বর্ষায় এক বছরে সাঁকো ভেঙেছে দশ বার। নাব্যতার সমস্যায় পাড়ে পৌঁছয় না নৌকা। ফলে, কোমর সমান জল পেরিয়েই নিত্য যাতায়াত করতে হচ্ছে বর্ধমান ও বীরভূম জেলার কয়েক হাজার মানুষকে। অজয় পেরিয়ে বীরভূমের জয়দেব ঘাট ও বর্ধমানের কাঁকসায় কৃষ্ণপুর এলাকার মধ্যে যাতায়াত করতে জলে নামা ছাড়া উপায় নেই তাঁদের। সমস্যা থেকে রেহাই পেতে অনেক দিন ধরেই পাকা সেতুর দাবি জানিয়ে আসছেন বাসিন্দারা। তবে সেই দাবি এখনও মেটেনি।
ভোরে কাঁকসার শিবপুর পঞ্চায়েতের এই কৃষ্ণপুর এলাকার ঘাটে গেলে দেখা যায়, উল্টো পাড়ে হালকা কুয়াশার মধ্যে হেঁটে আসছেন বেশ কিছু লোকজন। নদীর মাঝখানে একটি নৌকা দাঁড়িয়ে। কোমর সমান জল পেরিয়ে এসে সেই নৌকায় উঠলেন অনেকে। পাশে পড়ে রয়েছে ভাঙা সাঁকো। যাত্রী তুলে চালু হল মোটর চালিত নৌকা। খুব বেশি হলে দেড়শো ফুট চলার পরে ফের সেটি থেমে গেল। আবার কোমর সমান জলে নেমে হেঁটে এসে এ পাড়ে উঠলেন যাত্রীরা। কেউ পাড়ে পৌঁছে ভিজে পোশাক পাল্টে নিলেন, কেউ আবার সেই পোশাকেই সাইকেল চেপে চলে রওনা দিলেন গন্তব্যে। সকলের নৌকায় জায়গা হয় না। অপেক্ষা না করে অনেকে এক বুক জল হেঁটেই পারাপার করেন। সঙ্গে সাইকেল থাকলে তা মাথার উপরে তুলেই যাতায়াত করতে হয় তাঁদের। |
সাইকেল মাথার উপরে তুলেই অজয় পার। —নিজস্ব চিত্র। |
বীরভূম থেকে এই ঘাট পেরিয়ে দুর্গাপুর ও আশপাশের এলাকায় প্রায় প্রতি দিনই নানা রকম কাজে আসেন গড়ে হাজার তিনেক মানুষ। ফেরা চালানোর বরাত পেতে দরপত্র ডাকে বীরভূমের জয়দেব পঞ্চায়েত। তিন বছরের জন্য সেই দরপত্র পেয়েছেন তাপস গড়াই। নৌকা চালানোর পাশাপাশি তিনি বাঁশের সাঁকোও বানান। তিনি বলেন, “এ বছর দশ বার বাঁশের সেতু ভেঙে গিয়েছে। আট বার ৪০০ ফুট ও দু’বার ৬০০ ফুটের সেতু তৈরি করেছিলাম। আর এক বার তৈরি করব।” নৌকা চালান মোট ন’জন মাঝি। ভোর ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খেয়া পারাপার করেন তাঁরা।
সম্প্রতি বীরভূমের মুরারইয়ের খানপুর থেকে প্রায় ৩০টি পরিবার কাঁকসার নানা ইটভাটায় কাজ করতে এসেছিল। ওই সব পরিবারের সদস্যেরা জানান, আসার সময়ে রাতে যখন খেয়াঘাটে পৌঁছন, নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কোনও রকমে জয়দেব মন্দিরের আশপাশে রাত কাটাতে হয়। সকালে ফেরি শুরু হলে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে জলে নেমে মাঝ নদীতে গিয়ে নৌকা ধরতে হয়। মেরিনা বিবি, অঞ্জলি মালেরা বলেন, “খুব কষ্টে পেরোতে হল।” সিউড়িতে বীরভূম মহাবিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিলেন বর্ধমানের বিদবিহার পঞ্চায়েতের বিনোদপুরের দুই ছাত্র প্রাণকৃষ্ণ গোস্বামী ও চন্দন পাল। ঘাটে এসে জামা-জুতো খুলে রেখেই জলে নামতে হল তাঁদের। অন্ডালের উখড়ার ষষ্ঠীপদ রক্ষিত নিয়মিত জয়দেব আশ্রমে যাতায়ত করেন। তাঁর কথায়, “অনেক দিন ধরে শুনছি, পাকা সেতু হবে। এক বার মাপজোক হয়েছিল বটে, কিন্তু তার পরে আর কিছু হয়নি।”
বীরভূমের জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি অন্নপূর্ণা মখোপাধ্যায় জানান, ২০০৯ সালে তৎকালীল ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী এলাকায় এলে বাসিন্দারা পাকা সেতু তৈরির দাবি জানিয়েছিলেন। তখন ঠিক হয়েছিল, বীরভূম জেলা পরিষদ অর্থ বরাদ্দ করবে। সেতুর জন্য পূর্ত দফতরের (রাস্তা) কাছে আবেদন করা হয়। পূর্ত দফতর পরিকল্পনা করে রাজ্যের কাছে প্রস্তাব পাঠায়। পূর্ত দফতর সূত্রে জানা যায়, তা এখনও বিবেচনাধীন। প্রাথমিক সমীক্ষা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বীরভূমের সিপিএম সাংসদ রামচন্দ্র ডোম বলেন, “সেতু তৈরির উদ্যোগ হয়েছিল। তার পরে রাজ্যে সরকার পরিবর্তন হল। এই সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।” জেলা পরিষদের স্থানীয় সদস্য জাফিরুল ইসলাম বলেন, “দল ও বাসিন্দাদের তরফে বারবার সেতুর দাবি করা হয়েছে।” তৃণমূলের বীরভূম জেলা চেয়ারম্যান আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্বাস, “পূর্ত দফতর কী করেছে, খোঁজ নিয়ে দেখব। পূর্তমন্ত্রী সঙ্গেও কথা বলব।” |