তামাঙ্গ-ভুটিয়ারা চান পৃথক পর্ষদ, রাজি নয় রাজ্য |
দেবজিৎ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
প্রথমে গোর্খা টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা জিটিএ। পরে তৈরি হয়েছে লেপচা উন্নয়ন পর্ষদ। তারও পরে দার্জিলিঙে ফের পৃথক উন্নয়ন পর্ষদের দাবি উঠল। এ বার দাবি তুলেছেন তামাঙ্গ ও ভুটিয়ারা। কিন্তু রাজ্য সরকার রাজি নয়। আর কোনও পৃথক পর্ষদ না-গড়ে পাহাড়ের সব উপজাতিকে এক ছাতার তলায় আনার প্রস্তাব দিয়েছে রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতর।
ওই দফতরেই পাঠানো চিঠিতে তামাঙ্গ ও ভুটিয়া সমাজের সম্মাননীয় ব্যক্তিরা বলেছেন, লেপচা তফসিলি উপজাতির মতো তাঁরাও দার্জিলিঙের ভূমিপুত্র। বহু পুরুষ ধরে পাহাড়ে বসবাসের ফলে পৃথক উন্নয়ন পর্ষদের দাবি জানানোর অধিকার তাঁদেরও আছে। তামাঙ্গ ও ভুটিয়াদের আর্জি, পাহাড়ে পিছিয়ে পড়া তফসিলি উপজাতিদের উন্নয়নের কথা ভেবে লেপচাদের মতো তাঁদেরও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করুক রাজ্য সরকার।
তামাঙ্গ, ভুটিয়াদের ওই আবেদন অবশ্য রাজ্য সরকার মানছে না বলেই নবান্ন সূত্রের খবর। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “দার্জিলিঙে লিম্বু, শেরপা, ডুকপা, কাগাতে বা ইয়োলমোর মতো আরও তফসিলি উপজাতি আছে। তামাঙ্গ, ভুটিয়াদের দাবি মানলে ভবিষ্যতে অন্যেরাও পৃথক উন্নয়ন পর্ষদের দাবি জানাতে পারে। পর্ষদগুলো নিজের নিজের মতো কাজ করতে থাকলে তো এক সময় পাহাড়ের উন্নয়নই জট পাকিয়ে যাবে।” ওই কর্তার বক্তব্য, পাহাড়ের উন্নয়ন যাতে থমকে না-যায়, তার জন্যই তৈরি হয়েছে জিটিএ। গড়া হয়েছে লেপচা উন্নয়ন পর্ষদও। এর পরেও যদি একাধিক উন্নয়ন পর্ষদ তৈরি হয়, পাহাড় কার্যত টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। এমনকী সেখানকার প্রশাসনিক ব্যবস্থাতেও এর প্রভাব পড়বে বলে অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ কর্তাদের অভিমত।
রাজ্য প্রশাসনের একাংশের আশঙ্কা, উন্নয়নের তাগিদে পরে অন্য আদিবাসীরাও পৃথক পর্ষদের দাবি তুলতে পারে। অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের এক কর্তা বলেন, “পশ্চিম মেদিনীপুরের লোধা, পুরুলিয়ার বীরহোড় ও জলপাইগুড়ির টোটোরা লুপ্তপ্রায় উপজাতি হিসেবে গণ্য। সব তফসিলি উপজাতির জন্য পৃথক পর্ষদ গড়ার নীতি নিলে তাদের অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় তা কার্যত অসম্ভব।”
তা হলে উপায় কী?
অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের প্রস্তাব, তামাঙ্গ ও ভুটিয়াদের জন্য পৃথক উন্নয়ন পর্ষদ তৈরি না-করে পাহাড়ের সব তফসিলি উপজাতিকে এক ছাতায় তলায় নিয়ে আসা হোক। তাতে এক দিকে যেমন সেখানকার সাংস্কৃতিক ঐক্য বজায় থাকবে, তেমনই উন্নয়নের গতি স্তব্ধ হবে না। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “পাহাড়ে জনসংখ্যার নিরিখে গোর্খাদের পরেই লেপচারা। তাই তাঁদের পৃথক উন্নয়ন পর্ষদের দাবি মেনে নিয়েছে রাজ্য। কিন্তু পাহাড়ের বাকি তফসিলি উপজাতিরা সংখ্যায় এতই নগণ্য যে, তাদের জন্য আলাদা পর্ষদ না-গড়ে সকলকে এক ছাতার তলায় আনাটাই যুক্তিসম্মত হবে।”
নবান্ন সূত্রের খবর, ওই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই কয়েক দিন আগে অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ ও স্বরাষ্ট্র দফতরের আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠক করেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। সেখানে লেপচা ছাড়া পাহাড়ের বাকি তফসিলি উপজাতিদের এক মঞ্চে আনার ব্যাপারে সকলে একমত হলেও প্রস্তাবিত পর্ষদের নাম চূড়ান্ত হয়নি। সরকারি সূত্রের খবর, আপাতত ঠিক আছে, পর্ষদের নাম হবে ‘সেন্টার ফর ট্রাইবাল কালচার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’। নামেই ইঙ্গিত, আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও উন্নয়ন একই সঙ্গে দেখবে প্রস্তাবিত উন্নয়ন পর্ষদ।
তবে পর্ষদগুলি আর অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের অধীনে থাকবে না। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বর্তমানে লেপচা উন্নয়ন পর্ষদের কাজকর্ম ওই দফতর দেখলেও ভবিষ্যতে সেগুলি প্রস্তাবিত আদিবাসী উন্নয়ন দফতরের হাতে চলে যাবে। মাস চারেক আগে ওই নতুন দফতর তৈরির কথা ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “ওই দফতর কী ভাবে চলবে, তার দিশা দিতে ১২ সদস্যের একটি পৃথক আদিবাসী উপদেষ্টা পরিষদ তৈরি করা হচ্ছে। দু’-এক দিনের মধ্যেই তার বিজ্ঞপ্তি জারি হবে। ওই পরিষদের মাথায় থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে তফসিলি উপজাতির বিধায়ক ও সাংসদদের।”
মহাকরণ সূত্রের খবর, নতুন দফতর তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। দফতর চলতে গেলে যে-নিয়মবিধি তৈরি জরুরি, তা-ও চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে ডিসেম্বরের গোড়াতেই নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে এক অনুষ্ঠানে নতুন দফতরের কাজকর্মের আনুষ্ঠানিক সূচনা করবেন মুখ্যমন্ত্রী। এখনও পর্যন্ত ঠিক আছে, মমতা নিজের হাতেই রাখবেন ওই দফতর। |