ছাই হয়ে গিয়েছে ইলিশ।
ঠোঁট উল্টে হাসছেন কোলাঘাটের মৎস্য ব্যবসায়ী সনাতন মণ্ডল, “রূপনারায়ণে কী আর ইলিশ ওঠে? নদী তো ছাইয়ে ঢেকে গিয়েছে।”
বছর দুয়েক আগেও হেমন্ত-বিকেলে কোলাঘাট বাজারে আচমকা মিলে যেত মাঝারি মাপের ইলিশ। এ বার ঘোর বর্ষাতেও অলীক-ইলিশের দেখা মিলেছে কদাচিৎ। কোলাঘাটের সান্ধ্য-বাজারের খোলা চাতালে কার্বাইডের লম্ফে সেই রূপোলি শস্য চিক চিক করে উঠলেই দাম উঠেছে আটশো থেকে হাজার টাকা কেজি। সাকুল্যে চার-পাঁচশো গ্রাম ওজনের মাছ নিমেষে বিকিয়ে গিয়েছে। যা দেখে সনাতনবাবু মুচকি হেসে বলেছেন, “বাবুরা খাঁটি ইলিশ চিনল কই, খেজুরির খোকা ইলিশ কোলাঘাট বাজারে হাজার টাকায় বিকোচ্ছে। লোকে ভাবছে রূপনারায়ণের রূপোলি শস্য। এই ঘোলা নদীতে কি আর ইলিশ আসে!” |
কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। —নিজস্ব চিত্র। |
রূপনারায়ণ আর ইলিশের বাস যোগ্য নয়। কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে তিন-তিনটি খাল বেয়ে অবিরাম ছাই-গোলা জল পড়ছে নদীতে। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞানের শিক্ষক বিধান পাত্র বলেন, “রূপনারায়ণে ইলিশের চেনা আবাসই হারিয়ে গিয়েছে। অনর্গল ছাই-গোলা জল নদীতে পড়ছে। কাদা হয়ে গিয়েছে নদীর জল। তা আর ইলিশের বাসযোগ্য নেই।”
এ যদি হয় কোলাঘাটের কিস্সা তাহলে বীরভূমের বক্রেশ্বরের চন্দ্রভাগা নদীতে স্নান করতে ভরসা পান না মল্লিকপুরের মানুষ। মরা নদীতে কচুরিপানার জঙ্গল। সেই আগাছার ভিড়ে জল যেন ঘোলা মাড়ের মতো জমাট।
নদীর-পাড়ে মল্লিকপুর গ্রামের বাসিন্দা শাসক দলের তাবড় নেতা মিহির মণ্ডল। তিনি বলেন, “বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে দিনভর ছাই উড়ছে। চিমনির ছাইয়ে ছেয়ে গিয়েছে আশপাশের গ্রাম-গঞ্জ। তার উপর ছাই-পুকুর উজিয়ে ঘোলা জল নদীর রং বদলে দিয়েছে। সে জল গ্রামের গরু-ছাগলেও মুখে দেয় না।” মল্লিকপুর ১ নম্বর পঞ্চায়েতের খান দশেক গ্রামের মানুষ সমস্বরে জানান, চন্দ্রভাগায় স্নান করতেও আর ভরসা পান না তাঁরা। তাঁদেরই এক জন বলেন, “বছর খানেক আগে নদীতে স্নান করার পরে চর্মরোগ ছেয়ে গিয়েছিল মল্লিকপুরে। তারপরে আর কেউ জলে নামে!”
