অন্যের ধোঁয়ায় বিষপান ঠেকাতে এ বার সক্রিয় হচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর। পাঁচ বছর আগে এ নিয়ে আইন হওয়া সত্ত্বেও কেন এত দিন তার প্রয়োগ হয়নি, এ বার সেটাই খতিয়ে দেখা হবে। স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) বায়ু দূষণকে ক্যানসারের অন্যতম কারণ বলে ঘোষণা করার পরেই এ নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়। এ ব্যাপারে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটি অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তাদের কর্মসূচি চূড়ান্ত করবে। সরকারি দফতরগুলির উপরে এ ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। জরিমানা আদায়ের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে চান স্বাস্থ্যকর্তারা।
স্বাস্থ্য দফতরের কনসালট্যান্ট, তামাক নিয়ন্ত্রণে এ রাজ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র প্রতিনিধি হিমাদ্রিশেখর মজুমদার জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে মুখ্যসচিব ও বিভিন্ন দফতরের সচিবদের নিয়ে আগেই একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তৈরি করা ছিল। ওই কমিটিই এ বার আইন প্রয়োগের বিষয়টি স্থির করবে। আইন প্রয়োগের দায়িত্ব মূলত যাদের হাতে, সেই বিভাগগুলির কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণের কথাও ভাবা হচ্ছে। হিমাদ্রিবাবু বলেন, “আইন যেমন রয়েছে, তেমন আইনের ফাঁকও রয়েছে। গোড়াতেই সেই ফাঁকগুলি আমাদের খুঁজে বার করতে হবে।”
রাস্তায়, বাসে-ট্রামে, অটোয়, অফিস-কাছারিতে যথেচ্ছ ধূমপান করেন অনেকেই। আশপাশের লোকজন আপত্তি করলে তা কানে তোলা হয় না। এক দিকে এ নিয়ে সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে, আর অন্য দিকে বিভিন্ন সরকারি দফতরে অবাধ ধূমপান চলেছে। পিছিয়ে নেই স্বাস্থ্য ভবনও। সেখানে আবার ফায়ার অ্যালার্ম বন্ধ রেখে সিঁড়িতে, করিডরে, ঘরে অবাধে ধূমপান চলে। বাদ যান না আমলারাও। ফল যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। বাড়ছে বায়ুদূষণ। ‘প্যাসিভ স্মোকিং’ বা পরোক্ষ ধূমপানের জেরে বাড়ছে ফুসফুসের নানা অসুখ, এমনকী ক্যানসারও।
‘সিগারেটস অ্যান্ড আদার টোব্যাকো প্রোডাক্টস অ্যাক্ট ২০০৩’-এর অন্তর্ভুক্ত ‘প্রহিবিশন অব স্মোকিং ইন পাবলিক প্লেসেস’ রুল জারি হয় ২০০৮ সালে। এই আইন অনুযায়ী প্রকাশ্যে ধূমপান করলে ২০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হওয়ার কথা। যিনি ধূমপান করছেন, তাঁকে যেমন জরিমানা দিতে হবে, তেমনই যাঁর সেটা দেখা কর্তব্য, তিনি দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে তাঁকেও একই পরিমাণ জরিমানা দিতে হবে। অর্থাৎ অটোয় কেউ ধূমপান করলে তাঁর পাশাপাশি অটোচালকের কাছ থেকেও জরিমানা আদায় করার কথা। শুধু ধূমপান নয়, ধূমপান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সাইনবোর্ড যদি না লাগানো থাকে, কিংবা সংশ্লিষ্ট জায়গায় কাউকে যদি ধূমপান রোধের দায়িত্ব না দেওয়া থাকে, তা হলেও জরিমানা আদায় করার কথা। এমনকী ‘নো স্মোকিং জোন’-এ যদি অ্যাশট্রে থাকে, তা হলেও তা জরিমানাযোগ্য!
প্রকাশ্য স্থান বলতে যে কোনও জায়গাকেই বোঝানো যেতে পারে। রাস্তাঘাট, দোকান-বাজার, অফিস, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন বিমানবন্দর সর্বত্র। কলকাতার সমস্ত থানাকে জরিমানা আদায়ের রসিদ দেওয়া হয়েছে, বিভিন্ন দফতর এবং প্রতিষ্ঠানের কাছেও রসিদ রয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে চাপান-উতোর চলছেই। পুলিশ দায় চাপায় স্বাস্থ্য দফতরের ঘাড়ে। আবার স্বাস্থ্য দফতর পাল্টা পুলিশকেই দায়ী করে। ফল যা হওয়ার তা-ই।
ক্যানসার নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কার্যনির্বাহী অধিকর্তা সুতপা বিশ্বাস বলেন, “এ ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত ন্যূনতম সচেতনতাই গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন বিভাগে স্বাস্থ্য দফতর জরিমানার রসিদ, চালান ইত্যাদি পাঠিয়েছে।
কিন্তু তার কোনও ‘ফলোআপ’-এর ব্যবস্থা নেই।”
চিকিৎসকদের মতে, পরোক্ষ ধূমপানের জেরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু এবং অন্তঃসত্ত্বারা। পরোক্ষ ধূমপানের জেরে গর্ভপাত ঘটার আশঙ্কা থাকে। শিশুদের নানা ধরনের অ্যালার্জি, হাঁপানি এবং ফুসফুসের নানা অসুখের জন্যও দায়ী পরোক্ষ ধূমপান। ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “স্বামী চেন স্মোকার হলে স্ত্রী বা সন্তানদের স্বাস্থ্যের উপরে তার ভয়াবহ প্রভাব পড়ে। প্রকাশ্যে ধূমপান বন্ধ করতে আইন চালুর পিছনে এটাই অন্যতম কারণ। ধূমপায়ী না হয়ে কেন ধূমপানের কুপ্রভাব সহ্য করতে হবে?”
ক্যানসার চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, “পরোক্ষ ধূমপান খুবই ক্ষতিকর। ইদানীং আমরা ফুসফুসের ক্যানসার আক্রান্ত এমন অনেককে পাচ্ছি, যাঁরা কস্মিনকালে নিজেরা ধূমপান করেননি। কিন্তু তাঁদের আশপাশে অনেকে করেন। সেই দায় তাঁদের বহন করতে হচ্ছে।” |