চিনের প্রতি চাহিয়া গোটা দুনিয়ার বিস্ময়ের সীমা নাই। বিশেষত, প্রতিবেশী ভারতের। ছয় দশক আগে প্রায় একই সময়ে নূতন পথে যাত্রা শুরু করিয়া এবং প্রথম তিন দশক উন্নয়নের দৌড়ে ভারতের সমপর্যায়ে, বস্তুত অনেক মাপকাঠিতে পিছনে থাকিয়া গত দুই দশকে চিন এমন এক গতিতে বিনিয়োগ, উৎপাদন ও আয় বাড়াইয়াছে যে, নেহরু আজ জীবিত থাকিলে উত্তরাস্য হইয়া রবার্ট ফ্রস্ট আবৃত্তি করিতেন: ঘুমাইবার আগে অনেক পথ চলা বাকি। সেই কারণেই বেজিংয়ে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সদ্য সমাপ্ত সম্মেলন দিল্লির মুখে সামান্য হাসি ফুটাইতে পারে। আগেই জানা ছিল, বার্ষিক দশ শতাংশ বা ততোধিক হারে আয়বৃদ্ধির রথ শ্লথ হইতেছে। কিন্তু অষ্টাদশ পার্টি কংগ্রেসের তৃতীয় প্লেনাম জানাইয়া দিল, এই গতিভঙ্গ সাময়িক সমস্যা নহে, পার্টির নায়করা চিন্তিত। ভারত অবশ্য আরও অনেক নীচে। চিন যদি দশ হইতে সাত শতাংশে নামে, ভারত তবে আট হইতে পাঁচে। তথাপি, প্রতিবেশীর উদ্বেগ, আপনার সুখ।
কেন চিনের এই গতিভঙ্গ? একটি কারণ চাহিদার সংকট। এ যাবৎ চিনের আয়বৃদ্ধির পিছনে বিশ্ববাজারে তাহার পণ্যের বিপুল চাহিদার বড় ভূমিকা ছিল। অধুনা সেই বাজার মন্দাক্রান্ত, সুতরাং চিনের রফতানি মার খাইয়াছে। কিন্তু দেশের নিজস্ব চাহিদা? সেখানেই সমস্যার দ্বিতীয় কারণ। সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের হার অস্বাভাবিক বেশি রাখিবার নীতি ভোগব্যয়কে যথেষ্ট বাড়িতে দেয় নাই, চিনের আয়বৃদ্ধির তুলনায় অভ্যন্তরীণ বাজার সীমিত, দুর্বল। আজ যখন বাহিরের বাজারে ধস নামিয়াছে, তখন ঘরের বাজার শূন্যস্থান পূরণে অসমর্থ। তৃতীয় এবং গভীরতম সমস্যা: বিনিয়োগ বাড়িয়াছে, কিন্তু তাহার উৎপাদনশীলতা যথেষ্ট বাড়ে নাই। তাহার প্রধান কারণ দুইটি। এক দিকে, অপটু সরকারি শিল্পবাণিজ্য সংস্থার আধিপত্য এখনও প্রবল; অন্য দিকে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মজুরি ও বেতন বাড়িতেছে, ফলে উৎপাদন-ব্যয় বাড়িতেছে, ‘সস্তা’ চিনা পণ্যের সুবিধা ক্রমশই কমিতেছে। সমস্যা মৌলিক। সামাল না দিলে তাহা সংকটের রূপ লইতে পারে।
অতএব, পার্টির সিদ্ধান্ত: বেসরকারি শিল্পসংস্থার গুরুত্ব বাড়িবে, সরকারি সংস্থা অর্থনীতির ‘কেন্দ্রে’ই অধিষ্ঠিত থাকিবে, কিন্তু তাহাদের বেসরকারি উদ্যোগের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে হইবে। ব্যাঙ্ক ব্যবস্থায় ও ঋণের বাজারে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কমিবে। উদ্দেশ্য: ঋণ সুলভ করিয়া চাহিদা বাড়ানো। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তৈয়ারি ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’র সোনার পাথরবাটিতে সোনার ভাগ আরও কিছুটা বাড়ানো হইতেছে। তবে পার্টি নামক জগদ্দল পাথরটি কিছুমাত্র সরিবে, এমন ভরসা নাই। ‘শ্রম শিবির’ নামক কারাগারের কারখানা বন্ধ করিবার সিদ্ধান্তটি পশ্চিম দুনিয়ার মানবাধিকার সংক্রান্ত চাপ মোকাবিলার কূটনৈতিক চাল মাত্র, এই কারখানাগুলির অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক দিনই কমিয়া গিয়াছে। ‘এক সন্তান নীতি’ অংশত শিথিল করিবার সিদ্ধান্তও কোনও উদার মানবিক নীতি নয়, দেশে প্রবীণের তুলনায় নবীনের সংখ্যা বাড়াইবার এবং ভোগব্যয়ে উৎসাহ দিবার পাটোয়ারি বুদ্ধি। উন্নয়নই দেশের মানুষের মনে গণতন্ত্রের চাহিদা সৃষ্টি করিবে, সেই চাহিদা মিটাইতে চিনের নায়করা উদার রাজনীতির পথে হাঁটিতে বাধ্য হইবেন এমন আশার বাণী তিন দশক ধরিয়া শোনা যাইতেছে। ইতিমধ্যে শতাব্দী পালটাইয়া গিয়াছে, কিন্তু তিয়ানানমেন স্কোয়ার হইতে বো জিলাই পার্টি সত্য, কারণ তাহা সর্বশক্তিমান। গণতন্ত্র নহে, বেজিংয়ের চিন্তার কারণ একটিই: অর্থনীতি। চিন মধ্য-আয়ের দেশে উন্নীত। অনেক দেশই এই মাঝারিয়ানার ফাঁদে পড়িয়াছে। চিন কি তাহা অতিক্রম করিয়া প্রকৃত অর্থনৈতিক মহাশক্তি হইতে পারিবে? পার্টি যন্ত্রী, বাজার যন্ত্র বন্দোবস্তটি এত দিন দিব্য কাজ করিয়াছে। কিন্তু মধ্যাহ্ন দেখিয়া সর্বদা অপরাহ্ণ চেনা যায় না। |