|
|
|
|
শেষটা আঁচ করা যায়
অনেক এগিয়ে রইল ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’। লিখছেন সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়। |
এখন অবশ্য ইন্টারভ্যাল বলে লোকে। আগে বলা হত হাফটাইম। হাফটাইমে দর্শক সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে বিজলী গ্রিলের আইসক্রিম সোডা কিনে খেত। সঙ্গে চিনেবাদাম বা ঝালমুড়ি।
আছে এটাও আছে অনীক দত্তর ছবি ‘আশ্চর্য প্রদীপ’য়ে।
‘বেড়ানো বলতে পুরী
খাওয়া বলতে ঝালমুড়ি’
বাঙালি মধ্যবিত্তের একেবারে গোড়ার কথা বলা হয়েছে ছবির গোড়ায়। এ ভাবেই। হাফটাইম অবধি সেই রকম অজস্র ডায়লগের ঢেঁকিতে বসিয়ে দর্শককে বেসামাল করে দিয়েছেন অনীক অনেক বার। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি অনীক দত্তের বায়োস্কোপের চিত্রনাট্য, বলা বাহুল্য সারাক্ষণ এই একবিংশ শতকের মধ্যবিত্ত বাঙালির দ্রুত পরিবর্তনশীল মূল্যবোধকে কোপ মারার কোনও স্কোপই ছাড়েনি! আর ওই যে, যখন কিচেন ছিল রান্নাঘর, পারফিউম ছিল সেন্ট, লোন নিয়ে গাড়ি কেনার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারত না, রাজারহাট বা বাইপাসে হাইটেক সিটিগুলো গজায়নি, বহু মানুষ প্যালারাম মিত্তির লেন কিংবা বেচুু দত্ত লেনে জন্মেছে আর অম্লান বদনে মরে গেছে। যেখানে ‘ভোগ’ শব্দটাকে খারাপ পাড়ার মতো এড়িয়ে গেছে বঙ্গসন্তান সেই সময় তার সঙ্গে ব্র্যান্ডেড পোশাক পরা, বিদেশি গাড়ি চড়া, স্কচ খাওয়া, মাল্টিস্টোরিডে থাকা এই সময়ের বাঙালির মানসিকতার সংঘাত তাই নিজস্ব মুন্সিয়ানার সঙ্গে, এক রকম খুনসুটির বিষয় ছবির প্রতিপাদ্য হিসেবে তুলে ধরেছেন ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ খ্যাত পরিচালক অনীক দত্ত। |
|
আরও আরও আরও গড্ডলিকার স্রোতে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে একটা সমাজ। এই তলিয়ে যাওয়াই এখন আমাদের নিয়তি। মুক্ত অর্থনীতির ফলাফলে একটা হ্যাংলা দেশ, একটা হ্যাংলা জাতির এই পরিণতি
হওয়ার ছিল। এই অবক্ষয় একদিন ইতিহাসের গবেষণার বিষয় হয়ে উঠবে। ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ যেন তারই এক দলিল। আর যেহেতু অনীক দত্ত সেই দলিল নির্মাণ করেছেন তাই তাতে “আমি স্নব, তুমি বৈষ্ণব’, ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও/আমি নিজেই নিজের ভাত মাখতে শিখেছি’ থেকে শুরু করে ‘আছে আছে আমারও বাড়িতে মা-বোন আছে’, কিংবা পুজোর থিমে বনলতা সেন, ইন্ডিয়ান আইডল ফর আমেরিকান, ব্ল্যাকবেরি- কালোজাম ইত্যাদির মতো অসংখ্য বাক্যালাপ ঠাসা আছে এই ছবিতে। এমনকী বাড়ি গাড়ির জন্য মরিয়া
হয়ে ওঠা নায়িকা এও বলেছে, “ আমাদের ভবিষ্যৎ কে দেখে ঠিক নেই। আবার ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ দেখছে!” যা ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’কে মনে পড়ায় ঠিকই। বোঝা যায় কে এই ছবির পরিচালক। পাঠক কান পাতলে শুনতে পাবেন, ছেলেরা আজকাল ন্যাকা মেয়েদের কদলীবালা বলে ডাকে। আড়ালে বা প্রকাশ্যে। অনীক দত্তের এই দ্বিতীয় ছবি নিয়ে কৌতূহল
মুম্বই বেঙ্গালুরু থেকে ভেসে আসছে শুনে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কৌতূহলের ধরনটা অবশ্য এই রকম কেমন হল ছবিটা? ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’য়ের মতো?
আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্রে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ নিপাতনে সিদ্ধ ছবি। একটা মাইলস্টোন। কিন্তু ‘আশ্চর্য প্রদীপ’কে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’য়ের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিচার করাই যথেষ্ট নয়। বিষয় হিসেবে ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ অনেক জোরালো। এ এমন এক বিষয় নিয়ে তৈরি ছবি, যে- বিষয় আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনকে আজ প্রতি মুহূর্তে কুরে কুরে খাচ্ছে। ভোগবাদ আমাদের গ্রাস করে নিয়েছে সম্পূর্ণত। আমাদের সমস্ত আবেগ তুচ্ছ হয়ে গিয়েছে তার সামনে। আমাদের শিক্ষাদীক্ষা, জানাশোনা সব অর্থহীন হয়ে গেছে। এবং ফেরার পথ নেই বললেই চলে সেই মৌরি ভেজানো জলের মতো দিনগুলোয় আজ আর। তাই যতই সরস হোক না কেন পরিবেশনায় বিষয়ের ভার শেষ অবধি মনকে ভারাক্রান্তই করে তোলে। যদিও হাসিঠাট্টার বারুদ ঠাসা ছবি হওয়া সত্বেও এটা বলতেই হবে যে ছবির ক্লাইম্যাক্স কিন্তু দর্শক মোটামুটি আন্দাজ করে নিতে পারেন প্রায় ছবির প্রথমার্ধ থেকেই। আর ক্লাইম্যাক্স পার করে ছবিতে যেখানে বোধের অভিযোজন ঘটেছে সেখানেও যেন কেমন নেতিয়ে পড়ে ছবি।
ছবিতে লিমুজিনের ভেতরের দৃশ্যপট কিংবা ডুপ্লে অ্যাপার্টমেন্ট পরিদর্শন এই দুটো দৃশ্যই বড় প্রলম্বিত।
দর্শক-মন এক বারের জন্য ফিরতে চায় বেচু দত্ত লেনে। কিন্তু পরিচালক সেই সুযোগ দর্শককে দেন না। অথচ এই ইনভলভমেন্টটাই ছবির সার্থকতার অন্যতম প্রমাণ।
ছবির দৃশ্যায়ন, কালার স্কিম, সেট, আবহসঙ্গীতের দিক থেকে ভাবলে সবাই বাহবা কুড়োনোর মতো কাজ করেছেন। শাশ্বত অসামান্য তো নিশ্চয়ই, কিন্তু সেই সঙ্গে রজতাভ দত্ত, শ্রীলেখা মিত্র, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়দের অভিনয় দেখতে দেখতে এটাই মনে হয় যে এঁরা প্রত্যেকে একটা ছবিকে একার অভিনয় দিয়েই টেনে নিয়ে যেতে পারেন, শিল্পী হিসেবে এতই শক্তিশালী।
তা সত্ত্বেও যতটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল অনীক দত্তের ছবিকে ঘিরে তত দূর সফল যে তিনি হতে পারলেন না ‘আশ্চর্য প্রদীপ’য়ে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। একজন পরিচালকের প্রতিটা ছবি যে বক্স অফিস হিট হবে বা সমালোচকদের উচ্ছ্বসিত করবে এমনটা সব সময় নাই হতে পারে। ‘আশ্চর্য প্রদীপ’য়ে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’য়ের ছায়াপাত ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু চমৎকারিত্বে ,অভিনবত্বে এ ছবি ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’য়ের অনেক পেছনে। এখন অনীক দত্তকে নিজেকে বিনির্মাণ করতেই পরের ছবিগুলোর ক্ষেত্রে হয়তো আরও অন্যতর মালমশলার আমদানি করতে হবে। তবেই তৈরি হবে একেবারে নতুন এক অনীক দত্তের বায়োস্কোপ। |
|
|
|
|
|