|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
‘কাজ করতে চাই, কাজ দেবেন না মানে?’
অধিকার আন্দোলন আর ভোটের রাজনীতি, দু’দিক থেকেই উন্নয়নের
যে ছক তৈরি হচ্ছে
তাতে জনপ্রতিনিধির সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘাত চলবেই।
প্রাপ্যটুকু
আদায়
করতে ময়না, কণিকাদের প্রাণ-মান বিপন্ন করতেই হবে?
স্বাতী ভট্টাচার্য |
ওরা কী ভেবেছে? এটা কি অঞ্চল অফিস, না ওদের রান্নাঘর? রোগা-পাতলা তৃণমূল কর্মীর কথাগুলো দিনহাটার প্রত্যন্ত এক পঞ্চায়েত অফিসের চুনকাম-করা দেওয়ালগুলোতে যেন ঠোক্কর খেয়ে ফিরতে লাগল। চওড়া টেবিলের ও পাশে সদ্য-নির্বাচিত প্রধান মিরাজুন নাহার, জাঁদরেল গোঁফধারী উপপ্রধান, গেরামভারি সদস্য। সবাই তৃণমূল। আর ‘ওরা’? তাদের দু-একটা ভোটে দাঁড়িয়ে হেরো-ভূত, বাকিগুলো পার্টিই করে না। তা সত্ত্বেও অ্যাদ্দিন কংগ্রেস, সিপিএম ওদের কব্জা করতে পারেনি। এখন তৃণমূল হার মানছে কোচবিহারের ‘প্রমীলা বাহিনী’র কাছে।
ওরা সংখ্যায় সাড়ে ছ’হাজার, লেখাপড়া সামান্য, কাজ করে গেরস্তালিতে, খেতখামারে। তারই ফাঁকে তৈরি করে লিস্ট। একশো দিনের কাজের মজুরের তালিকা। কাগজের তাড়া নিয়ে চলে যায় পঞ্চায়েতে। প্রধানের কাছে দাবি করে, কাজের আবেদন এনেছি, লেবার লিস্ট এনেছি, সই করে দিন। কাজের অধিকার আছে।
ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস? সই করেন না প্রধান। মেয়েরা যায় বিডিও অফিসে। নভেম্বরের এক দুপুরে তাদের পিছু পিছু বিডিও সাহেবের ঘরে ঢুকে দেখা গেল, মেয়েরা টেবিল ঘিরে বসে রয়েছে। আর বিডিও পঙ্কজ তামাঙ্গ ফোন তুলে প্রধানকে বলছেন, “লিস্টে সই করে কালই পাঠান, পরশু থেকে কাজ শুরু করব।” গ্রামের মেয়েরা পঞ্চায়েত সমিতির প্রকল্পে কাজ করলে গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের আপত্তি কী? “ওরা আলোচনায় আসুক। কিছু ওদের লেবার কাজ করুক, কিছু আমাদের,” বক্তব্য গীতালদহ ১ গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান মিরাজুনের। মেয়েদের তাতেই আপত্তি। বেছে বেছে কাজ দেবে
কেন? যে চাইবে তাকেই দিতে হবে, এটাই আইন।
সরকারি আইন সরকারকে মানাতে গেলে কী দশা হয়, ওই মেয়েরা হাড়ে হাড়ে জানে। প্রথম যখন ওরা কাজ চেয়েছিল একশো দিনের প্রকল্পে, ক্ষমতায় বামফ্রন্ট। প্রধান আবেদন জমা নেয়নি, ওরা ব্লকে চিঠি জমা দিয়ে এসেছিল। চটে গিয়ে পঞ্চায়েত থেকে কাজ দিল পুকুরের পানা তোলার। “ওই পুকুরে যা সাপ, কেউ ঘাটে কাপড় কাচতেও যেত না,” বললেন ময়না বিবি, নুরখাতুন বিবিরা। জেদের বশে সেখানেই কোমর জলে দাঁড়িয়ে পানা তুলল ওরা। শেষে থই মেলে না, তখন কঞ্চি দিয়ে টেনে টেনে পানা তুলতে হয়েছে।
