সোমবার সকালে মারা গিয়েছেন দু’জন। গত সাত দিনে মৃত্যু হয়েছে সাত জনের। মৃতদের বয়স ১৮ বছর থেকে ২৮ বছর। হাসপাতালে ভর্তি নয় জন। অসুস্থ আরও ১০৩। গ্রামবাসীর দাবি, এদের সকলেরই রোগ সিলিকোসিস। আসানসোলের পাথর খাদান থেকে ওই রোগ নিয়ে উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁয় ফেরেন ওঁরা। ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিকের দাবি, ওই রোগীদের যক্ষ্মা হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে যক্ষ্মার ওষুধ ঠিক মতো না খাওয়ার জন্য। কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে কিন্তু ওঁদের মধ্যে একজনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে ডেথ সার্টিফিকেট-এ বলা হয়েছে, ‘সিলিকো-টিউবারকিউলোসিস’ জনিত শ্বাস নেওয়ার অক্ষমতা।
সিলিকোসিস রোগটি নিয়ে স্বাস্থ্য আন্দোলন কর্মীদের সঙ্গে সরকারের চাপান-উতোর দীর্ঘ দিনের। পাথরের গুঁড়োয় থাকে সিলিকাচূর্ণ। পাথর খাদানে কাজ করার সময়ে সিলিকা নিশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে গিয়ে জমা হয়। ফুসফুস থেকে অক্সিজেন রক্তে মিলে যাওয়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। শুরু হয় শ্বাসকষ্ট, কাশি, জ্বর। বিনা চিকিৎসায় দীর্ঘদিন চলতে থাকলে পরিণতি মৃত্যু।
রাজ্যের পাথর খাদানগুলিতে দীর্ঘ দিন ধরে এই রোগের প্রকোপে ভুগছেন শ্রমিকরা। কিন্তু অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সিলিকোসিস নির্ণয় করা, বা সরকারকে জানানোর নিয়ম মানা হয় না, অভিযোগ করেন নাগরিক মঞ্চের নব দত্ত। “শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া, পূর্ণ বেতন এবং বিনা খরচে চিকিৎসা দায় এড়াতেই সিলিকোসিসকে যক্ষ্মা বলে চালান অনেকে,” অভিযোগ করেন ইএসআই হাসপাতালের চিকিৎসক কুণাল দত্ত।
মিনাখাঁতে গ্রামবাসীদের পরপর মৃত্যুর জেরে আবার সেই অভিযোগই উঠল। সোমবারই মিনাখাঁর ধুতুরদহ পঞ্চায়েতের গোয়ালদহ গ্রামে আলামিন মোল্লা (২০) ও আজগার মোল্লা (১৮) নামে দু’জনের মৃত্যু হয়। প্রবল শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা হচ্ছিল তাঁদের। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, দিন কয়েক আগে একই উপসর্গ নিয়ে মারা যান আজগারের দাদা হোসেন মোল্লা (২০), মোজাফ্ফর মোল্লা (২০) ও মনিরুল মোল্লা (২০)। পাশের দেবীতলা গ্রামে ভীষ্ম মণ্ডল (২৮) ও ভবেশ সর্দার (২২) নামেও দু’জনের মৃত্যু হয়েছে।
তাঁদের রোগটা কী? কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দেখানো হয়েছিল মোজাফ্ফর মোল্লাকে। আউটডোরের কাগজে ‘সিলিকোসিস’ কথাটি লিখে পাশে জিজ্ঞাসার চিহ্ন আঁকা হয়েছে। রোগী যে কাজ করতেন পাথর খাদানে, তাও লিখেছেন ডাক্তারবাবু। কিন্তু মিনাখাঁ ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক রাজু মণ্ডল দাবি করেছেন, “প্রাথমিক ভাবে আমাদের অনুমান, অধিকাংশেরই যক্ষ্মা হয়েছে। চার জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। সময় মতো ওষুধ না খাওয়াই এর কারণ।”
বসিরহাট মহকুমা স্বাস্থ্য আধিকারিক অসিত কুমার পাণ্ডে কিন্তু সিলিকোসিসের সম্ভাবনা অস্বীকার করছেন না। তিনি বলেন, “প্রাথমিক ভাবে জানতে পেরেছি, ওই চার জন পাথর খাদানে কাজ করতে গিয়ে সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে ফিরে আসেন। ওঁদের যক্ষ্মার ওষুধ চলছিল। ওষুধ ঠিক মতো না খাওয়াতেই মৃত্যু হয়েছে।” তিনি জানান, মঙ্গলবার জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক-সহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি দল গোয়ালদহ ও দেবীপুর গ্রামে যাবে। স্বাস্থ্য দফতর থেকেও একটি দল আসার কথা রয়েছে।
এসএসকেএম হাসপাতালের ‘পালমোনারি মেডিসিন’ বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক আলোক গোপাল ঘোষাল বলেন, “সিলিকোসিস রোগীদের যক্ষ্মা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সিলিকো-টিউবারকিউলোসিস হয়ে থাকলে যক্ষ্মার চিকিৎসার প্রয়োজন হবে, কিন্তু তাতে সিলিকোসিস-জনিত কষ্টের উপশম হবে না।” তিনি জানান, সিলিকোসিস রোগের নিরাময় হয় না। অক্সিজেন, ব্রঙ্কো ডায়ালেটর, ইনহেলার প্রভৃতি দিয়ে রোগীর শ্বাসকষ্ট কমানো হয়।
ধুতুরদহ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন উপপ্রধান রিয়াজুল দফাদার বলেন, “বছর চারেক আগে গোয়ালদহের রজ্জাক মোল্লা পাথর খাদানে কাজ করতে গিয়েছিলেন। এর পরে শতাধিক মানুষ পাথর ভাঙার কাজ করতে গিয়েছেন।” গ্রামবাসীরা জানান, মূলত বর্ধমান শিল্পাঞ্চলে আসানসোল-জামুড়িয়ার খাদানেই ওঁরা কাজ নিয়েছিলেন। সাত-আট মাস আগে অধিকাংশই অসুস্থ হয়ে ফিরে আসে। রিয়াজুল বলেন, “এখনও পর্যন্ত সাতজন মারা গিয়েছে। একশোরও বেশি অসুস্থ। বিষয়টি রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর ও প্রশাসনকে জানিয়েছি।”
এ দিন দু’জনের মৃত্যুর খবর পেয়ে মিনাখাঁর বিডিও গৌরমোহন হালদার এবং ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক রাজু মণ্ডল গ্রামে যান। গ্রামবাসীরা তাঁদের হাতে আক্রান্ত ১০৩ জনের নামের তালিকা তুলে দেন। বিডিও বলেন, “এখানে যে এই রোগ এমন প্রবল আকার নিয়েছে, তা আমরা জানতাম না। জানার সঙ্গে-সঙ্গেই এসেছি।” দুই গ্রামেই দেখা যায়, পাথর খাদান থেকে ফেরা অধিকাংশ যুবকই অসুস্থ। গ্রামবাসীরা জানান, গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে তাঁদের যক্ষ্মার ওষুধ দেওয়া হয়েছে। |