মিহি চালের ভাত, মুগের ডাল, আলুভাজা, পাঁচ তরকারি, মুরগির মাংস, টোম্যাটোর চাটনি, মিষ্টি দই, রসগোল্লা আর শেষ পাতে মুচমুচে পাঁপড়ভাজা।
দু’টি শর্তে বেলডাঙার আণ্ডিরনের জগদীশ মণ্ডলের মেয়ের বিয়েতে এই ভোজের দায়িত্ব নিয়েছিল কামাখ্যা সেবা সঙ্ঘ নামে বেলডাঙার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। কী সেই শর্ত? এক, মেয়েকে হতে হবে সাবালিকা। দুই, ওই বিয়েতে কোনওমতে পণ দেওয়া-নেওয়া চলবে না। জগদীশবাবুর মেয়ের বিয়েতে ওই দুটি শর্তের কোনওটাই লঙ্ঘিত হয়নি। জগদীশবাবু ঘানিকলে কাজ করে কোনওমতে সংসার চালান। তাঁর কথায়, “মেয়ের বিয়েটা নমো নমো করেই দিচ্ছিলাম। নিমন্ত্রিতদের খাওয়ানোর ক্ষমতা আমার ছিল না। ওই সংস্থার সদস্যেরা তখন আমায় বলেন, তাঁরা সাহায্য করবেন। তাই প্রতিবেশীদের কাছে মুখরক্ষা হয়েছে। মেয়ের মুখেও হাসি ফুটেছে।”
একা জগদীশবাবুই নন। সাবালিকা কন্যার পণ ছাড়া বিবাহে, পরিবার দুঃস্থ হলে এভাবেই এগিয়ে আসেন ওই সংস্থার সদস্যরা। সোমবার রাতে জগদীশবাবুর মেয়ের বিয়েতে অতিথির সংখ্যা ছিল ২৭৩ জন। ভোজের এই আয়োজনে খরচ হয়েছে প্রায় কুড়ি হাজার টাকা। সেই টাকা দিয়েছে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। |
ওই সংস্থার সদস্যদের দাবি, এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। ২০১২ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত অন্তত পাঁচটি বিয়েতে তাঁরা পাত্রী পক্ষের হয়ে এমন নিখরচায় ভোজের আয়োজন করেছেন। চলতি মাসে আরও দুটো এমন দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে ওই সংস্থা। সংস্থার সভাপতি তাপস মালাকার বলছেন, “কোনও দুঃস্থ পরিবারের মেয়ের বিয়েতে আর্থিক সমস্যা হলে আমরা এমন আয়োজন করে থাকি। তবে তার জন্য দুটো জিনিসের উপর আমরা কড়া নজর রাখি। এক, পাত্রীকে সাবালিকা হতে হবে। দুই, ওই বিয়েতে কোনওভাবে পণ দেওয়া-নেওয়া চলবে না।”
বেলডাঙার ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় এই মুহূর্তে বিভিন্ন পেশার ২১ জন সদস্য-সদস্যা রয়েছেন। সংস্থার সদস্য পেশায় ভ্যানচালক হৃদয় আলিও। এই খরচের টাকার সংস্থান হয় কীভাবে? সংস্থার সভাপতি তাপস মালাকার বলেন, “আমাদের সদস্যরা যে যেমন পারেন সংস্থার জন্য টাকা দেন। আমরা একটা টিউটোরিয়াল হোম ও জলের প্রকল্প চালাই। সেখান থেকে কিছু টাকা আসে। তাছাড়া লোকজনের কাছে কখনও চাঁদাও সংগ্রহ করি। এভাবেই চলছে।” হৃদয় বলেন, “বছর কয়েক আগে আমার এক বন্ধুর দিদির বিয়ের জন্য একটা সম্বন্ধ এসেছিল। কিন্তু পণের জন্য সে বিয়ে ভেঙে যায়। তারপর আমার ওই বন্ধুর দিদি আত্মহত্যা করেছিল। ওই ঘটনার পর থেকে আমরাও পণ করি যে পণের জন্য আর কাউকে মরতে দেব না।”
সংস্থার প্রথম দিকের সদস্য সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “বলতে পারেন ওই ঘটনার পর থেকেই আমাদের পথচলা শুরু হয়েছিল। তখন অবশ্য দলে এত লোকজন ছিল না। পরে বিভিন্ন পেশার মানুষ আমাদের দলে ভিড়তে শুরু করেন। শিক্ষক থেকে শুরু করে রিকশাচালক, পাড়ার রকে আড্ডা দেওয়া বেকার যুবক থেকে শ্রমিক, গৃহবধূ সকলেই আমাদের সংস্থার সক্রিয় সদস্য।”
নাবালিকার বিয়ে কিংবা কোথাও পণ নিয়ে বিয়ে হচ্ছে শুনলেই পত্রপাঠ সেখানে হাজির হয়ে যান ওই সংস্থার সদস্যরা। আবার সম্পন্ন নয় এমন কোনও পরিবার মেয়ের বিয়ের আয়োজন করতে পারছেন না খবর পেলেই খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন ওঁরা।
কিন্তু এত টাকা খরচ করে ভোজ কেন? তাপসবাবু বলেন, “মেয়ের বিয়েতে লৌকিকতা না করতে পারাটা অপমানের বলে মনে করেন এলাকার মানুষ। যে কারণে এটা করতেই হয়।” |