২০০৬ সালে ৫০জন মেয়ে নিয়ে প্রমীলা বাহিনী শুরু। বছরে চাঁদা ছিল দু’টাকা। ২০০৯ সালে সদস্য হল আড়াই হাজার, চাঁদা বছরে পাঁচ টাকা। এ বছর সদস্য সাড়ে ছ’হাজার, পাঁচটা ব্লকের ৫২টা গ্রামে তারা ছড়িয়ে রয়েছে। চাঁদা হয়েছে বছরে ১০ টাকা। প্রমীলা বাহিনীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ৩২ হাজার টাকা জমেছে। আর জমেছে গল্প। এক বার তো পোস্ট অফিসে গিয়ে ওরা দেখে, পাওনা মজুরির চাইতে বেশি টাকা জমা পড়েছে সবার অ্যাকাউন্টে। সুপারভাইজার বলল, বাড়তি টাকা উঠিয়ে আমার হাতে দাও। মেয়েরা বিডিও-র কাছে নালিশ করলে তিনি উলটে মেয়েদের নামেই অভিযোগ দায়ের করলেন, তারা বেশি টাকা উঠিয়ে নিয়েছে। মেয়েরা ঘেরাও করল, সুপারভাইজার সাসপেন্ড হল, ছুটিতে পাঠানো হল বিডিওকে। |
|
এমন নানা সাফল্য ওদের প্রত্যয় এনে দিয়েছে। ওরা জুয়ার তিনটে ঠেক ভেঙে দিয়েছিল (থানার পুলিশ আসেনি, এসপি-কে ফোন করে পুলিশ আনতে হয়েছিল), সেগুলো আর ফিরে আসেনি। যে দালালরা মেয়েদের পাচার করত দিল্লি, হরিয়ানায়, ওদের নজরদারিতে তাদের পিছু হঠতে হয়েছে। যে নির্মাণ সহায়ক ওদের কাজ দিতে চাননি, তাঁকেই ওদের সঙ্গে গিয়ে ব্লক থেকে মজুরির চেক ‘রিসিভ’ করতে হয়েছে। এমনকী ওদের স্বামী-শ্বশুরও আজ ওদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তিলক বর্মন যখন প্রথম বাহিনীর অন্যদের সঙ্গে কাজের আবেদন জমা দিয়েছিলেন ব্লক অফিসে, তখন স্বামী এসে নিষেধ করেছিলেন। দলের নেতা এসে হুমকি দিয়ে গিয়েছেন, ‘তোর বউকে সামলা।’ “আমি বললাম, তোমার খেতে কাজ করে কে, নেতা না আমি? বর, শ্বশুরমশাই বোঝাতে না পেরে শেষে বিএসএফ জওয়ান ভাসুরকে ডেকে আনল। দাদা বললেন, বউমানুষদের অত ঘর থেকে বেরোতে নেই। আমি বললাম, তা হলে মেয়েরা পুলিশ হচ্ছে কী করে? দেখুন না আমি বেআইনি কিছু করি কি না। আজ কিন্তু আমার বরকে কেউ কথা শোনাতে এলে সে-ই দু’কথা শুনিয়ে দেয়।”
রাষ্ট্র-নাগরিক। নেতা-জনতা। পুরুষমানুষ-মেয়েমানুষ। যে ভাবেই দেখা যাক, ওরা ক্ষমতার ও ধারে। তবু যা ওদের চাই, তা আদায় করে নিয়ে আসছে ময়না বিবি, কণিকা চক্রবর্তী, জরিভা বেগমরা। তবে কি গেল-গেল করেও গণতন্ত্র রয়েছে এ দেশে, এই সীমান্ত-ঘেঁষা গ্রামে? কোনও অপরূপ রসায়নে গণতন্ত্রের পাকশালায় আইনি অধিকার পুষ্ট করছে জীবনকে?
|
অধিকার বনাম সমর্থন |
কিন্তু গণতন্ত্রই যদি কাজ করে, তা হলে ভোটে জিতে এসে নেতারা কেন মানুষের কথা শোনে না?
