সাবালক শহরে ভাড়ার গর্ভদাত্রীদের জন্য হস্টেলও
বরের কাগজে দু’-চারটে খুচরো বিজ্ঞাপন। ডাক্তারের চেম্বারে নীচু স্বরে কিছু কথা। কিছু ফোন। ব্যক্তিগত চেনা-জানার সূত্র ধরে এর-তার কাছে খোঁজ।
ক’দিন আগেও পশ্চিমবঙ্গে ‘সারোগেট মাদার’-এর খোঁজ-খবর চলত এ ভাবেই। গর্ভ ভাড়া দেওয়ার আইনি ছাড়পত্র সত্ত্বেও ভাড়ার গর্ভদাত্রীর সন্ধানপর্বের প্রতিটা মুহূর্ত যেন গোপনীয়তায় মোড়া থাকত। তবে হালে ছবিটা বদলেছে। জড়তা কাটিয়ে সারোগেসির পথে খানিকটা ‘সাবালক’ হওয়ার পথে হাঁটছে এ রাজ্য। কলকাতা শহরের বুকে গড়ে উঠেছে সারোগেট মাদারদের হস্টেল। সারোগেসি-র সাহায্য নিতে চাওয়া দম্পতিদের জন্য হয়েছে ক্লিনিক। ভবানীপুরের এক সারোগেসি-ক্লিনিকের কর্মীরা জানিয়েছেন, বন্ধ্যত্বের সমস্যায় ভোগা দম্পতিরা তো বটেই, গর্ভধারণে অনিচ্ছুক মহিলারাও ইদানীং ওখানে ভিড় জমাচ্ছেন। তাঁরা খোলাখুলি বলছেন, কী চান। সারোগেট মাদারের খোঁজে বিদেশি দম্পতিদের আনাগোনাও দেখতে শুরু করেছে কলকাতা।
এবং কিছু উপার্জনের তাগিদে গর্ভ ভাড়া দিচ্ছেন যে মহিলারা, তাঁদের নিয়ে লুকোছাপাও কমছে। সারোগেট মাদারদের হস্টেলই তার প্রমাণ। ভবানীপুরের সংস্থাটিরই এমন একটা হস্টেল চালু রয়েছে বেহালায়। সেখানে ১০-১৫ জন গর্ভদাত্রীর থাকার ব্যবস্থা, ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের পরবর্তী ন’মাসের জন্য। তাঁদের দেখভালের পাশাপাশি সতর্ক নজর রাখা হয়, মাঝপথে কেউ যেন অন্য কোথাও চলে যেতে না-পারেন। কী ভাবে কাজ হয় সেখানে?
সংস্থার কর্তা প্রতীপ সেন জানিয়েছেন, কোনও দম্পতি তাঁদের কাছে সারোগেসি-র ইচ্ছে নিয়ে এলে তাঁরা সেই মতো ব্যবস্থা করেন। পরবর্তী চেক-আপ থেকে শুরু করে স্ত্রীর ডিম্বাণু ও স্বামীর শুক্রাণু নিষিক্ত করে ভ্রূণ তৈরি, এবং সেটি সারোগেট মাদারের গর্ভে প্রতিস্থাপন সবটাই তাঁদের দায়িত্ব। “দম্পতি শুধু টাকাটা দেবেন। আর কোনও ঝামেলা পোহাতে হবে না। কথাবার্তা পাকা হওয়ার পরে আইনজীবীর উপস্থিতিতে চুক্তি সই হবে।” বলেন সংস্থার এক কর্মী। তিনি জানাচ্ছেন, সিজার হওয়ার পরে সারোগেট মা যখন অজ্ঞান থাকেন, বাচ্চাকে তখনই দম্পতির হাতে তুলে দেওয়া হয়।
অন্য দম্পতির সন্তানধারণের জন্য স্বেচ্ছায় নিজের গর্ভ ভাড়া দেওয়ার এই পদ্ধতি (সারোগেসি) ২০০২ সাল থেকে ভারতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বলবৎ হয়েছে। এক দশকের মধ্যে গোটা বিশ্বের ‘সারোগেসি রাজধানী’ হয়ে উঠছে ভারত। সরকারি সূত্রের খবর, এখানে প্রক্রিয়াটা যে হেতু সরল, পাশাপাশি তুলনায় কম খরচে সব হয়ে যায়, তাই ফি বছর বিস্তর বিদেশি দম্পতিও সারোগেট মাদারের খোঁজে ভারতে আসেন। সারোগেসি-ব্যবসার নিরিখে দেশের সবচেয়ে অগ্রণী রাজ্যটি হল গুজরাত। ডাক্তার নয়না পটেলের সারোগেসি ক্লিনিকের দৌলতে সেখানে ‘মেডিক্যাল ট্যুরিজম’ কী ভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠছে, ক’দিন আগে নয়না নিজে কলকাতায় এসে শুনিয়ে গিয়েছেন তার বৃত্তান্ত। কী রকম?