আর দুর্গাপুর? সেখানে দামোদর ক্রমান্বয়ে ভরে উঠছে দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের (ডিএসপি) বর্জ্য ছাইয়ে। ডিএসপি’র পাঁচিল উজিয়ে আসা পাইপের ঘোলা জল ছাই-পুকুর ভরাট করে ধেয়ে গিয়েছে দামোদর নদের দিকে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পাইপ ফেটে ছাই গোলা তপ্ত জল অনেক সময়েই ছড়িয়ে পড়ে নদীর লাগোয়া জমিতে। সেই জমি থেকে আবাদের সম্ভাবনা মুছে গিয়েছে। এখন ছাইয়ের দাপটে নদীতেও চড়া পড়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা পার্থসারথী দাঁ বলেন, “চড়া পড়তে পড়তে নদীতে মাছের আনাগোনাই দুর্লভ হয়ে পড়েছে। দুর্গাপুর ব্যারেজের কাছেই একটা জেলে পাড়া ছিল। প্রায় চল্লিশ ঘর জেলের রুজির উপায় ছিল দামোদরের মাছ। বছর কয়েক হল, সেই জেলে-পাড়াটাই উঠে গিয়েছে। নদীতে মাছ না থাকায় ঠাঁইনাড়া হয়ে গিয়েছেন তাঁরা।”
মেজিয়ার কোলে দামোদর কিংবা পুজালি ও ব্যান্ডেলের গা ঘেঁষে গঙ্গা--তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ক্রমাগত উড়ে আসা ছাইয়ে নদীগুলি তাদের চেহারা-চরিত্র ক্রমেই বদলে ফেলেছে। সে কথা অবশ্য মানছেন কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অধিকর্তা পুলক রায়। তিনি বলেন, “রাপনারায়ণে ছাই-দূষণের প্রশ্নই নেই। প্লান্ট থেকে ছাই গোলা জল তো সরাসরি নদীতে নয়, পড়ে মেদিনীপুর খালে। সেই জল ফের পরিশোধন করে ব্যবহার করা হয় প্লান্টের বিভিন্ন কাজে।” কিন্তু সরাসরি না হোক, মেদিনীপুর, দেনান এবং মেচেদা-বাঁপুর ক্যানালবাহিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই গোলা জলই তো রূপনারায়ণের রং বদলে দিচ্ছে? বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জিএম মহিতোষ মাজির দাবি, “জমি পাওয়া গেলেই আমরা আরও একটি ছাই-পুকুর তৈরি করব। তবে চন্দ্রভাগা মজে যাওয়ার পিছনে প্লান্টের ছাইকে দায়ী করার মানে হয় না।” আর, ডিএসপি’র জনসংযোগ আধিকারিক বিভুরঞ্জন কানুনগো বলেন, “সাম্প্রতিক কালে দূষণের তো কোনও অভিযোগ নেই।”
নদী পাড়ে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ‘দাপটে’র কথা জানেন পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষ দস্তিদারও। তিনি বলেন, “ছাইয়ের দাপটে মাঠ-ঘাট, নদী-নালার যা অবস্থা তা নিয়ে সতর্ক হওয়ার সময় হয়েছে। এ ব্যাপারে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে নজর রাখার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।”
ছাইয়ের চাদরে ক্রমশ হারিয়ে যাওয়া নদী বাঁচাতে বহু দিন ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইন-অফিসার বিশ্বজিত মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির একশো কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নির্মাণ বেআইনি। সুপ্রিমকোর্ট এই নির্দেশ জারি করেছিল যাতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি থেকে নির্গত ছাই যত্রতত্র না ছড়িয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থে কাজে লাগানো যায় এবং একই সঙ্গে রোধ করা যায় ছাই-জনিত দূষণ। কিন্তু রাজ্যের তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি শীর্ষ আদালতের সেই নিয়ম মানলে তো!” তাঁর পরামর্শ, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ‘বর্জ্য’ছাইয়ের ব্যবহার বাড়ানো গেলেও পরোক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে দূষণ।
তবে এ ব্যাপারে রাজ্যের ‘ফ্লাই অ্যাশ ব্রিকস অ্যান্ড ব্লকস ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশন’ সূত্রে জানা গিয়েছে এ ব্যাপারে তাদের অভিজ্ঞতা বিশেষ সুখকর নয়। সংগঠনের সম্পাদক সুরজিৎ বসুর আক্ষেপ, “তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই দিয়ে তৈরি ইট শুধু মজবুত নয়, দামেও সস্তা। এমনকি, ফ্লাই অ্যাশের ইট তৈরির পদ্ধতিতে দূষণের মাত্রাও শূন্য। তবুও সাধারণ মানুষের মানসিকতা বদলায়নি। ফলে সাবেক ইটের বাজারে আমরা দাঁত ফোটাতে পারিনি।”
বাজার নেই ‘ছাই-ইটে’র, রূপনারায়ণ থেকে হারিয়েছে ইলিশ, চন্দ্রভাগায় চর্মরোগের আতঙ্ক, দামোদরের পাড় থেকে উঠে গিয়েছে জেলে-পাড়া—এই সুদীর্ঘ হা-হুতাশে দাঁড়ি পড়বে কবে? |