প্রমীলা বাহিনী বিরল, তবু আশ্চর্য নয়। দেশের বহু গ্রামে এমন কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে মানুষ প্রাপ্য আদায়ের লড়াই চালাচ্ছে। কখনও তা নীচ থেকে উঠে-আসা আন্দোলন, কখনও বাইরের কোনও সংস্থার সহায়তায় গড়ে ওঠা জন-উদ্যোগ। বিস্ময় যদি কিছু থাকে, তবে তা রাজনীতির ভূমিকায়। বিপুল ভোটে জিতে, এই প্রথম পঞ্চায়েতে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস। অথচ তিন দশকের বামফ্রন্ট জমানায় যে ভাবে কাজের দরখাস্ত ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘নিজের লোক’ বেছে কাজ দেওয়া হয়েছে, এখনও তাই। মিরাজুন নাহার পঞ্চায়েতে আনকোরা, তাঁর সহকর্মীদের অনেকেই এই প্রথম ক্ষমতার আসনে বসলেন। তা হলে সরকারি সুযোগসুবিধে গ্রামের মানুষকে দিতে এত অনাগ্রহ কেন? গ্রামে বাস করেও গ্রামবাসীর থেকে কেন এমন মুখ ফেরানো?
একটা কারণ হাতের কাছেই আছে, দুর্নীতি। কোনও কোনও প্রধান নাকি খোলাখুলি বলছেন, পয়সা দিয়ে ভোটে লড়েছি, পয়সা না দিলে কোনও আবেদনে সই করব না (মিরাজুন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন)। কিন্তু সে নালিশ সত্যি হলেই বা কী? সবাই নেতাদের হাত-পাতার সঙ্গে মোটামুটি পরিচিত। তাতে খুচরো অশান্তি হতে পারে, বড় কাজ আটকায় না।
গ্রামে ঘুরলে মনে হয়, গ্রামের গরিব আর গ্রামের নেতা, দু’জনেই পড়েছে ফাঁপরে। ভোটার তৈরি করতে গেলে দেওয়া-থোওয়ার শর্ত তৈরি করতেই হয়, কিন্তু অধিকার জিনিসটাই নিঃশর্ত। কাজ, খাদ্য, শিক্ষা, এ সবের কোনওটার বিলিবণ্টনে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই গ্রামের নেতার। দেশের নানা দিকে গরিবের রোষ সামলাতে বরং আরও আরও ‘অধিকার’ তৈরি করছে দিল্লির নেতারা। দিনহাটার গ্রামের নেতার সংকট— কী দিয়ে তবে জনসমর্থন টানা যাবে? ইন্দিরা আবাসের বাড়ি, নির্মল গ্রামের শৌচাগার, রেশনের চাল, কলের জল, কিছুই যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তবে মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে কী করে? বড় মাপের নেতারা সেতু-রাস্তা-সেচ-শিল্প দিয়ে সমর্থন আদায় করেন। গ্রামের নেতার কাছে ‘ক্ষমতা’ মানে, হয় সম্পদ বণ্টনে নিয়ন্ত্রণ, নইলে হিংসার উপর নিয়ন্ত্রণ। অরুণা রায়, পিইউসিএল থেকে অণ্ণা হজারে, অধিকার আন্দোলন সম্পদ বণ্টনে গ্রামের নেতার নিয়ন্ত্রণকে ক্রমাগত খারিজ করেছে। কে বাড়ি পাবে, কে খাদ্য, কাজ পাবে, কিছুই পঞ্চায়েত নেতা ঠিক করতে পারেন না।
