মঞ্চে কমল হাসন, অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খানের পাশাপাশি টালিগঞ্জের এক ঝাঁক তারকা। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের দর্শকাসনে অন্যদের সঙ্গে আদুর গোপালকৃষ্ণন, কান, ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মানিত পরিচালক আমোস গিতাই। কিন্তু মঞ্চের ওপর আর নীচে ফারাক এতটাই যে, আদুর বা আমোসকে এক বারও ডেকে নেওয়া হল না সেই তারকার মেলায়।
ডাকটা দিলেই ১০ নভেম্বরের কলকাতায় হতে পারত অন্য তারাবাজি। কেমন হত, যদি কোয়েল বা রাইমার পাশে বসিয়ে দেওয়া যেত আমোসকে? নাতালি পোর্টম্যানকে দুনিয়ার অন্যতম নায়িকা করে দিয়েছেন যে পরিচালক, তাঁর সঙ্গে টলি-কন্যা! কিংবা একই ফ্রেমে বাঁধা পড়তেন অমিতাভ ও আমোস! সেই ছবিই তো টুইটারে ব্লগে ছড়িয়ে যেত। দুনিয়া বলত, কলকাতাই পারে!
ছবি হতে পারত আরও! সেরা পরিচালক ও সেরা অভিনেতারা। আদুর-এর পাশে অমিতাভ, মিঠুন ও কমল হাসন। দূরে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছেন দেব, জিৎ বা সোহম। কলকাতাই পারে টালিগঞ্জের সঙ্গে মুম্বই, তিরুঅনন্তপুরম ও চেন্নাইবাসী তিন প্রবাদপুরুষকে জুড়ে দিতে। এই ছবিগুলিই তৈরি করে দিতে পারত ১৯তম আন্তর্জাতিক কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের ব্র্যান্ড-আইডেন্টিটি। বুদ্ধিমত্তা প্লাস গ্ল্যামার।
মানে, সম্পদ ছিল হাতের কাছেই, কিন্তু ঠিকঠাক পরিকল্পনা আর দূরদর্শিতার অভাবে বাঁধা গতের বাইরে যাওয়া গেল না। ভাল ছবির অভাব আগেও ছিল না, এ বারও নেই। ৯২ বছরের অ্যালা রেনে বা ইরানে গৃহবন্দি জাফর পানাহির নতুন ছবির পাশাপাশি কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ‘ব্লু ইজ দ্য ওয়র্মেস্ট কালার’। হলিউডের বিলি ওয়াইল্ডার, জাপানের নাগিসা ওসামা, ইন্দোনেশিয়ার গারিন নুগ্রহোর ছবির রেট্রোস্পেকটিভ। পানাহি বা দক্ষিণ কোরিয়ার কিম কি দুক-এর ছবি গত জমানাতেও দেখা যেত, এখনও। প্রশংসনীয় অপরিবর্তন। |
কিন্তু ছবি দেখার পরিকাঠামো? আগে পরিবেশকরা মাঝে মাঝেই ঠিক সময়ে ফিল্মের ক্যান পাঠাতে পারতেন না। বদলে যেত প্রদর্শনসূচি। এ বার অন্য সমস্যা। পাইরেসি আটকাতে নতুন প্রযুক্তিতে আর ক্যান পাঠানো হয় না। সবই হার্ড ডিস্ক। হলে বসার পর জানা গেল, ডিস্ক এসে গিয়েছে, এসে পৌঁছায়নি কেডিএম কোড। প্রযোজকের থেকে ই মেলে কোড পাওয়া গেলে তবেই ডিস্ক আনলোড করা যাবে। প্রযুক্তির কারণে কলকাতা ফিল্ম উৎসব তখনও হোঁচট খেত, এখনও।
বিভিন্ন সরকারি দফতরের সমন্বয়? সময়সূচিতে লেখা: নন্দন ৩-এ ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ শুরু দুপুর ২টোয়। বিকেল ৫টায় আদুরের একটি ছবি। সময়সূচিতে আরও লেখা, হলিউড-খ্যাত ছবিটি ২২০ মিনিটের। নির্ধারিত দিনে তাই ছবি শুরু হল দুপুর ১টায়। ছাপানো টাইমটেব্ল দেখে নন্দনে এসে বহু দর্শক তখন হতাশ। একটি দফতর সময়সূচি ছাপিয়ে দিয়েছে, অন্যরা ছবি প্রোজেকশনও করে যাচ্ছে। দুজনে কেহ কারে জানাতে নাহি পারে।
বিধাননগরের ইজেডসিসি-তে আবার টিমটিমে প্রোজেকশন। পর্দায় সাবটাইট্ল পড়তে চোখের দফারফা। উৎসবের দিন কয়েক আগে সেখানে একটি অনুষ্ঠান ছিল, কুশীলবদের পায়ের ধাক্কায় পর্দা কুঁচকে গিয়েছে। সেটি না সারিয়েই ছবি প্রদর্শন। সরকারি কর্মসংস্কৃতি সেই তিমিরেই।
নন্দন ২-এ রোজ সন্ধ্যায় নাগিসে ওসামা দেখতে গিয়ে ঠ্যাং ছিঁড়ে যাওয়ার জোগাড়। ২০০ আসনের হল, জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে অনেক দর্শক। উৎসবে ভাল ছবি থাকলে লোকে ভিড় করে কোনও ক্রমে ছবি দেখবে, স্বাভাবিক! বছর কয়েক আগে হলটি সংস্কার করা হয়েছিল, কিন্তু বদলায়নি বসার বন্দোবস্ত। অদূরদর্শিতার ট্রাডিশন, আজও।
সরকার কেন জনগণের টাকায় উৎসব করবে, স্টেডিয়ামে কেন ফিল্ম দেখানো হবে, কেনই বা আন্তর্জাতিক উৎসবে উত্তম-সুচিত্রার বস্তাপচা ছবি থাকবে, এ সব অন্য প্রশ্ন। কিন্তু উৎসবমুখরিত সপ্তাহে নন্দনচত্বরে সকলের অগোচরে লুকিয়ে থাকে অন্য সিনেমা। বাঙালির স্ব-ভাব ধরা দেয় সেই পর্দায়। |