আপনি জানেন কি পশ্চিমের পর পূর্বেও শিল্প করিডর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মনমোহন সিংহের সরকার? অমৃতসর থেকে কলকাতা পর্যন্ত? শুনে দু’সেকেন্ড চুপ রইলেন জাপানের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী মিনোরু কিউচি। তার পর বললেন, “কলকাতা? আমি তো কলকাতা যাচ্ছি।”
কবে যাচ্ছেন? খোলামেলা কিউচি জানালেন, “এ বছরের শেষে বা সামনে বছরের শুরুতে।” পশ্চিমবঙ্গ সরকার কি নিমন্ত্রণ করেছে? নাকি নয়াদিল্লি চাইছে, এ বার আপনারা একটু পুবেও তাকান? জবাবে কিউচি যা জানালেন তাতে স্পষ্ট, স্বার্থটি বিশুদ্ধ জাপানের। এবং তার সুদূরপ্রভাবী সুফল পেতে পারে কলকাতা, হলদিয়া-সহ পশ্চিমবঙ্গের এবং পূর্বাঞ্চলের বেশ কিছু শিল্পনগরী। সেই সঙ্গে পূর্বে বন্দর থেকে শিল্প করিডর নির্মাণে জাপানের আর্থিক বিনিয়োগের সম্ভাবনার একটা দরজাও খুলে যেতে পারে অচিরে।
কী ভাবে? কিউচি জানালেন, “আপনাদের হলদিয়ায় বড় জাপানি বিনিয়োগ (মিৎসুবিশি) রয়েছে। গত বার যখন দিল্লি গিয়েছিলাম, তখন মিৎসুবিশি কর্তারা বারবার করে অনুরোধ করেছেন কলকাতায় যেতে।” মিৎসুবিশি কর্তারা কেন তাঁকে ডাকছেন, তা-ও জানালেন মিনোরু কিউচি। বললেন, সংস্থার কর্তারা জানিয়েছেন, হলদিয়ায় বন্দরের সুবিধে তাঁদের রয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে দেশের অন্যত্র তথা সামগ্রিক ভাবে পূর্বাঞ্চলে ‘রোড নেটওয়ার্ক’ খুবই খারাপ। ফলে সেখানে পরিকাঠামো নির্মাণে জাপান যদি বিনিয়োগ করে, তা হলে পশ্চিমবঙ্গ সহ পূর্বাঞ্চলে জাপানি বিনিয়োগের সুযোগ বাড়তে পারে।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, ইতিমধ্যেই হলদিয়া, হাওড়া এবং আসানসোলে পরিবেশ সংক্রান্ত মোরাটোরিয়াম তুলে নিয়েছে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। যার অর্থ, হলদিয়ায় এ বার নতুন শিল্প স্থাপনের ফের সুযোগ তৈরি হয়েছে। হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের দাবি, এর ফলে দশ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আসতে পারে। মিনোরু কিউচি সে কথা শুনে বললেন, “হলদিয়ায় মিৎসুবিশির অভিজ্ঞতা ভালো।”
হলদিয়ায় মিৎসুবিশির পত্তন হয়েছে প্রায় দেড় দশক হতে চলল। কলকাতা ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোতেও আর্থিক সহযোগিতা করছে ‘জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি’ (জাইকা)। জাপানের অর্থনীতি, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রকের অধীনে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার বাণিজ্য নীতি সংক্রান্ত বিভাগের ডিরেক্টর মিকিও আওকি জানালেন, “কলকাতা ও তার সংলগ্ন এলাকায় ডিআইসি, কুবোতা, হিতাচি কনস্ট্রাকশন মেশিনারি এবং মিৎসুবিশি ভালই ব্যবসা করছে। তবে মুশকিল হল, এই এলাকা এখনও অনুন্নত এবং গরিব মানুষের সংখ্যা বেশি। শিল্পোন্নয়নের গতি মন্থর। কিন্তু পরিকাঠামোর উন্নয়ন করা গেলে এই এলাকার ভবিষ্যৎ রয়েছে।” জাপানি কতৃপক্ষ এ-ও মনে করেন, হরিয়ানা বা গুজরাতের থেকে পূর্বে দক্ষ শ্রমিক কম ঠিকই, কিন্তু তাঁদের মজুরি কম। ব্যবহারও ভালো।
তবে প্রকাশ্যে না বললেও পশ্চিমবঙ্গ তথা সামগ্রিক পূর্বাঞ্চল নিয়ে জাপানের মূল উদ্বেগের বিষয় এখনও জমি অধিগ্রহণ।
এর পাল্টা যুক্তি যদিও দিচ্ছেন এশিয়া উন্নয়ন ব্যাঙ্কের এক কর্তা। টোকিও স্থিত ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এক কর্তার মতও তা-ই। তিনি জানালেন, পূর্বে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে ঠিকই। এক লপ্তে সেখানে বিপুল পরিমাণ জমি পাওয়াও মুশকিল। কিন্তু সে ক্ষেত্রে মাঝারি শিল্পে লগ্নির সুযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে টোকিওয় ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির তরফে জাপানি শিল্পপতিদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে। এডিবি কর্তার মতে, পশ্চিমবঙ্গের সাগরে এবং অন্ধ্রের বিশাখাপত্তনমে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। স্বভাবতই তাতে বিদেশি লগ্নি আহ্বান করা হবে। জাপানি কর্তাদের মতে, বন্দর তৈরির পাশাপাশি পূর্বে পরিকাঠামো বাড়ানো গেলে এমনিতেই বিনিয়োগ আসবে।
জাপানের শিল্পপতিরাও খবর রাখেন যে, উত্তর-পূর্বের সঙ্গে মায়ানমারের সড়ক-যোগাযোগ গড়তে দিল্লি সচেষ্ট। আজ না হোক কাল, বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করিডর আরও প্রসারিত হবে। ফলে পূর্বাঞ্চলে শিল্পস্থাপন মানে বাংলাদেশ, মায়ানমারের বাজারকেও পেয়ে যাওয়া। বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক স্তরে ভাবনা-চিন্তা চলছে বলে জানিয়েছেন জাপানের বিদেশ মন্ত্রকের দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়া সংক্রান্ত বিভাগের ডিরেক্টর মাতসুদা।
চলতি মাসের শেষ দিকে জাপানের সম্রাট আখিহিতো-র ভারত সফরে আসার কথা। ৬০ বছর পরে জাপানের কোনও সম্রাটের এই ভারত সফরের আলাদা তাৎপর্য রয়েছে বলে মনে করছেন এ দেশের সরকারি কর্তারা। সম্রাটের সফরের পরেই কলকাতা যাওয়ার দিনক্ষণ স্থির করবেন বিদেশ প্রতিমন্ত্রী মিনোরু কিউচি। |