অধিকার আন্দোলনের দৃষ্টিতে উন্নয়নের মডেল প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের মডেল, যেখানে গ্রামবাসীর কাছে ক্রমাগত জবাবদিহি আর হিসেব দাখিল করে যেতে হবে ভোটে-জেতা নেতাকে। মিরাজুন নাহার যখন বলেন, ‘মাঠে ধান আছে, এখন একশো দিনের কাজ করাব না,’ তখন তাঁর সিদ্ধান্ত অনায়াসে খারিজ হয়ে যায়, কারণ আবেদন করার ১৫ দিনের মধ্যে কাজ পাওয়ার ‘অধিকার’ রয়েছে গ্রামবাসীর। জমির মালিক আর খেতমজুর, দুই শ্রেণির স্বার্থের কোনও একটা আপস করার অধিকার গ্রামের নেতার আছে কি না, সে প্রশ্ন কেউ করছে না।
কে-ই বা করবে? অধিকার আন্দোলন করছে নাগরিক সমাজের শহুরে মধ্যবিত্ত, তারা আগাগোড়াই গ্রামের নেতাকে মূর্খ, শঠ বলে মনে করে। আর রাজনৈতিক দলের বড় নেতারা গ্রামের নেতাদের জনসংযোগকে ভয় করেন, তাদের গ্রামেই দাবিয়ে রাখতে চান। দু’তরফেই উন্নয়নের রাশ কেড়ে নিয়ে গাড়ি ঠেলার কাজ দেওয়া হচ্ছে নেতাকে। সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় হিংসার উপর নির্ভরতা বাড়ছে গ্রামে গ্রামে। হিংসা দিয়ে রুখে দেওয়া হচ্ছে গ্রামবাসীর ভোটের অধিকার থেকে কাজ-খাদ্যের অধিকার। ‘হলে আমার ইচ্ছে মতো হবে, নইলে নয়,’ এটা প্রমাণের তাগিদ থেকে টাকা এসে ফিরে চলে যায়, উন্নয়ন হয় না।
তাই ভোটের লড়াইয়ের পর আবার শুরু হয় অধিকার আদায়ের লড়াই। সকলে মিলে রাষ্ট্রের থেকে প্রাপ্য আদায়ের লড়াইয়ে নামলে দুর্বল মানুষের মধ্যেও আত্মশক্তির স্ফূরণ হয়। তিলক বর্মন, ময়না বিবিরা যে একজোট হয়ে নিজেদের প্রাপ্য আদায় করছেন, এতে অনেকে ‘নারী জাগরণ’ দেখবেন। কিন্তু এ-ও লক্ষ করতে হবে যে ওই মেয়েরা জোতদার-জমিদারের বিরুদ্ধে লড়ছে না, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিংবা কোনও আন্তর্জাতিক কর্পোরেটের বিরুদ্ধে লড়ছে না। লড়ছে ভোটে-জেতা ননদ-ভাজ, খুড়ি-মামির বিরুদ্ধে। ময়না বিবিদের মদত দিচ্ছে বিডিও, এসপি, ডিএম। আর সংখ্যালঘু, গরিব, প্রথম-নির্বাচিত মিরাজুন নাহারের পাশে তাঁর দলের নিচুতলার কর্মীরা। এ কেমন লড়াই? কীসের লড়াই? কী উদ্দেশ্যে এই লড়াইয়ে প্রেরণা জোগাব আমরা?
অধিকার আন্দোলন আর ভোটের রাজনীতি, দু’দিক থেকেই উন্নয়নের যে ছক তৈরি হচ্ছে তাতে গ্রামের জনপ্রতিনিধির সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘাত বাধতেই থাকবে। ময়না, কণিকারা সামান্য প্রাপ্যটুকু আদায় করতে রোজ প্রাণ-মান বিপন্ন করবে, এ কেমন প্রত্যাশা? মিরাজুন বিনা প্রশ্নে ময়না-কণিকার কথা মেনে নেবে, তা-ই বা কী করে হয়? গরিব মেয়ের স্বশাসন, গরিব মেয়ের সক্ষমতা, এ দুটোর পথ যদি না মেলে, উন্নয়ন কোন পথে গ্রামে আসবে তবে? |
|
|
|
|
|