শীত পড়তেই যেন বদলে গিয়েছে জলঢাকার চেহারা। নদীর বুকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির ওড়াওড়ি। ‘নর্দান ল্যাপউইং’ ঝুঁটি নাচিয়ে শব্দ করে উড়ে বেড়াচ্ছে। দূরে কলতানে মুখর ‘রুডি শেল ডাক’। স্থানীয় ভাবে চখাচখি নামে বেশি পরিচিত ওই পাখি। খাবারের খোঁজে উড়ছে ‘কমন স্যাণ্ডপাইপার’, ‘কমন টেল’।
হিমের পরশ লাগতে ময়নাগুড়ির পানবাড়ি লাগোয়া জলঢাকা-মূর্তি-ডায়না নদী সঙ্গম এলাকা এ ভাবে পক্ষী নিবাসে পাল্টে যেতে শুরু করেছে। ইউরোপ-সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে পরিযায়ী পাখিরা ভিড় জমাতে শুরু করেছে সেখানে। শীতের অতিথিদের পেয়ে খুশি স্থানীয় মাঝিরাও। স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে ওঁরা কদমবাড়ি ঘাট থেকে ত্রিবেণী সঙ্গমে নৌকা বিহার শুরু করেছেন। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গরুমারা জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদের নিয়ে তাঁরা যাচ্ছেন নৌকা-বিহারে। শীতের কয়েকটা মাস পরিযায়ীদের কাছ থেকে দেখতে পর্যটকদের ভিড় বাড়বে বলে আশায় বুক বেঁধেছেন মাঝিরা। সে জন্য পাখিদের আগলে রাখতে নজরদারিও চালাচ্ছেন তাঁরা।
এলাকার বাসিন্দাদের হিসেব অনুযায়ী, নভেম্বরের মাঝামাঝি পৌঁছেছে নর্দান ল্যাপউইং। সংখ্যায় নেহাত কম নয়। মাঝিরা জানান, বুক সাদা, সবজে ধুসর ওই পাখি কয়েক বছর পরে এল ত্রিবেণী সঙ্গমে। নীল আকাশ জুড়ে ওদের হুটোপুটি। কখনও নিচে নেমে মুরগির মতো পা দুটি জলে ডুবিয়ে বোরোলি, খোকসার মতো চুনো মাছ শিকার করছে। সুযোগ বুঝে বাজপাখি ছোঁ মেরে দু-একটাকে তুলে নিয়েও যাচ্ছে। |
জলঢাকায় পাখিদের ঝাঁক। ছবি তুলেছেন দীপঙ্কর ঘটক। |
বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির সেন্টার ম্যানেজার সচিন রানাডে বলেন, “অতিরিক্ত ঠাণ্ডার জন্য নর্দান ল্যাপউইং ইউরোপ এবং সাইবেরিয়ার আশপাশ এলাকা থেকে ডুয়ার্সে উড়ে এসেছে। এখানকার শীতের আবহাওয়া মানিয়ে নিতে ওদের অসুবিধা হয় না। একই কারণে অন্য কিছু পরিযায়ী এসেছে সাইবেরিয়া এবং পাহাড়ের উঁচু শৃঙ্গ থেকে।” পরিযায়ীদের ভিড়ের খবর পেয়ে খুশি হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের মুখপাত্র অনিমেষ বসু। তিনি জানান, গজলডোবায় ওই পাখিদের দেখা যেত। এখনও আসে। তবে সংখ্যায় কম। জলঢাকায় আসতে শুরু করেছে এটা ভাল দিক।
মাঝিরা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নদী এলাকায় নজরদারি করছেন। পর্যটকদের ফাঁকা চরে নামিয়ে পাখি দেখাচ্ছেন। কেউ পাখিদের বিরক্ত করছে দেখা মাত্র নৌকা ভাসিয়ে তেড়ে যাচ্ছেন। শুধু কী পরিযায়ী? প্রকৃতি যেন সমস্ত রূপ উজাড় করে দিয়েছে কদমবাড়ির ত্রিবেণী সঙ্গমে। সকালে নৌকায় ভাসতে হাতের মুঠোয় চলে আসছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। ঝকঝকে নীল আকাশে ভেসে ওঠা পর্বত শৃঙ্গে বরফের গায়ে নানা রঙের খেলাও স্পষ্ট দেখা মিলছে। এমন অপরূপ ক্যানভাসে নর্দান ল্যাপউইংদের ডানা ঝাপটানোর বিরল দৃশ্য দেখে আত্মহারা পর্যটকরা। মাঝি মদন রায়, খুলেন রায় বলেন, “এত কিছু এক সঙ্গে কোথায় মিলবে! ইতিমধ্যে কয়েক হাজার পাখি এসেছে। আরও আসবে। ওরা যেন শান্তিতে থাকতে পারে সেই ব্যবস্থাও করা হয়েছে।” |