নয়না জানিয়েছেন, গর্ভ ভাড়া দিতে ইচ্ছুক মেয়েদের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আনন্দ-এ তাঁর ক্লিনিকে আনা হয়। আগে অবশ্য প্রত্যেকের যথাযথ কাউন্সেলিং হয়, জটিলতা এড়াতে নেওয়া হয় স্বামীর অনুমতি। আনন্দ-এ সারোগেট মাদারদের বিশাল হস্টেল। সেখানে প্রত্যেকের ছবি ও জীবনপঞ্জি দেওয়া ক্যাটালগ মজুত, যা যাচাই করে ইচ্ছুক দম্পতিরা অনাগত সন্তানের জন্য পছন্দের ‘গর্ভদাত্রী মা’ বেছে নিতে পারেন। নয়না পটেলের উদ্যোগে ওই কেন্দ্রে ২৯টি দেশের দম্পতিদের পাঁচ শতাধিক শিশুর জন্ম হয়েছে। গুজরাত সরকারও উদ্যোগটিতে নানা ভাবে সহায়তা করছে।
ঘটনা হল, বিপুল বাণিজ্যিক সম্ভাবনা থাকলেও কলকাতার স্ত্রী-রোগ চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ সারোগেসি সম্পর্কে এখনও তেমন আগ্রহী নন। কেন?
কারণ ওঁরা মনে করছেন, সন্তান জন্মের বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে সারোগেসি ততটা জরুরি নয়। এমনকী, বন্ধ্যত্বের সমস্যা রয়েছে, এমন ১০০ জনের মধ্যে মাত্র এক জনের সারোগেসির প্রয়োজন পড়ে বলে এই মহলের দাবি। উপরন্তু সারোগেসির রমরমায় কিছুটা আশঙ্কার ছায়াও দেখছেন অনেকে। যেমন স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক গৌতম খাস্তগীরের কথায়, “বন্ধ্যত্বের কারণে পন্থাটি বেছে নিলে আপত্তির কিছু থাকে না। তবে ইদানীং বহু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, নিজেদের ব্যস্ততা কিংবা শারীরিক গঠন নষ্ট হওয়ার ভয়ে অনেকে সারোগেসি-র রাস্তা ধরছেন। এই প্রবণতা উদ্বেগের।”
কিন্তু এমন একাধিক পরিস্থিতি তো রয়েছে, যেখানে সারোগেসি ছাড়া সন্তান পাওয়া সম্ভব নয়! তখন?
স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ডাক্তার হিসেবে আমি সারোগেট মাদারের ব্যাপারটায় খুব একটা উৎসাহ দিই না। আমাদের যা আর্থ-সামাজিক পরিবেশ, তাতে দত্তক নেওয়া সব দিক দিয়ে ভাল। তা ছাড়া সারোগেসির সাফল্যও তো একশো শতাংশ নয়! আইভিএফ পদ্ধতির মতো এখানেও সাফল্যের হার ২৫%-৩০%। কারণ, প্রক্রিয়াটা সেই একই।”
তাই সারোগেসি ব্যর্থ হলে আর্থিক ক্ষতিরও প্রভূত সম্ভাবনা থেকে যায় বলে অভিনিবেশবাবুর অভিমত। তবে আর্থিক লাভ-লোকসানের কথা মাথায় না-রেখে কোনও দম্পতি যদি সন্তানের ‘বায়োলজিক্যাল’ বাবা-মা হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন, তাঁদের সারোগেসির পথে যাওয়া স্বাভাবিক বলে চিকিৎসকেরা মেনে নিচ্ছেন। উপরন্তু তাঁরা জানিয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে সারোগেসি ছাড়া সন্তানলাভের অন্য কোনও রাস্তা খোলাই থাকে না। সেগুলো কী?
যেমন, জরায়ুতে যক্ষ্মার কারণে অনেকের জরায়ুর দেওয়াল নষ্ট হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে সারোগেসি-ই সন্তানলাভের একমাত্র উপায়। যাঁরা জরায়ু ছাড়া জন্মান, অথবা কোনও অস্ত্রোপচারের কারণে কারও জরায়ু বাদ গেলে তাঁদের সামনেও সারোগেসির বিকল্প থাকছে না। আবার কারও কারও জরায়ুতে এক ধরনের জটিল অসুখ (অ্যাডিনোমায়োসিস) হয়, যার জেরে রক্ত জমে জরায়ুর দেওয়াল মোটা হয়ে যায়। তাঁদের ক্ষেত্রে একই ব্যাপার। নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া যাঁদের বার বার গর্ভপাত হয়ে যায়, সারোগেসি তাঁদেরও মুশকিল আসান হয়ে উঠতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
গুজরাত সরকার যেখানে সারোগেসি-বাণিজ্যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কী করছে?
রাজ্যে স্বাস্থ্য দফতর সারোগেসি নিয়ে বিশেষ উৎসাহী নয়। স্বাস্থ্য-প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেছেন, এ নিয়ে তাঁরা এই মুহূর্তে কোনও কিছু ভাবনা-চিন্তাও করছেন না। কেন?
স্বাস্থ্য-কর্তাদের বড় অংশের বক্তব্য, এখনও পর্যন্ত ভারতে সারোগেসি সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন বা নীতি-নির্দেশিকা তৈরি কিন্তু তা ঠিকঠাক মানা হচ্ছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা নেই। ফলে সারোগেসি ঘিরে অসাধু ব্যবসা বা সারোগেট মাদারদের প্রতারণার ঝুঁকি ষোলো আনা থেকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-আধিকারিকেরা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.