|
|
|
|
সম্পাদক সমীপেষু... |
এই আক্রমণের মূলে আসলে ইগো |
তসলিমা নাসরিনের নিবন্ধের (‘পুংপুজো’, রবিবাসরীয়, ২৭-১০) সূত্র ধরে চারটি চিঠি ছাপা হয়েছে। (‘পুরুষের প্রতি এতটা বিদ্বেষ কেন?’ সম্পাদক সমীপেষু, ৭-১১) প্রথম চিঠিতে ধ্রুবজ্যোতি বাগচী লিখেছেন, তসলিমা নাসরিন ‘একটাই উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছেন। স্বামীর দীর্ঘায়ু। আলবাত তাই’। এই ‘আলবাত’ মন্তব্যের সপক্ষে তিনি লিখেছেন, ‘নিরক্ষর, চাকুরিহীনা বা স্বেচ্ছায় স্বাবলম্বী না-হওয়া মহিলার নির্ভরস্থল স্বামী’। আমার জিজ্ঞাসা, ওই মহিলা যদি নিরক্ষর, চাকুরিহীনা বা স্বেচ্ছায় স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন তার জন্য কি শুধু ওই মহিলাই দায়ী? দায়ী তো এই সমাজ, এমনকী এর দায় স্বামী পুঙ্গবের ওপরেও অনেকখানি বর্তায়। তা ছাড়া, উদয়াস্ত রান্নাবান্না, ঘরদোর পরিষ্কার, ছেলেমেয়ে এবং স্বামীকে খাইয়ে অফিসে পাঠানো, ইত্যাকার সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম করে যিনি ঘর সামলাচ্ছেন, তাঁর শ্রমের কি কোনও দামই নেই? শুধু চাকুরিরত পুরুষই কি পরিশ্রম করেন? |
|
‘কেন বিবাহিত ছেলেরা শাঁখা, সিঁদুর, লোহা পরছে না’? তসলিমার এই প্রশ্নের জবাবে পত্রলেখক মন্তব্য করেছেন, ‘শাড়িটাও জুড়ে দিতে পারতেন তো’। মন্তব্যটি কুরুচিকর, অবান্তরও বটে। শাড়ি শুধু সধবা মহিলারাই পরেন না, কুমারী, বিধবা সব মহিলারই পরিধেয়। এর পরে তিনি লিখেছেন, ‘বিবাহকে তো আইনানুগ বেশ্যালয় বলেই গিয়েছেন এক জন দাশর্র্নিক’। দাশর্র্নিক বার্নাড শ’ কোন প্রেক্ষিতে ‘Marriage is nothing but a legal prostitution’ (পত্রলেখক ‘বেশ্যালয়’ বলেছেন, যথাথর্র্ অনুবাদে হওয়া উচিত ছিল ‘বেশ্যাবৃত্তি’) মন্তব্যটি করেছিলেন তা পত্রলেখকের জানা আছে কি? এই সমাজে বিবাহবন্ধনের অসারতার প্রসঙ্গে তাঁর ওই মন্তব্য ছিল ব্যঙ্গাত্মক।
পত্রলেখক মনে করেন, ঘরে বিবাহিত স্ত্রী আছে, সে জন্যই কামনাবাসনা চরিতার্থ করার জন্য বাইরে যাওয়াটা তাঁর মতে দোষের কিছু নয়। এই প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্রের লেখা একটা লাইন তুলে ধরছি, ‘ভারতীয় হিন্দু সমাজে নারীকে খুবই সম্মান দেখানো হয়ে থাকে, শক্তিস্বরূপা বলা হয়, মা হওয়াকে নারীত্বের চরম সাফল্য বলে চিহ্নিত করা হয়। গোরুকেও গোমাতা বলে ভক্তি করা হয় কিন্তু গোপালক ভালই জানে যে, তার খইল ও খড়ের পরিমাণ যতটা কম করা যায় এবং যতটা বেশি দোহন করা যায় ততই মঙ্গল।’
শ্যামল মৈত্র। ব্যারাকপুর, কলকাতা-৭০০১২২
|
২ |
তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে প্রকাশিত চিঠিগুলি খুবই একদেশদর্শী। তসলিমা কিন্তু ব্যক্তি পুরুষের প্রতি বিদ্বেষ দেখাননি, তাঁর প্রতিবাদ সেই সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যা পুরুষের জীবনকে নারীর জীবনের থেকে বেশি মূল্যবান মনে করে। ওই নিবন্ধটি তিনি যে দিন আনন্দবাজারে পাঠিয়েছিলেন সেই দিনই দিল্লিতে আমার সঙ্গে তাঁর দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছিল। একটু তর্কও হয়েছিল। পত্রলেখকরা জানলে অবাক হবেন, ওই তর্কের সময় তসলিমাই আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন, কন্যাভ্রূণ হত্যার জন্য দায়ী সমগ্র সমাজব্যবস্থা। এ জন্য ব্যক্তিবিশেষের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে লাভ নেই। তসলিমা মূর্খ নন, পুরুষবিদ্বেষীও নন। তিনি ‘অধিকারতন্ত্র’ (অর্থাৎ হায়ারার্কি তসলিমা ওই শব্দটিকে এই ভাবে অনুবাদ করেছেন) বিরোধী। ওই নিবন্ধে সেটাই তাঁর মূল বক্তব্য ছিল।
তসলিমার বিরুদ্ধে পত্রলেখকদের উষ্মার প্রধান কারণ, করবা চৌথ প্রভৃতি প্রথার বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ। করবা চৌথ একটি নির্মম উত্তর ভারতীয় প্রথা। যার জন্য উত্তর ভারতের প্রায় সব বিবাহিতা মহিলাকেই ওই দিন নির্জলা উপবাস করতে হয়। যেমন, এখানে এক সময় ব্রাহ্মণ বিধবাদের একাদশী করতে হত। অবশ্য মগজ ধোলাইয়ের ফলে তাঁরা এটা স্বেচ্ছাতেই করেন। যেমন, বিধবারাও স্বেচ্ছাতেই নির্জলা একাদশী করতেন। বাংলার দুর্ভাগ্য, এখন বাংলায়ও এই নির্মম প্রথার প্রবেশ ঘটছে। আমার শৈশবে অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকে দেখতাম পুরষরাও অনেকেই শিবরাত্রি করতেন, অর্থাৎ ওটি একটি লিঙ্গ-নিরপেক্ষ বিশুদ্ধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল। এখন দেখি শুধু মেয়েরাই করেন। এবং গ্রামের কুমারীদের বাধ্যতামূলক ভাবে করানো হয় স্বামীলাভের জন্য। পত্রলেখকরা প্রশ্ন করবেন, তাতে দোষটা কি? কারণ, ‘মহিলার নির্ভরস্থল তাঁর স্বামী’ এবং ‘শতকরা নব্বই জন স্বামী তাঁর স্ত্রীকে পেটান না’ (পত্রলেখক ধ্রুবজ্যোতি বাগচী এই পরিসংখ্যান কোথায় পেলেন?)। সমস্যা হল, এই প্রথাগুলি একটি ‘ভিশাস সার্কল’-এর অঙ্গ। যত দিন মেয়েদের বিয়ে করতেই হবে এই ধারণা থাকবে তত দিন পুত্রের উচ্চশিক্ষা বেশি প্রয়োজন, কন্যার উচ্চশিক্ষা মূলত শৌখিন ও কম প্রয়োজন এই ধারণা থাকবে, পণপ্রথাও থাকবে। আবার যত দিন পণপ্রথা থাকবে, কন্যার প্রতি অনাদরও থাকবে। কন্যাভ্রূণ হত্যাও থাকবে। এই সব অন্যায় লোপ করতে চাইলে সর্বাগ্রে অসাম্যমূলক অধিকারতান্ত্রিক ধারণাগুলি বদলাতে হবে। এবং তা করতে চাইলে করবা চৌথ-এর মতো প্রথা যেগুলি এই সব ধারণা থেকেই জন্ম নিয়ে আবার নিজেরাও এই ধারণাগুলিকে পুষ্ট করছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই হবে।
সুস্মিতা ভট্টাচার্য। কলকাতা-২৬
|
৩ |
