময়টা যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি দরকার আরও অর্থের। বাধাটা আপাতত অর্থেরই। সেটার ব্যবস্থা হয়ে গেলেই আর কোনও সমস্যা থাকবে না।”
অধ্যক্ষের এই বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ‘গণদর্পণ’ সংস্থার ব্রজ রায়। দেহদান আন্দোলনের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত ব্রজবাবু বলেন, “দেহ সংরক্ষণের জন্য জটিল, ব্যয়সাপেক্ষ কোনও পরিকাঠামোর প্রয়োজন নেই। জেলার মেডিক্যাল কলেজগুলো কখনও দানের দেহ ফিরিয়ে দিয়েছে বলে শুনিনি।” উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ এবং মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতার প্রাক্তন অধ্যক্ষ শ্যামলকুমার বসুও বলেন, “এটা হওয়ার কথা নয়। অ্যানাটমির পঠন-পাঠন হচ্ছে, মর্চুয়ারি কাজ করছে, অথচ দান-করা দেহ সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না, তা কী করে হয়?” তিনি বলেন, মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য কিছু রাসায়নিক তার মধ্যে প্রবেশ করাতে হয়। সে কাজের জন্য নির্দিষ্ট কর্মীও থাকে সব মেডিক্যাল কলেজেই। মেডিক্যাল কলেজের গোড়া থেকেই এ সব ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক। মণিময়বাবু অবশ্য জানান, আপাতত অন্য জায়গা থেকে সংরক্ষিত মৃতদেহ এনে তাঁদের কলেজে অ্যানাটমির পঠনপাঠন চলছে।
দেহ সংরক্ষণের পদ্ধতির বিষয়ে অবশ্য কিছুই জানেন না জামালউদ্দিন। কোনও রকমে নিজের নামটা সই করতে পারেন। বছর দুয়েক আগে বহরমপুরের সরকারি চক্ষুদান কেন্দ্রে যোগাযোগ করে অঙ্গীকারপত্রে সই করেন। বাধা এসেছিল নিজের পরিবার থেকেই। তিনি শোনেননি। বাড়ির দাওয়ায় বসে জামালউদ্দিন বলেন, “টিভিতে দেখেছিলাম এক মহিলাকে চক্ষুদান করতে। আমারও ইচ্ছে হয়। মরে গেলে তো সবই শেষ। আমার চোখ দুটো দিয়ে গেলে অন্ধ কোনও মানুষ দৃষ্টি ফিরে পাবেন। এই ভেবেই চক্ষুদান কেন্দ্রে যোগাযোগ করি।” ছেলেরা শেষ অবধি বাবার চক্ষুদানের ইচ্ছায় সম্মতি দিলেও কোনও ‘ঝুঁকি’ নেননি জামালউদ্দিন। গ্রামের জনা কুড়ি লোককে চক্ষুদানের অঙ্গীকারপত্রের জেরক্স কপি ও চক্ষুদান কেন্দ্রের ফোন নম্বর দিয়েছেন। বলেছেন, “দেখবেন, মৃত্যুর ঘন্টা চারেকের মধ্যে ওঁরা যেন আমার চোখ দুটো নিতে পারেন।”
সপ্তাহ তিনেক আগে জামালউদ্দিন দেহদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এখনও কোনও সাড়া না পেয়ে হতাশ তিনি। কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, জামালউদ্দিনের মতো আরও পাঁচ জন দেহদানের আবেদন করেছেন। হাসপাতালে দেহদানের জন্য পরিকাঠামো সম্পূর্ণ হলে তাঁদের ডেকে পাঠানো হবে।
মুর্শিদাবাদের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘জামালউদ্দিনবাবু যেটা করেছেন এবং যা করতে চাইছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ কেন ফিরিয়ে দিয়েছে সেটা কলেজ কর্তৃপক্ষই ভাল বলতে পারবেন।” রঘুনাথগঞ্জ ২ বিডিও ধীরাজকুমার পাল বলেন, “রঘুনাথগঞ্জ এলাকার শতকরা প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ সংখ্যালঘু। শিক্ষার হারও আশানুরূপ নয়। এ রকম একটা জায়গায় জামালউদ্দিন নিজেই একজন দৃষ্টান্ত। প্রশাসনের তরফে ওঁকে সবরকম সাহায্য করা হবে।” |