নদীর নাম লোইতি। পাহাড় থেকে নেমে আসা যে কোনও নদীর মতোই তির তির করে বয়ে চলেছে। জল আয়নার মতো। নুড়িপাথর থেকে ছোট মাছ, পরিষ্কার দেখা যায়। বর্ষার সময়ে ওই নদী পাহাড় থেকে বুকে করে বয়ে আনে ছোট বড় পাথর। নদীর এক দিকে সবুজ পাহাড়। অন্য দিকে জনপদ। ছবির মতো। দারুণ ল্যান্ডস্কেপ।
জলপাইগুড়ি জেলার মানাবাড়ি এসে হঠাৎ ছন্দপতন। নদীটা বেমালুম দখল হয়ে গিয়েছে। সেই দখল করা অংশে তৈরি হয়েছে কংক্রিটের ঢালাই করা বাড়ি। পেল্লায় খানতিনেক পে-লোডার নদীর বুক থেকে তুলছে পাথর। সেই পাথর ভাঙা হচ্ছে দখল করা নদীর বুকে বসানো যন্ত্রে। আর সেই পাথরের টুকরো লরি ভরে চালান যাচ্ছে। লরির অস্থায়ী গ্যারেজও তৈরি হয়েছে নদীর
বুক দখল করে। লরি এবং ডাম্পারের যাতায়াতের জন্য নদীর বুকে গর্ত করে বসানো হয়েছে
মোটা মোটা পাইপ। ক্রমশ এগিয়েই চলেছে কারখানার এলাকা।
আর নদীটা? পাথর ভাঙা কারখানার দুই পাশ দিয়ে দুটি শীর্ণ ধারায় এখন বয়ে চলেছে লোইতি। প্রায় এক কিলোমিটার গিয়ে ফের যোগ হয়েছে লোইতির দুটি ধারা, তার পর মিশেছে ঘিষ নদীতে। আগের দিন রাতে ভাল বৃষ্টি হয়েছে। পাহাড় থেকে জল নেমে আসছিল বেগে। দখলি এলাকার দুটি পাশ দিয়ে লোইতির যে শীর্ণ শাখাটি বইছিল, সেই জলে পা দিয়ে থমকে গেলাম। ভারসাম্য রাখা যাচ্ছিল না। এতটাই স্রোত নদীতে। বড় আকারের পাথর টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, যেন খড়কুটো ভেসে যাচ্ছে।
আর তখনই চোখের সামনে ভেসে উঠল মধ্য জুনের সেই দৃশ্যটা। হিমালয়ের অন্য একটি অংশের দৃশ্য সেটি। মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে ফুলেফেঁপে উঠেছে মন্দাকিনী ও সরস্বতী। পাহাড় গড়িয়ে নেমে আসা সেই জলরাশি ধরে রাখতে পারেনি গাঁধী জলাধার। বিশাল জলরাশি সব বাধা ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে কেদারনাথ ও তার আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা। মৃত্যুর পুরো হিসেব এখনও করে উঠতে পারেনি উত্তরাখণ্ড সরকার। অগণিত পরিবার এখনও বিপর্যস্ত।
বিপর্যয়ের তদন্তে গিয়ে প্রশাসন দেখেছে, পরিবেশ দফতরের নিষেধাজ্ঞা ভেঙে মন্দাকিনী এবং সরস্বতী নদীর দুই পাড় দখল করে তৈরি হয়েছে দোকান, পান্থশালা, হোটেল। কোথাও বা নদীর স্বাভাবিক পথ দখল করেই তৈরি হয়েছে বাড়ি। পাহাড়ি নদী ক্রমেই সংকুচিত হয়েছে। তাই অতিরিক্ত বৃষ্টিতে নেমে আসা জল ধরে রাখতে পারেনি নদী। ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে সব। প্রকৃতি নিজেই দখলমুক্ত করেছে নদী দুটিকে। |
হ্যাঁ, এটাই লোইতি নদী। ছবি: দেবদূত ঘোষঠাকুর। |
দার্জিলিঙ পাহাড়ে অতিবৃষ্টি হলে লোইতি যদি মন্দাকিনী কিংবা সরস্বতীর চেহারা নেয়? দখল করা অংশে বাধা পেয়ে সে তবে গতিপথ বদলে আশপাশের গ্রাম ভাসিয়ে দেবে। অথবা হয়তো মন্দাকিনী, সরস্বতীর মতো বিশাল পাথর ঠেলে এনে গুঁড়িয়ে দেবে পাথর ভাঙার কারখানাটি। গোটা ঘটনাটা এমন হঠাৎ করে ঘটবে যে গ্রামবাসীরা পালানোর সুযোগ পর্যন্ত পাবেন না। পাথর ভাঙার কারখানা, লরি, পে লোডার, কোথায় যে ভেসে যাবে কে জানে!