“যদি লোকধর্মের কাছে সত্যধর্মকে না-ঠেলিব, যদি ঘরের কাছে ঘরের মানুষকে বলি দিতে না-পারিব, তবে আমার রক্তের মধ্যে বহু যুগের যে শিক্ষা তাহা কী করিতে আছে”। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হৈমন্তী’ গল্পের অপুর এই সংলাপ থেকে সমাজধর্ম যে খুব বেশি এগোয়নি তা আরও এক বার ধ্বনিত হল। যাঁরা চিঠি লিখেছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই অপুর এই বাণী উচ্চারণ করে সংস্কারের সপক্ষে যুক্তির জাল বিস্তার করেছেন। যাঁদের মধ্যে এক জন নারীও। যিনি দীর্ঘ অবদমিত মানসিকতার হীনমন্যতায় ভোগা নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে বলেছেন, মনের গহ্বর থেকে সংস্কারের শিকড় উৎপাটনের প্রয়োজনও তো নেই। ঠিক এখানেই তসলিমা নাসরিন সার্থক এবং এই সময়ে তাঁর এই লেখা খুবই প্রাসঙ্গিক।
শৃঙ্খল, তা সে লোহারই হোক আর সোনারই হোক, বন্ধনের জ্বালা তো একই। সংস্কারাচ্ছন্ন নারীরা সেটুকুও বুঝতে পারছেন না। বরং উল্টে এই সব শৃঙ্খলচিহ্ন পরে জগতে কল্যাণময়ী উপাধি পেয়ে নিজেদের ধন্য মনে করছেন। শুধু হাতে পায়ে শৃঙ্খল আর সিঁথিতে রক্তচিহ্ন এঁকে দিয়েই যে স্বঘোষিত পুরুষরা ক্ষান্ত হয়েছে তা কিন্তু নয়। নামের সঙ্গেও যুক্ত করে দিয়েছে নিজের পদবিও। কেন, কেবল নারী সঙ্গীটি এই সব সংস্কারের চিহ্ন বহন করবে আর পুরুষ সঙ্গীটি কোনও চিহ্ন বহন করবে না? সে প্রশ্নও কিন্তু খুব কম মেয়ের মনে জাগে। দু’এক জন তসলিমা নাসরিন প্রতিবাদ করলেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বঘোষিত পুরুষেরা রে রে করে ওঠেন।
স্বঘোষিত পুরুষ এই জন্য বললাম, সৃষ্টজগতে বিশ্বস্রষ্টা পরমপুরুষই একমাত্র পুরুষ সত্তা। আর সব প্রকৃতি। নারীর বিপরীত শব্দ পুরুষ নয়, নর।
পুরুষের বিপরীত শব্দ প্রকৃতি। নারীও প্রকৃতি, নরও প্রকৃতি। নরনারীর মিলিত জৈবিক-সামাজিক নিয়মনিষ্ঠার মধ্য দিয়েই সমাজ সংরচনা গড়ে উঠেছে। কিন্তু শাসন শোষণের মানসিকতার এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষ দুর্বলের উপর সবলের আধিপত্য বিস্তারে নারী জাতিকেও দুর্বল ভেবে নিজেরা সেজেছে পুরুষ। আর তাদের প্রণীত সমাজশাস্ত্রে, ধর্মশাস্ত্রে পদে পদে নারীর জন্য বেঁধে দিয়েছে নানা সংস্কারের গণ্ডি। বলেছে, নারী নরকের দ্বার। স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর বেহেশ্ত। নারী শস্যক্ষেত্র, ইত্যাদি সব অবমাননাকর বিধান। আর সতী নারীর উপাধিতে ভূষিত হতে গিয়ে দীর্ঘ অবদমিত মানসিকতার নারীরাও সে সব নীতিকথা মেনে নিয়ে স্বামীর মঙ্গল কামনায় নানা ব্রত-উপচার করেন।
পরাজিত মানসিকতার প্রতীক হিসেবে মেয়েরা সিঁথিতে সিঁদুর পরেন। তসলিমার প্রতিবাদ এই অবদমিত মানসিকতার বিরুদ্ধে আর পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। মানবকল্যাণের বিরুদ্ধে নয়।
ফরিদা নার্গিস। কালদিঘি, দক্ষিণ দিনাজপুর |
|
|
|
|
|