|
|
|
|
স্বদেশি মুখের সন্ধানে সিপিএম, তবে বাদ বসু |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
দল তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি। তিনি বলেছিলেন, ঐতিহাসিক ভুল। এ বারও তাঁকে বাদ রেখেই এগোতে চাইছে দল। কেন্দ্রের থেকে পাওয়া জমিতে দিল্লির বুকে হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ এবং ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের নামে ভবন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিপিএম। কিন্তু উপেক্ষিত জ্যোতি বসু।
সুরজিতের নামে স্থায়ী পার্টি স্কুল এবং নাম্বুদিরিপাদের নামে গবেষণা কেন্দ্র গড়ার সিদ্ধান্ত এমনিতেই সিপিএমের নিরিখে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এত দিন দলে তাত্ত্বিক প্রশ্নে মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও জে দং-এর কথা বলা হলেও ভারতীয় কমিউনিস্টরা গুরুত্ব পাননি। সিপিএম নেতাদের অনেকেই এখন মনে করছেন, দেশীয় মুখ সামনে না-রাখাটা গোটা দেশে পার্টির প্রভাব বিস্তারের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক। সেই কারণেই দিল্লির রউস অ্যাভিনিউয়ের জমিতে সুরজিৎ-নাম্বুদিরিপাদের নামে ভবন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পলিটব্যুরো।
কিন্তু ২৪ বছর মুখ্যমন্ত্রী থেকে রেকর্ড গড়া জ্যোতি বসু বাদ কেন? বিশেষ করে যখন জন্মশতবর্ষ চলছে!
পলিটব্যুরোর এই সিদ্ধান্তে পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম নেতারা অনেকেই ক্ষুব্ধ। তাঁদের অভিযোগ, আগামী বছর ৮ জুলাই জ্যোতি বসুর জন্মের শতবর্ষ উদ্যাপন শেষ হলেও এখনও তাঁকে নিয়ে জাতীয় স্তরে কোনও অনুষ্ঠান হয়নি। আগামী মাসে একটা বৈঠক ডাকা হয়েছে। তড়িঘড়ি করে কিছু করার কথা বলা হচ্ছে। তার উপর এই ভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে তাঁর মতাদর্শগত অবদানকে।
পার্টি-কেন্দ্রের অবশ্য যুক্তি, জ্যোতিবাবু মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। সুরজিৎ বা নাম্বুদিরিপাদের মতো সাধারণ সম্পাদক নন। তাঁকে অনুসরণযোগ্য তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে মানতে দলের অনেকেরই আপত্তি রয়েছে। তা ছাড়া, প্রকাশ কারাটরা দলকে যে পথে নিয়ে যেতে চান, তার সঙ্গে জ্যোতিবাবুর বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির একটা মূলগত ফারাকও রয়েছে।
আর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন নিয়ে আলিমুদ্দিনের উষ্মা সম্পর্কে একেজি ভবনের জবাব: পশ্চিমবঙ্গের নেতাদেরই যথেষ্ট উৎসাহ নেই। তাঁদের প্রশ্ন, দিল্লির গবেষণা কেন্দ্রের জন্য কেরল পার্টি, বিশেষ করে পলিটব্যুরো সদস্য এম এ বেবি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে পাঁচ কোটি টাকার বেশি জোগাড় করে ফেলেছেন। জ্যোতিবাবুকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের তেমন কোনও উদ্যোগ আছে কি?
কিন্তু জ্যোতিবাবু থাকুন বা না-থাকুন, দেশের বাম নেতাদের তুলে ধরার চেষ্টা কেন করতে হচ্ছে সিপিএম-কে? পলিটব্যুরো নেতারা বলছেন, ১৯২৫ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত দলের প্রধান মতাদর্শগত জনকরা হলেন মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন এবং মাও জে দং। এ দেশের অন্য রাজনৈতিক দলগুলি কিন্তু এমন ভাবে বিদেশি লগ্নি নির্ভর নয়। কংগ্রেস এগিয়েছে গাঁধী এবং নেহরুকে সামনে রেখে। বিজেপি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে দীনদয়াল উপাধ্যায় হয়ে অটলবিহারী বাজপেয়ীকে তুলে ধরেছে। আঞ্চলিক দলগুলির ক্ষেত্রেও এটা সত্য।
কিন্তু ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির যাত্রা শুরু কমিনটার্নের অধীনে, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ছাতার তলায়। এমনকী পার্টির উপর থেকে যখন নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল, মুজফ্ফর আহমেদ তখন সরোজ মুখোপাধ্যায়কে বলেন, সাইনবোর্ড ও লেটারহেডে যেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি লেখা না হয়। বরং লেখা হোক, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তথা কমিনটার্নের শাখা।
কমিনটার্নের প্রভাব নিয়ে অতীতে বিতর্ক যে হয়নি, তা নয়। একদা মানবেন্দ্র রায় কমিনটার্নের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিলেন। কিন্তু দলে বিশেষ সমর্থন পাননি। বরং কিছুটা একঘরেই হয়ে যান। পরে পি সি জোশীও কমিউনিস্ট পার্টিকে ভারতীয় করে তোলার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। তিনি দল থেকে বিতাড়িত হন।
এত বছর পরে ওই প্রশ্নে দলে ফের আলোচনা শুরু হয়েছে। কেন?
সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্ব বলছেন, ১৯২৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে একই সঙ্গে জন্ম রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস)। গত ৮৮ বছরে তারা গোটা দেশে বাম আন্দোলনের থেকে যে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে, তার অন্যতম কারণ হল ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্মতা তৈরি করে ফেলতে পেরেছে সঙ্ঘ পরিবার। প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরিরা তাই মনে করছেন, মার্ক্স-এঙ্গেলস অনেক হয়েছে, এ বার ভারতীয় নেতৃত্বকে সামনে রেখে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার।
পলিটব্যুরোর এক নেতার কথায়, “স্বদেশি হয়ে ওঠার কাজটা খুবই সাবলীল ভাবে করেছে চিন। কমিনটার্নের ছাতার তলা থেকে বেরিয়ে এসে দেশের ঐতিহ্যকে ও সংস্কৃতিকে সামনে রেখে পার্টির রূপান্তর ঘটিয়েছে।”
সেই পথে হাঁটতেই নাম্বুদিরিপাদ এবং সুরজিতকে সামনে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিপিএম। কারণ, ইএমএস দক্ষিণ ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন। আর সুরজিৎ ছিলেন উত্তর ভারতে আন্দোলনের মুখ।
কিন্তু জ্যোতিবাবু যে পূর্বাঞ্চলের প্রতিনিধি ছিলেন, সেখানে তো সিপিএমের দাপট সব চেয়ে বেশি! তা ছাড়া, জ্যোতিবাবুর সর্বভারতীয় গুরুত্বও তো উপেক্ষা করার নয়। দলের কট্টরপন্থীরা নারাজ হলেও তাঁকে সামনে রেখেই তো এক সময় কেন্দ্রে জোট সরকার গড়তে চেয়েছিল আঞ্চলিক দলগুলি। তা হলে তাঁকে উপেক্ষা করার পিছনে কি কাজ করছে সেই দিল্লি-বাংলা সাবেক বিরোধ? যে বিরোধের জেরে পার্টি-কেন্দ্র দিল্লিতে হয়েছিল, কলকাতায় নয়।
এই প্রশ্নে অবশ্য চুপ বাম নেতারা। |
|
|
|
|
|