ভারতরত্ন নামক পুরস্কারটির নামমাহাত্ম্য যত, তাহার ইতিহাস ততখানি মহৎ নহে। এমন অনেক ভারতীয়ই এই পুরস্কারের প্রাপক তালিকায় রহিয়াছেন, যাঁহারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হইলেও তাঁহাদের রত্ন হিসাবে স্বীকার করিতে বিভিন্ন কারণে আপত্তি থাকিতে পারে। কিন্তু ইতিহাস যথেষ্ট উজ্জ্বল না হইলে তাহাকে যথেষ্ট উজ্জ্বল করিবার চেষ্টাই বিধেয়, পুরস্কারটির মর্যাদায় আরও আঘাত করিবার কোনও যুক্তি থাকিতে পারে না। এই গোত্রের কোনও পুরস্কার দেওয়া সরকারের আদৌ উচিত কি না, অথবা এমন পুরস্কার থাকিলে তাহার অপব্যবহার অনিবার্য কি না, সেই তর্ক আপাতত সরাইয়া রাখা যাক। যে দর্শন হইতে স্বাধীন ভারতে এই পুরস্কারের সূচনা, তাহাতে ফিরিয়া গেলে স্পষ্ট হইবে, ইহা কোনও সাধারণ পুরস্কার নহে। অতি বিরল এবং অতি উচ্চ স্তরের প্রতিভা ও কৃতির স্বীকৃতি হিসাবেই এই পুরস্কারটি দেওয়া বিধেয়। দেখা যাইতেছে, ভারতের শাসকরা ভারতরত্ন পুরস্কারটিকে একটি খেলো পিঠ চাপড়ানিতে পরিণত করিতে বদ্ধপরিকর।
সচিন রমেশ তেন্ডুলকর এবং চিন্তামণি নাগেশ রামচন্দ্র রাও, দুই জনই নিজ ক্ষেত্রে কৃতী। দ্বিতীয় জনের কৃতিত্বে যদিও একাধিক বার কুম্ভীলকবৃত্তির ছায়া পড়িয়াছে। রাও আদৌ এই পুরস্কারের যোগ্য কি না, সেই প্রশ্নটি বহু কারণেই উড়াইয়া দেওয়া কঠিন। কিন্তু মূল আপত্তি প্রথম জনকে লইয়া। ক্রিকেটে তাঁহার প্রতিভা ও কৃতি প্রশ্নাতীত। কিন্তু, ক্রিকেট নামক ঔপনিবেশিক খেলাটি দুনিয়ায় কয়টি দেশ খেলে? এমনকী যে দেশে এই খেলার জন্ম, সেই ইংল্যান্ডও ক্রিকেটে উৎসাহ হারাইয়াছে। খেলাটির মহিমা এখন এই উপমহাদেশে, বস্তুত ভারতেই সীমাবদ্ধ। যে খেলাটি শুধু ভারতীয়রাই দেখে, ভারতীয়রাই খেলে, সেই খেলায় ‘দুনিয়ার সেরা’ বাছিয়া তাঁহাকে ‘ভারতরত্ন’ দিলে পুরস্কারটির কতটুকু মাহাত্ম্য অবশিষ্ট থাকে? চকচক করিলেই তাহা ‘রত্ন’ হয় না। অন্তত এই পুরস্কারটির ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তার ছটা মাপকাঠি হইতে পারে না। কাহার চর্চার বিষয় কতখানি গভীর, মহৎ এবং বৌদ্ধিক, তাহাই পুরস্কারের প্রথম বিচার্য হওয়া প্রয়োজন। সেই নিরিখে ভারতরত্নের ভাণ্ডার তেমন উজ্জ্বল নহে। মৌলিক গবেষণার জন্য ষাট বৎসরে ভারতরত্ন পাইয়াছেন মাত্র দুই জন সি ভি রমন ও অমর্ত্য সেন। বস্তুত, চর্চার বিষয় হিসাবে বড় জোর দ্বিতীয় শ্রেণির, এমন বহু ক্ষেত্রেই ‘ভারতরত্ন’ দেওয়া হইয়াছে। বিসমিল্লা খান বা লতা মঙ্গেশকরের পুরস্কারপ্রাপ্তি তাহার প্রমাণ। অনুমান করা চলে, জনপ্রিয়তাই তাঁহাদের স্বীকৃতির কারণ। সচিন তেন্ডুলকর সেই তালিকায় নবতম সংযোজন। খেলা বিষয়টি এই পুরস্কারের আওতায় পড়িত না। ইউ পি এ সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী তাহাকে জুড়িয়াছেন। ভুল করিয়াছেন। অন্তত সচিন তেন্ডুলকরকে পুরস্কার অর্পণের তাগিদে নিয়ম বদলাইবার বুদ্ধিটি প্রধানমন্ত্রী বা তাঁহার পরামর্শদাতা ও অভিভাবকদের বিচক্ষণতার পরিচয় দেয় না।
পুরস্কারটিকে হাস্যকৌতুকের স্তরে নামাইয়া আনিবার কাজটি কংগ্রেস দক্ষ ভাবে সম্পূর্ণ করিল পুরস্কার ঘোষণার দিন নির্বাচনের মাধ্যমে। গোটা দেশ যখন সচিনের বিদায়বেলায় তাঁহাকে কোনও না কোনও উপহার দিতে ব্যস্ত, ঠিক তখন প্রধানমন্ত্রীর দফতর ‘ভারতরত্ন’ দেওয়ার সংবাদটি ঘোষণা করিল। সরকারি বিদায় উপহার? না কি, সচিনের জনপ্রিয়তা কাজে লাগাইয়া নিজেদের নির্বাচনী মরা গাঙে খানিক জল বহাইবার মরিয়া চেষ্টা? প্রথমটি হইলে কুরুচির পরিচয়, পুরস্কারটির গুরুত্ব বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীনতার পরিচয়ও বটে; আর দ্বিতীয়টি হইলে বোধহীনতা। সচিনকে ‘ভারতরত্ন’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ামাত্র বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের দাবি লইয়া ময়দানে নামিয়াছে। কংগ্রেসের আর পাঁচটি সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের ন্যায় এই সিদ্ধান্তটিও দলের জন্য বিপদই ডাকিয়া আনিল। এই কুনাট্যে সচিন তেন্ডুলকর অথবা ভারত, কাহারও প্রতিই সম্মান প্রদর্শন হইল না। |