কিন্তু এমন ভাবে একটা নদী দখল হয়ে গেল আর এলাকার মানুষ চুপ থাকলেন? কাছাকাছি শহর বলতে ওদলাবাড়ি। ওদলাবাড়ির পরিবেশ সংস্থা নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার সোসাইটি (এনএএস) এক সময় আন্দোলন গড়ে তুলেছিল নদী দখলের প্রতিবাদে। পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিল। চিঠি দিয়েছিল রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং জলপাইগুড়ির জেলা শাসকের দফতরেও। এনএএস-এর উপদেষ্টা দিলীপ বসাক বললেন, “পরিবেশ দফতর থেকে লোক এসেছিল। তদন্তও করেছিল। তদন্তের সময় পাথর ভাঙার যন্ত্র বন্ধ করে রাখা ছিল। ফলে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি। ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশও।” “যেখানে নদীর মধ্যে পাথর ভাঙার কারখানা হয়েছে সেটি হাতির যাতায়াতের পথ। আমরা এ বিষয়ে বন দফতরকেও জানিয়েছি। কিন্তু কিছুই হয়নি। দিব্যি চলছে ওই কারখানা। ঘুরপথে যেতে গিয়ে হাতি ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে,” মন্তব্য করেছেন হতাশ দিলীপবাবু।
ওদলাবাড়ি থেকে মানাবাড়ি, তিন কিলোমিটার পথ পেরোতে লেগে যায় পাক্কা চল্লিশটি মিনিট। রাস্তায় বিশাল বিশাল খন্দ। একমাত্র যান অটো। তা চলে কার্যত লাফিয়ে লাফিয়ে। এনএএস-এর উপদেষ্টার বক্তব্য, “১০ চাকা, ১২ চাকার লরি ৫০ টন, ৬০ পাথর নিয়ে জেলা পরিষদের তৈরি ওই রাস্তা দিয়ে বার বার যাতায়াত করলে যা হয় সেটাই হয়েছে।”
শুধু লোইতি নয়, দার্জিলিং পাহাড় থেকে নেমে আসা রোক্তি, চামটা, চাঁদমণি এবং লচকা নদীর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে জমি মাফিয়া বা পাথর ভাঙার কারখানার মালিকেরা দখল করে নিয়েছে, এই অভিযোগ হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন (ন্যাফ)। উত্তরবঙ্গে বন ও পরিবেশ সংরক্ষণের কাজে ব্রতী ন্যাফ-এর কর্তা অনিমেষ বসুর মন্তব্য, ওদলাবাড়িতে দিলীপবাবুরা যে আন্দোলন করেছেন, নদী দখল করে পাথর ভাঙার কারখানা তৈরির প্রতিবাদে তেমনই আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন পতন ফুলবাড়ি গ্রামের মানুষ। রোক্তি নদীর দখলদারি রুখতে তৈরি করেছিলেন প্রতিরোধ মঞ্চ। সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বিস্তর চিঠিচাপাটি লিখেছিল প্রশাসন, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে। দখলদারদের সরানো যায়নি। অনিমেষবাবুর ধারণা, শিলিগুড়ি শহরের গা ঘেঁষে যাওয়া চামটা, চাঁদমণি এবং লচকা নদীর উপরে জমি মাফিয়াদের নজর যে ভাবে পড়েছে তাতে উত্তরবঙ্গের এই প্রধান শহরের ভবিষ্যতও খুব নিশ্চিন্ত নয়।
পরিবেশের ঝুঁকির কথা মেনে নিয়েও উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদের এক কর্তার ব্যাখ্যা, উত্তরবঙ্গে এমনিতেই শিল্পের সংখ্যা খুবই কম। মানুষের অবস্থা খুবই খারাপ। পাথর ভাঙার কারখানাগুলির উপরে বহু মানুষ, বিশেষ করে আদিবাসীরা নির্ভরশীল। তাঁদের বিকল্প পেশার ব্যবস্থা না করে ওই সব কারখানা তুলে দেওয়াটা যথেষ্ট ঝুঁকির হয়ে যাবে।
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের প্রত্যাশিত বক্তব্য: “নদীর বুকে কিংবা পাশে যে সব পাথর ভাঙার কারখানা, সেগুলি সব বামফ্রন্ট আমলের। আমি নিজে মানাবাড়ির ওই পাথর ভাঙার কারখানাটি দেখে এসেছি। এ বার ওই অঞ্চলে যে বন্যা হয়েছে তার জন্য ওই কারখানাটিও অনেকাংশে দায়ী।”
কোনও ব্যবস্থা নিয়েছেন কি? “সেচ দফতরকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলেছি। যে ভাবে বেপরোয়া ভাবে নদী থেকে পাথর ও বালি তোলা হচ্ছে তাতে পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। রাজ্য সরকার বসে থাকবে না। আমরা প্রতিটি পাথর ভাঙা কারখানার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেব। এ ভাবে চলতে পারে না।”
কবে মন্ত্রী সক্রিয় হন, কবে নদীর মুক্তি ঘটে, তারই অপেক্ষায় থাকতে হবে মানাবাড়িকে। |