মুখোশ ছাড়াই কাজ, নিয়ম মানার
বালাই নেই পাথর কাটার খাদানে নীলোৎপল রায়চৌধুরী • আসানসোল |
খাতায়-কলমে রয়েছে ১৩টি। আদতে চলছে তার প্রায় পাঁচ গুণ।
কয়লাঞ্চল হিসেবে পরিচিত আসানসোল-রানিগঞ্জ এলাকায় এমনই রমরমিয়ে চলছে বেআইনি পাথর খাদান। শুধু অনুমতি না থাকা নয়, কাজের ক্ষেত্রেও ওই সব খাদান কর্তৃপক্ষ কোনও নিয়মের তোয়াক্কা করেন না বলে অভিযোগ। কোথাও রাস্তা কেটে তৈরি হচ্ছে খাদান, কোথাও আবার ছিটকে আসা পাথরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঘরবাড়ি। পাথর গুঁড়ো করার সময়ে শ্রমিকদের মুখোশ দেওয়ার কথা। কিন্তু বেনিয়ম সেখানেও। ফলে, নাক-মুখ দিয়ে পাথরের গুঁড়ো, ধুলো ঢুকে রোগের কবলে পড়ছেন তাঁরা।
সম্প্রতি এই এলাকার পাথর খাদানে কাজ করতে আসা উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁর শতাধিক বাসিন্দা অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। তাঁদের মধ্যে কয়েক জনের মৃত্যু হয়। সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আরও অনেকে। পাথর খাদানগুলিতে কাজ করার সময়ে উপযুক্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকে কি না, প্রশ্ন উঠেছে এই ঘটনার পরে।
প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় থেকে বীরভূমের পাড়ুই পর্যন্ত বিশাল পাথরের স্তর রয়েছে। এর মধ্যে পড়ে আসানসোল মহকুমার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। প্রশাসনের হিসেবে, রানিগঞ্জ, বারাবনি, সালানপুর ও আসানসোলে মোট ১৩টি বৈধ খাদান রয়েছে। যদিও এলাকা ঘুরে দেখা গিয়েছে, সরকারি তালিকার বাইরেও আসানসোলের ধাদকা, গিরমিট, কালিপাহাড়ি, বারাবনির বালিয়াপুর, আমডিহা, নাদাই, ছোটকরো ছাড়াও সালানপুর, রানিগঞ্জে চলছে প্রায় ৭০টি খাদান। |
চলছে পাথর কাটার কাজ। আসানসোলের ধাদকায়। ছবি: শৈলেন সরকার। |
বারাবনির বাসিন্দাদের অভিযোগ, বালিয়াপুর থেকে চটি রানিগঞ্জ-রঘুনাথচক পর্যন্ত তিন কিলোমিটার একটি রাস্তার বেশির ভাগ অংশ চলে গিয়েছে পাথর খাদানের গর্ভে। ফলে, সাত কিলোমিটার ঘুরে যাতায়াত করতে হয় তাঁদের। একই হাল হয়েছে আমনালা থেকে আমডিহা যাওয়ার দেড় কিলোমিটার রাস্তারও। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আসানসোল শাখা জানায়, নতুন প্রযুক্তিতে পাথর টুকরো করা হলে ধুলো বা গুঁড়ো ওড়ে না। কিন্তু প্রায় কোনও খাদানেই সেই প্রযুক্তি ব্যবহার হয় না। ফলে, ক্ষতি হয় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের।
আসানসোলের এক খাদান মালিক জানান, পাথরের চাঁই কাটতে লোক আনা হয় বীরভূমের পাকুড় থেকে। যন্ত্রে পাথর গুঁড়ো করেন স্থানীয় লোকজন। কয়লা খনি অঞ্চলে পাথর খাদানে কাজ করার শ্রমিকের মাঝে-মধ্যে অভাব হয় বলে ভিন্ জেলা থেকেও লোক আনা হয়। তাঁর দাবি, পুরনো প্রযুক্তিতে পাথর গুঁড়ো করলেও শ্রমিকেরা মুখোশ পরলে রোগ আটকানো সম্ভব। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমিকেরা তা পরেন না। তবে অনেক সময়ে যে খাদান কর্তৃপক্ষ মুখোশ দেন না, তা মেনে নেন তিনি।
খাদান শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বীরভূমের একটি সংগঠনের সদস্য কুণাল দেবের অভিযোগ, “যে মানের মুখোশ দেওয়া হয়, তা পরে কাজ করা কার্যত অসম্ভব।” দিনের পর দিন মুখোশ না পরে কাজ করায় পাথর গুঁড়ো জমা হয় ফুসফুসে। জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকেন শ্রমিকেরা।
সিপিএমের অজয় জোনাল সম্পাদক মনোজ দত্ত বলেন, “অবৈধ পাথর খাদান বন্ধে কোনও দফতরই ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বৈধ খাদানের বেনিয়মও দেখা হচ্ছে না। ফল ভুগতে হচ্ছে পেটের দায়ে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের। প্রশাসনের নানা স্তরে অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয়নি।” তৃণমূলের বর্ধমান (শিল্পাঞ্চল) কার্যকরী সভাপতি ভি শিবদাসনের বক্তব্য, “নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে অবৈধ পাথর খাদান বন্ধ করা হয়েছে। প্রশাসন নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে।”
দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ জানায়, পাথর খাদানগুলিকে অনুমতি দেয় ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর। নিয়মিত পরিদর্শনের দায়িত্বও প্রশাসনের। আসানসোল মহকুমাশাসক অমিতাভ দাস বলেন, “পাথর খাদানে কোনও বেআইনি কাজ হচ্ছে কি না, তা দেখতে তদন্ত কমিটি গড়া হবে। তারা তদন্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।” |